ডিসেম্বরে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন রানা প্লাজার শ্রমিকরা by এমএম মাসুদ

অবশেষে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকের পরিবার ও আহতদের সব দাবিদারকে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। আইএলও’র তত্ত্বাবধানে গঠিত তহবিল থেকে এই অর্থ দেয়া হবে। বিজিএমইএ ও আইএলও’র সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। এর আগে ২৩৫৮ জনকে মোট ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে, যা শতাংশের হিসেবে ৪০ শতাংশ। গত শুক্রবার সাভারের রানা প্লাজা ধসের দেড় বছর পূরণ হয়। কিন্তু এখনও যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাননি ক্ষতিগ্রস্তরা। সরকার, মালিকপক্ষ এবং বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ প্রদানে অনেক আশ্বাস দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত কেউ পেয়েছেন আংশিক, আবার কেউ পেয়েছেন খুবই সামান্য। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ মুহূর্তে আইএলও’র এ ধরনের ঘোষণা বেশ আশাব্যঞ্জক। আর ডিসেম্বরে এ অর্থ পেলে শ্রমিকরা খুবই উপকৃত হবেন। সূত্র জানায়, এর আগে ৪০ শতাংশ দেয়ার পর আইএলও তত্ত্বাবধানে গঠিত তহবিল রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ডে এ পর্যন্ত ২০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ হয়েছে। প্রাপ্য ১০০ ভাগ ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য আরও ৩১ মিলিয়ন ডলার দরকার। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকের পরিবার ও আহতরা একেক জন সর্বোচ্চ ৬২ লাখ থেকে সর্বনিম্ন ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছে। আইএলও কনভেনশন-১২১ অনুযায়ী এ ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছে বলে সূত্র জানায়।

ক্ষতিপূরণে আইএলও গঠিত কমিটির সদস্য বিজিএমইএ’র সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম মানবজমিনকে বলেন, ক্ষতির মাত্রা বিবেচনায় ক্ষতিপূরণে ভিন্ন ভিন্ন অঙ্ক ঠিক করা হয়েছে। প্রত্যেক শ্রমিক পদবি ও জীবনকালীন (বেঁচে থাকার গড় আয়ু হিসেবে) টাকা পাবে। এই অর্থের পরিমাণ জনপ্রতি সর্বনিম্ন ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৬২ লাখ টাকা পর্যন্ত পাবে।  ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে যারা ক্ষতিপূরণ নিয়েছে, তাদের ওই টাকা মোট ক্ষতির পরিমাণ থেকে বাদ দেয়া হবে। তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে ২৮৪৯ শ্রমিক এ ক্ষতিপূরণ পাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ট্রাস্ট ফান্ড থেকে শিগগিরই তৃতীয় কিস্তিতে ৮৫৮ নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবারের সদস্য ও আহত শ্রমিক ক্ষতিপূরণের ৪০ শতাংশ পাচ্ছেন। এর মধ্যে আছেন নিহত ১৩১ ও নিখোঁজ ৩৪ শ্রমিকের পরিবার এবং আহত ৬৯৩ শ্রমিক। তাদের স্বজনেরা পাবেন মোট ৩১ কোটি ৪৮ লাখ ৬৭ হাজার ১৫০ টাকা। এর আগে চলতি মাসের শুরুর দিকে দুই কিস্তিতে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন নিহত শ্রমিকদের পরিবারের এক হাজার ৫৫২ সদস্য ও আহত ৩৫ শ্রমিক। ট্রাস্ট ফান্ড থেকে তাদের নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে ক্ষতিপূরণ বাবদ ১২ কোটি ৭০ লাখ টাকা দেয়া হয়। অবশ্য এই ৪০ শতাংশ অর্থ থেকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে দেয়া অর্থ কর্তন করে রাখা হয়েছে। সমন্বয় কমিটি ও ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইনের দেয়া তথ্য অনুয়াযী, ২৮৪৯ জন আহত, নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিক পরিবারের ৫০৯৯ জন সদস্য দাবিনামা (ক্লেইম ফরম) পূরণ করেছেন। তাদের মধ্যে নিখোঁজ শ্রমিক আছেন কমপক্ষে ১৪১ জন। তাদের সবার জন্য আলাদা ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে দাবিনামা পূরণের কাজ শেষ হয়।
সূত্র মতে, নিহত শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল স্বজনদের ক্ষতিপূরণের অর্থ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই বিবেচনায় নিহতের স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা বা তাদের অবর্তমানে ভাই-বোনকে নির্ভরশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এসব সদস্যকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা এবং তাদের প্রাপ্য অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। এর আগে কয়েক ধাপে আরও অর্থ দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, আইএলও এবং আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিল যৌথভাবে রানা প্লাজার ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে ৪ কোটি ডলারের (প্রায় ৩১০ কোটি টাকা) এই তহবিল গঠন করে। তহবিলে রানা প্লাজার ৫টি কারখানা থেকে পোশাক ক্রয় করত এমন আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের অর্থ প্রদানের আহ্বান জানানো হয়। রানা প্লাজায় ৫টি গার্মেন্ট কারখানা থেকে পোশাক রপ্তানি হতো ২৯টি ব্র্যান্ডের কাছে। এর মধ্যে ১৬টি প্রতিষ্ঠান তহবিলে অর্থ দেয়নি। আইএলওর উদ্যোগে গঠিত সমন্বয় কমিটি এসব ব্র্যান্ডকে ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে গঠিত তহবিলে অর্থ প্রদান করার জন্য চিঠি দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন ব্যাংক, অর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা জমা পড়েছে। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের ইতিমধ্যে ২২ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এখনও ১০৫ কোটি টাকা ওই তহবিলে রয়েছে।
শ্রমিক নেত্রী তাসলিমা নাসরিন অভিযোগ করে বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মৃত্যুপুরী থেকে যারা প্রাণ ফিরে পেয়েছেন তারা আজ বেঁচে থেকেও মরা মতো। অথচ সরকার ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে গোলকধাঁধা শুরু করেছে। সব শ্রমিককে তাদের সারা জীবনের আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ প্রদান করার দাবি জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৪শে এপ্রিল সকালে সাভারে আটতলাবিশিষ্ট রানা প্লাজা ধসে পড়ে। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে চলে উদ্ধার অভিযান। ওই বছরের ১৩ই মে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ১১৩৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এখনও কিছুদিন পরপরই ঘটনাস্থল থেকে মানুষের হাড়গোড়, কঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.