বহুমুখী সম্পর্কে বিশ্বাসী চীন by কাফি কামাল

বাংলাদেশের সঙ্গে সামগ্রিক সম্পর্ক রক্ষা করতে চায় চীন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বিএনপি প্রতিনিধি দলের সাম্প্রতিক চীন সফরে তেমনই ইঙ্গিত মিলেছে। সফরে বিএনপি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে একাধিক বৈঠক, সেমিনার ও সম্মান-সমাদরের মাধ্যমে সে বার্তা দিয়েছে অন্যতম প্রভাবশালী এ বন্ধু রাষ্ট্র। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বিশ্বস্ত সম্পর্ক আরও জোরদার হওয়ার আশ্বাস পেয়েছে বিএনপি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দেশটির বার্তা হচ্ছে- একমুখী নয়, বহুমুখী সম্পর্কে বিশ্বাসী চীন। গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখছে দেশটি। বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তা থেকে উত্তরণের জন্য ক্ষমতাসীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি দৃশ্যমান সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছে বিএনপি প্রতিনিধি দল। তারা বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যাতে অস্থিতিশীল না হয় সেজন্য চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে হলে চীনকে এখনই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।  বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে নিজেদের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়ে তা থেকে উত্তরণে অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রের মতো ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগীতার আশ্বাস দিয়েছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। বিএনপি প্রতিনিধি দলের সদস্যের সঙ্গে আলাপে এমন তথ্য জানা গেছে। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ছিল খুবই মজবুত। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেটা ধীরে ধীরে শিথিল হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণে চীনের কাছে খুবই গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশ। এ জন্য উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে চায় দেশটি। বিশেষ করে কক্সবাজারের সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে আগ্রহী চীন। কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক কারণে সেখানে প্রতিবন্ধকের ভূমিকায় রয়েছে প্রতিবেশী ভারত ও প্রভাবশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে ক্ষেত্রে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের সঙ্গে সামগ্রিক সম্পর্কের রক্ষার বিকল্প নেই চীনের সামনে। কিন্তু ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর বর্তমান সরকারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে। এমন পরিস্থিতিতে দুইপক্ষকে বার্তা দিতেই চীন সফরে বিএনপি প্রতিনিধি দলকে আমন্ত্রণ জানায় চীন। সূত্র জানায়, মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন চীন। তাদের ৮ম কংগ্রেস পরবর্তী চতুর্থ প্লিনামের মূল আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে ‘আইনের শাসন’। চীনা সমাজের বর্তমান রূপান্তরের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সার্বিক বিষয় ক্রমশ দলীয় পর্যায়ে অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে।

বিএনপি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেয়া ড. আবদুল মঈন খান বলেন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও বিএনপির মধ্যে যে বিশ্বস্ত সম্পর্ক রয়েছে তা আরও জোরদার করাই ছিল এ সফরের উদ্দেশ্য। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আজকের সরকারি দল চীনের সঙ্গে যে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছিল তা নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বর্তমানে উন্নয়নের যে সম্পর্ক বহমান তার মূল ভিত্তিই ছিল দুই দেশের মধ্যে ৪০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত সে বন্ধুত্বের সংযোগ। তারই ধারাবাহিকতায় আজ ভৌত, প্রতিরক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সেটা অতীতের হাজার বছরের চীন-বাংলাদেশের সম্পর্ককে একটি সর্বাধুনিক সম্পর্কে রূপান্তরিত করেছে। তিনি বলেন, সপ্তম শতকে পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এবং ১০ শতকে অতীশ দীপঙ্কর যে পারস্পরিক গ্রন্থি রচনা করেছিলেন আজ তারই ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হতে চলেছে খুনমিং-মান্দালয়-চট্টগ্রাম-ঢাকা-কলকাতা মডার্ন সিল্ক রুট। যা আগামী শতকগুলোতে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দিগন্তের উন্মোচন করবে। চীন সফরকে ‘পার্টি টু পার্টি’ সম্পর্কের গভীরতার নিদর্শন ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন দিগন্তের উন্মোচন হিসেবে দেখছে বিএনপি। এ সফরে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বিএনপির ঐতিহাসিক সম্পর্ক উত্তরোত্তর গভীরতা লাভ করেছে বলে দাবি করেছে চীন সফর করে আসা প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। তারা বলছেন, প্রতি বছরই বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। সে সব আমন্ত্রণে দলের চেয়ারপারসনসহ বিভিন্ন সারির বেশ কয়েকটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করেছে। তবে এবারের আমন্ত্রণটি ছিল ভিন্ন। এবারই প্রথম বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দলকে আমন্ত্রণ জানায় তারা। সে বিবেচনায় দলের নীতি-নির্ধারণী ফোরামের তিনজন সদস্যের সমন্বয়ে বাছাই করা একটি প্রতিনিধি দল সফরে পাঠায় বিএনপি।  তারা জানায়, সফরে একাধিক বৈঠক, সেমিনার ও বিভিন্ন  গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শনের পাশাপাশি সমাদরের বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য। প্রতিনিধি দলের কয়েকজন সদস্য জানান, মন্ত্রী হিসেবে চীন সফরের সময়েও অনেক সময় এমন সমাদর পাওয়া যায় না। পুরো সফরে প্রতিনিধি দলকে দেয়া হয়েছে ভিভিআইপি মর্যাদা। বিশেষ করে সরকার ও বিরোধী দলের বাইরে থাকলেও বিএনপি প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রস্তাবিত মডার্ন সিল্ক রুট, দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক, গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ পরিকল্পনা, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকারের কর্মপদ্ধতি এবং সমন্বয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।  এছাড়া চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের কর্মপদ্ধতি, নেতৃত্বের বিকাশ ও দল এবং সরকারের সমন্বয় সম্পর্কে বহুমাত্রিক ধারণা দেয়া হয় প্রতিনিধি দলকে। বিষয়গুলো বিশেষ অর্থবহ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একদিকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যায়ে নেতৃত্বের কর্মপদ্ধতি, বিকাশ, পররাষ্ট্রনীতি ও সরকার এবং নেতৃত্বের সমন্বয় সম্পর্কে কার্যকর ধারণা পেয়েছেন বিএনপি নেতারা। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক খ্যাত ‘এক্সিকিউটিভ লিডারশিপ একাডেমি’র বিশেষজ্ঞরা বিষয়গুলো বিএনপি নেতাদের সামনে উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে বৈঠক ও সেমিনারগুলোতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের কাছে বাংলাদেশে ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা ও নানা তথ্য উপস্থাপনের সুযোগ পেয়েছেন নেতারা। আন্তঃমহাদেশীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন নিয়েও সেখানে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছে বিএনপি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারের ওপর কিছুটা হলেও মনস্তাত্বিক চাপ তৈরি করা গেছে। সফর নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা পররাষ্ট্র সচিবের কাছে একটি চিঠিও দিয়েছে। ৯ দিনের ব্যস্ত সফর শেষে ইতিমধ্যে দেশে ফিরেছে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলটি। সফরের সার্বিক আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে নিজেদের অভিজ্ঞতা ও মতামত তুলে ধরেছেন প্রতিনিধি দলের নেতা  ড. আবদুল মঈন খান। সার্বিক বিবেচনায় সফরটিকে অর্থবহ ও ফলপ্রসূ হিসেবে দেখছে বিএনপি।
প্রতিটি সেমিনার ও বৈঠকে বিএনপি প্রতিনিধি দল প্রাসঙ্গিকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন, দেশের মানুষের প্রত্যাশা ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তারা উল্লেখ করেন, ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর একটি অনির্বাচিত সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রেখেছে। তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় বসে আছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির উত্তরণ প্রয়োজন। অথচ কার্যকর অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিকল্প নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ইতিবাচক উত্তরণ না ঘটলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার প্রেক্ষিতে সত্যিকার অর্থে একটি জনগণের সরকার গঠনে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনের জনগণ বাংলাদেশের মানুষের পাশে থাকবে বলে আশা করেন প্রতিনিধি দল। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট আগামীতে ক্ষমতায় এলে চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার আশ্বাস দিয়েছেন বিএনপির প্রতিনিধি দল।
সূত্র জানায়, বিদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চীন কখনও খোলামেলা বক্তব্য দেয় না। কিন্তু ৫ই জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেক প্রকাশ্য বক্তব্য দিয়েছে। সরকার তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে ধরতে না পারলে ভুল করবে। কারণ চীন সফরে বিভিন্ন বৈঠকে সে দেশের নেতারা জানিয়েছেন, ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন সম্পর্কে তারা অবহিত। তারা মনে করেন, পরিস্থিতির উত্তরণে সংলাপের মাধ্যমে একটি সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। বিএনপি প্রতিনিধি দলের এ সফরকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে সরকারও। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চীন যাওয়ার পথেই বিমানবন্দরে আটকে দেয়া হয়েছিল বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ ও যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে। দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর পাসপোর্টে জিডি নম্বর বসিয়ে বিমান ছাড়ার আগমুহূর্তে তাদের ছাড় দেয়া হয়। ফেরার পথেও একইভাবে জিডি নম্বর বসিয়ে তাদের দেশে ঢুকতে দেয়া হয়। ওদিকে বিএনপি প্রতিনিধি দলের চীন সফর নিয়ে পররাষ্ট্র সচিবকে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা। সে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সরকারকে চাপে ফেলার অংশ হিসেবে বিএনপির প্রতিনিধি দল চীন সফরে গিয়েছে।
বিশেষ করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির তৃণমূল নেতৃত্বের কর্মপদ্ধতি ও বিকাশ সম্পর্কে ধারণা পেতে একটি ফিল্ড স্টাডিতে অংশ নেন প্রতিনিধি দল। বিএনপি নেতারা জানান, চীন সফরে প্রতিনিধি দলের মূল আগ্রহ ছিল চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকার কিভাবে একসঙ্গে কাজ করে তা দেখা। কারণ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতারা একই সঙ্গে সে দেশের সরকারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা কিভাবে সেটা সমন্বয় করেন তা জানার ব্যাপারে আগ্রহ ছিল বিএনপি নেতাদের।
প্রতিনিধি দল জানায়, সফরের দ্বিতীয় দিন খুনমিং সিটিতে ইউননান প্রাদেশিক পার্টি কমিটির আয়োজনে ‘প্রস্তাবিত মডার্ন সিল্ক রুট’ ইস্যুতে বাংলাদেশ-চীন-ভারত ও মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর বির্নিমাণ শীর্ষক একটি সেমিনারে অংশ নেন বিএনপি প্রতিনিধি দল। সেখানে প্রস্তাবিত মডার্ন সিল্ক রুটের সম্ভাব্য পথ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। বিএনপি প্রতিনিধি দল মডার্ন সিল্ক রুটের প্রস্তাবনা সমর্থন করলেও সম্ভাব্য পথ নিয়ে নিজেদের অবস্থানের কথা তুলে ধরেন। তারা বলেন, মডার্ন সিল্ক রুট খুনমিং থেকে মিয়ানমারের মান্দালয় হয়ে চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-যশোর হয়ে কলকাতা হলে চারটি দেশের জন্যই যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ এবং স্বল্প দূরত্বের। একই দিন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ইউননান প্রাদেশিক শাখার ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল চিউ হে’র সঙ্গে একটি বৈঠক করে বিএনপি প্রতিনিধি দল। বৈঠকে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে ওঠে আসে।
২১শে সেপ্টেম্বর ‘জেনারেল বিভিউ অব দি রিপাবলিক অব চায়না’ ও ‘গভর্নমেন্ট স্ট্রাকচার অ্যান্ড ডিসিশন মেকিং সিস্টেম ইন চায়না’ শীর্ষক দু’টি সেমিনারে অংশ নেন বিএনপি প্রতিনিধি দল। সেমিনারে সিলাপ-এর ডিডিজি হ্যারি চেন সা লিউ ও সিলাপ-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পিপলস কংগ্রেসের সদস্য চিয়াং হাইসাম চীন সরকার ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নানা কর্মকৌশল তুলে ধরে বক্তব্য দেন। কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনের ইতিহাস এবং চীন সরকারের কার্যক্রমের বিশেষ চারটি বিষয় সামষ্টিক অর্থনীতি, বাজার তত্ত্বাবধান,  জনস্বার্থের নিশ্চয়তা ও পরিবেশ সংরক্ষণ তুলে ধরেন। পরে ‘দ্য মেথড অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স অব দ্য কমুনিস্ট পার্টি অব চায়না ইন স্ট্রেনদেনিং এ্যান্ড ইমপ্রেুাভিং দ্য পার্টিজ ওয়ার্ক স্টাইল’ শীর্ষক বিষয়ের উপর বক্তব্য দেন সিলাপ-এর প্রবীণ প্রফেসর লিউ চিয়ান। তিনি দল পরিচালনায় ৮টি রেগুলেশনের উল্লেখ করে বলেন, সমালোচনা ও আত্মসমালোচনা হচ্ছে দল বিকাশের অন্তর্নিহিত শক্তি। সেমিনারে বিএনপি প্রতিনিধি দল চীনের প্রশংসা করে বলেন, নীতির ওপর ভিত্তি করেই চায়না কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চীনের সামগ্রিক উন্নয়নে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে ক্ষমতা আঁকড়ে রেখে দুর্নীতিবাজ সরকাররা সমগ্র পদ্ধতিকে নষ্ট করে দেয়। যেমন বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে এরকমটিই ঘটছে।
২২শে সেপ্টেম্বর শাংহাই ফেডারেশন অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড কমার্স (এসএফআইসি) ও শাংহাই চেম্বার অব কমার্সের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি প্রতিনিধি দল। এসএফআইসি’র ভাইস চেয়ারম্যান ও এসসিসি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট চিন লিয়াং তার দলের নেতৃত্ব দেন। লিয়াং  বলেন, চীন নিজেদের শিল্পকে প্রসারিত করতে চায়, অন্য দেশে নিয়ে যেতে চায়। বিশেষভাবে বস্ত্রশিল্পকে দক্ষিণ এশিয়ায় নিয়ে যেতে আগ্রহী। চীন চায়, বাংলাদেশে তাদের প্রযুক্তি বর্ধিত হোক। বৈঠকে বিএনপি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের বিপুল সম্ভাবনার কথা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরে বলেন, বর্তমান চাইনিজ প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বয় করতে পারে তাহলে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প আরও বেশি গতিশীল হয়ে উঠবে এবং অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হবে। বাংলাদেশে নানা খাত আছে যেখানে চীন বিনিয়োগ করতে পারে। ভবিষ্যতে বিএনপি সরকার গঠন করলে চীনা বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে চীন দেশের জন্য স্বতন্ত্র ইপিজেড প্রতিষ্ঠা করবে।
২৪শে সেপ্টেম্বর রাজধানী পেইচিংয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগে আয়োজিত এক সেমিনারে অংশ নেয় বিএনপি প্রতিনিধি দল। সেমিনারে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের ডেপুটি ডাইরেক্টর জেনারেল চাং সুইই বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, সম্পর্ক কেবল ঐতিহাসিক ভিত্তিই নয়, দুই দেশের জনগণের স্বার্থে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কারণ দুই দলই চারদেশীয় ইকোনমিক করিডোরসহ অন্যান্য অভিন্ন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সুইই বলেন, নিকট প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বাস করি। সেমিনারে বিএনপি প্রতিনিধিরা জানান, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। ৩০ বছরে চীন যে উন্নয়ন করেছে তা বিস্ময়কর। চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রেক্ষিতে ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, অচিরেই চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রথমস্থান অধিকার করবে। বর্তমানে চার দেশীয় অর্থনৈতিক করিডোর পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতি এবং বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের সামপ্রতিক অবস্থান স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বে ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হবে। একই দিন ২৪শে সেপ্টেম্বর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের উপমন্ত্রী ও বাংলাদেশে চীনের সাবেক রাষ্ট্রদূত লি চুন-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিএনপি প্রতিনিধি দল। বৈঠকে ড. মঈন খান বলেন, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যাতে অস্থিতিশীল না হয় সেজন্য চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে হলে চীনকে এখনই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
২৫শে সেপ্টেম্বর পেইচিংয়ের মহাগণভবনে বিএনপি’র প্রতিনিধি দল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সচিবালয়ের সদস্য চাউ হংচু’র সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি বলেন, চীনা কমিউনিষ্ট পার্টি বিএনপিকে অত্যন্ত উচ্চ মাত্রায় মূল্যায়ন করে। কারন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বাংলাদেশ ও বিএনপি চীনের সঙ্গে একমত হয়েছে, বিশেষভাবে ওয়ান চায়না পলিসিতে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির গৃহীত সামপ্রতিক কয়েকটি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি গণমুখী রাজনৈতিক দল ছাড়া উন্নয়ন ধরে রাখা যায়না। বিএনপি প্রতিনিধি দল বৈঠকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক ও চীন সরকারের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য চীনা কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। আশ্বস্ত করেন, আগামীতে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছায় বিএনপি ক্ষমতায় এলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার আরও বেশি ঘনিষ্ঠভাবে চীনের সঙ্গে থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.