‘ভিসা চালুর সম্ভাবনা সৃষ্টি’ আমিরাতের সঙ্গে তিন চুক্তি সই

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমিরাত সফরে তিনটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে দু’দেশের মধ্যে। হাইপ্রোফাইল এ সফর নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও ভিসা সমস্যা নিয়ে স্পষ্ট কোন ঘোষণা আসেনি। তবে পররাষ্ট্র সচিব জানিয়েছেন- এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বন্ধ থাকা ভিসা চালু করার বিষয়ে একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সফরের তৃতীয় দিনে স্থানীয় সময় দুপুর ১২টায় দুবাই জেবাল প্যালেসে আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক হয়। বৈঠকে দুই দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব। দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বৈঠকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিষয়ক চুক্তি, দ-প্রাপ্ত বন্দিদের বিনিময় চুক্তি ও ঢাকায় অবস্থানরত আমিরাতের দূতাবাসের জন্য জমি সংক্রান্ত তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ইস্যু হয়েছে যৌথ ইশতেহার। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বৈঠকে ভিসার বিষয়টি আলোচনায় এলে ইউএই প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কাজ করে বিষয়টি সমাধান করবে বলে জানিয়েছেন। তবে দু’পক্ষের যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে সেই ইস্যুগুলো ভিসা চালু করার ক্ষেত্রে অগ্রগতি বলে সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কামাল উদ্দিন বলেন- সন্ত্রাসবাদ, অস্ত্র চালান, মাদক ও মানব পাচারের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতেও উভয় দেশের জন্যই সহজ হবে। ইউএই সরকার আমাদেরকে যে সব মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি রয়েছে তাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আমরা আগ্রহ দেখাইনি। তবে দ-প্রাপ্তদের মানবিক বিষয়টি বিবেচনা করে আমরা তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছি। ভিসা খোলার ব্যাপারে তিনি বলেন- ইউএই সরকার একজন লেবার অ্যাটাশে নিয়োগ দেবে বলে জানিয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনা করলে ভিসার দ্বার উন্মোচিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। আমিরাতে অবস্থানরত ১০ লাখ বাংলাদেশীর প্রধান দাবি ভিসা ট্রান্সফার বা আকামা পরিবর্তনের ব্যাপারে কোন আলোচনা হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র সচিব জানান, আমিরাতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইউএইতে এক্সপো ২০২০ যে বাণিজ্যমেলা হবে তার ভেন্যু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক দিয়ে আমিরাতকে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এই আহ্বানে আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভিসা চালু এবং আকামা পরিবর্তনের বিষয়গুলো দু’ দেশের কর্মকর্তারা পর্যায়ে আলোচনা হবে। শিগগিরই এর সমাধান আসবে বলে আশা করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, সার্বিক দিক বিবেচনা করলে ইউএই সফরে অনেক সাফল্যই আমাদের অর্জিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে মধ্যপ্রাচ্যের জনপ্রিয় পত্রিকা খালিজ টাইমস এবং গালফ নিউজে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর খবর কাভারেজ দেয়া হয়েছে তা আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। ফলে আগামীতে আমরা আরও বেশি সফলতা অর্জন করতে পারবো।
দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে চুক্তি সই অনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। অপরাধী বিনিময় ও নিরাপত্তা বিষয়ক সহায়তা চুক্তিতে বাংলাদেশের পক্ষে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং আমিরাতের পক্ষে দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ সাইফ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান সই করেন। আর ঢাকায় আমিরাত দূতাবাসের জন্য প্লট হস্তান্তর সংক্রান্ত চুক্তিতে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং আমিরাতের পক্ষে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান সই করেন। তিন দিনের আমিরাত সফরে প্রথম দু’দিন আবু ধাবি কাটিয়ে গতকাল সকালে শেখ হাসিনা দুবাই পৌঁছান। তিন দিনের ওই সফর সম্পন্ন করে সন্ধ্যা নাগাদ তিনি দুবাই থেকে দেশের পথে রওনা হন।
প্রবাসে সুনাম ধরে রাখতে হবে: মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের সংশ্লিষ্ট দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে বাংলাদেশের সুনাম ধরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমিরাত সফরের দ্বিতীয় দিনে আবু ধাবিতে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান। প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে দেশে থাকবেন, সে দেশের আইন মানতে হবে। আগে বাংলাদেশের লোকদের বিদেশে সুনাম ছিল। কিছু লোকের জন্য ওই সুনাম নষ্ট হচ্ছে। আমরা চাই না প্রবাসে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হোক। কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। আইন ভাঙলে ভুক্তভোগী নিজেরাই হবেন। জানেন তো, এদেশের আইন ভাঙলে কি অবস্থা হয়। হোটেল সেন্ট রেজিসের হলরুমে বাংলাদেশ দূতাবাস ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আবু ধাবিতে ওই হোটেলেই দু’দিন কাটিয়েছেন শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিদেশে আমাদের সুনামের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আমাদের লোকজন অনেক বেআইনি কাজ করছে, যাতে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। জনশক্তি রপ্তানিতে বাংলাদেশ যেন ভবিষ্যতে ‘বেকায়দায়’ না পড়ে সেজন্য সবার সহযোগিতা কামনা করেন মন্ত্রী। প্রধান অতিথির বক্তব্যে সরকারের কর্মকান্ডের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চাই, আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষ সোনালী মানুষ হোক। বিশেষ করে যারা বাইরে আছেন তারা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদানের কথা স্মরণ করে সরকার প্রধান বলেন, আপনারা আপনাদের অজান্তেই দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের অবদানে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রবাসীদের বাংলাদেশে বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি) হিসেবে ঘোষণা দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিও প্রবাসীদের সামনে তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ‘অনেক খেলা’ হয়েছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে দুর্নীতিবাজ বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। পদ্মা সেতুতে টাকা ছাড় দেয়ার আগেই বলা হয়েছে ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে’। এটা বলে কত ধরনের খেলা হলো! পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোন দুর্নীতি হয়নি বলে নিজের দেয়া চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আমরা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করছি। এত বড় প্রজেক্টের কাজ নিজেরা করতে পারলে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে কেন? এমন প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রবাসীদের ভোট দেয়া নিয়ে নির্বাচন কমিশন কাজ করছে। প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগের সুযোগ থাকার কথা উল্লেখ করে তা গ্রহণের আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। বিদেশে বাংলাদেশীদের সুনাম যাতে ক্ষুণ্ন না হয় সেজন্য কর্মী পাঠানোর আগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। জনগণের উন্নয়নে নেয়া সরকারের পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা আমার একমাত্র কাজ। বাংলাদেশ এখন আর ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে চলে না। বাংলাদেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আবু ধাবিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। পরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংস্কৃতি, যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী শেখ নাহিয়ান মুবারক আল নাহিয়ানের দেয়া নৈশভোজে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.