পদবঞ্চিত by সৈয়দ আবুল মকসুদ

কয়েক বছর আগে আমরা আরব বসন্ত দেখেছি। তিউনিিসয়া থেকে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের অর্ধেক উত্তাল। ওই সব দেশের রাজপথে তারুণ্যের সেকি দুর্বার বিস্ফোরণ। ঠিক আরব বসন্তের ধাঁচেই ঢাকার রাস্তায় ৪৯ বছরের কম বয়সী ছাত্র-যুবকদের বৈপ্লবিক বিস্ফোরণ দেখল দেশবাসী। দেশে রগড় করার জন্য মিছেমিছি যদি বিরোধী দল বা ওই জাতীয় কোনো সংগঠন বলে: বুধবার বিকেলে তোপখানা রোডে আন্দোলনে নামব যেখান থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঘটানো হবে সরকারের পতন—ঘোষণাটি শোনামাত্র সরকার বারুদের মতো জ্বলে ওঠে। অদৃশ্য গোয়েন্দা বিভাগ থেকে অলৌকিক বাণীর মতো ঘোষিত হয়: বুধবার সন্ধ্যায় নাশকতা হবে। মঙ্গলবার কিছু গুলি–বারুদও এদিক-ওদিকে পাওয়া যায়। কিন্তু গত সপ্তায় যখন আরব বসন্তের মতোই ‘নয়াপল্টন বসন্তে’ উত্তাল হলো ঢাকার রাজপথ সেই বৈপ্লবিক তৎপরতা উপভোগ করলেন সরকারের সাড়ে তিনজন মন্ত্রী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
১৪ অক্টোবর জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ২০১ সদস্যবিশিষ্ট (আংশিক) নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। তার পরই ঢাকার রাজপথ রূপ নেয় উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে। নবগঠিত কমিটি বাতিলের দাবিতে পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীদের আন্দোলন। কোনো অদৃশ্য জায়গা থেকে আন্দোলনটি যে সর্বোচ্চ পৃষ্ঠপোষকতা পায় তা বাংলার অনেক বেকুফ পর্যন্ত বুঝতে পারে।
নয়াপল্টন বসন্তের প্রাথমিক পর্যায়েই বেগম খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন: সরকার বিরোধী দলে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছে। এ কথাও তিনি যোগ করেন, তবে তাতে সরকার সফল হবে না। যেমন তিনি বা তাঁর সরকার সফল হননি সেকালের বিরোধী দল আওয়ামী লীগে ভাঙন ধরাতে। খুব বড় দলে, বিশেষ করে নীতিপ্রধান নয় নেতৃত্বপ্রধান দলে, ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করে কোনো লাভ হয় না।
যা হোক, আন্দোলনকারীদের বক্তব্য থেকে বোঝা গেল, বিএনপি যেমন সরকারের পতন না ঘটিয়ে ঘরে ফিরবে না (আসলে ঘরের ভেতর থেকে তাঁরা বেরই হননি), তেমনি নবগঠিত কমিটি বাতিল না করে ‘পদবঞ্চিতরা’ আন্দোলন ‘অব্যাহত’ রাখবেন। সারা দিন আন্দোলন করবেন এবং সন্ধ্যায় তাঁরা কেউ ফিরে যাবেন ঘরে, কেউ কোনো দপ্তরের কর্মকর্তার কক্ষে।
বাংলা ভাষা অতি সমৃদ্ধ, প্রতিশব্দে ভরপুর। বিধাতা আমাদের দুটি হাতের মতো দুখানা পা-ও দিয়েছেন। পা-কে পদ, চরণ, ঠ্যাং প্রভৃতিও বলা হয়। পদবঞ্চিতদের আন্দোলন দেখে মনে হলো, এ যেন খালেদা জিয়া তাদের দুটি পদ বা পা থেকে বঞ্চিত বা বিচ্ছিন্ন করেছেন। দুই পা ছাড়া একজন তাজা মানুষ যেমন আধা, তেমনি কোনো একটি পদ বা পোস্ট ছাড়া ওই ‘নেতা’রা আধাও নয়, সিকিও নয়, আনি-দোয়ানিও নয়—ফুটো পয়সা মাত্র। সুতরাং নেতা হিসেবে মর্যাদার অধিকারী হতে হলে ‘পদ’ দরকার।
পদ পেতে গিয়ে আন্দোলন ফাইটিংয়ে রূপ নেয়। যে নয়াপল্টন অফিসে পুলিশ-গোয়েন্দাদের পারমিশন ছাড়া একটি বিড়াল পর্যন্ত উঁকি দিতে পারে না, সেখানে বীরবিক্রমে পদবঞ্চিতরা গিয়ে বিপ্লব শুরু করেন। ফাইটিংয়ে জখম হন অনেকে। পুলিশ ফাইটিং উপভোগ করে টেলিভিশনের দর্শকদের মতোই। পদবঞ্চিত কেউ কেউ এতটাই জখম হলেন যে নিজেদের পৈতৃক পদ দুখানির চলার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেন। তাঁদের অনেককে তাঁদের সহফাইটাররা পাঁজাকোলা করে শূন্যে তুলে ধরেন। টিভির সংবাদে দেখেছি এবং খবরের কাগজেও দেখলাম, পদবঞ্চিতদের অনেকের পা দুটি আকাশের দিকে, তাঁদের মাথার দিক কোনো দরদির কোলের মধ্যে। বাংলার ছাত্ররাজনীতিতে পা ও পদ গুরুত্বপূর্ণ।
রাস্তার মধ্যে দুই দোকানদার, দুই ভাই, দুই ভায়রা অথবা বাপ-বেটা মারামারি করলে তা পুলিশ গিয়ে ঠেকাতে পারে। কিন্তু এঁদের ক্ষেত্রে পুলিশ দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে মনে মনে বলছিল: বাচ্চালোকের বাবারা তালিয়া বাজাও, জোরসে তালিয়া বাজাও। ভেলকি ভালোমতো লাগুক। ছানা ও চিনি ছাড়া শুধু ময়দার গোল্লায় যেমন রসগোল্লা হয় না, তেমনি কোনো পদ ছাড়াও ‘নেতা’ হওয়া যায় না। পদ বা পোস্ট ছাড়া দাম নেই। পদবঞ্চিত নেতা জীবনের অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত। কোনো প্রতিষ্ঠান ও দোকান-মালিকেরা বা ঠিকাদারেরা চাঁদা থেকে বঞ্চিত করবেন। পদবঞ্চিত হলে নিজেদের সংগঠনের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে অথবা প্রতিপক্ষ দলের মধ্যে মারামারির হুকুম
দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। পদে বঞ্চিত হওয়ার যে ক্ষতি তা অপূরণীয়।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ছাত্রনেতারা ছিলেন আদর্শে অবিচল। তখনো দল ভেঙেছে। কেউবা দল থেকে বেরিয়ে গেছেন আদর্শগত কারণে, পদবঞ্চিত হয়ে নয়। বর্তমান মন্ত্রিসভায় সাবেক ছাত্রনেতা আছেন অনেকে। বড় দলগুলোতেও সেকালের ছাত্রনেতারা আছেন। পদবঞ্চিত হওয়া কাকে বলে তা ছিল তাঁদের অজানা। পদবঞ্চিতদের আন্দোলনে যাঁদের পদশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁরা দ্রুত আরোগ্য লাভ করুন এবং আশীর্বাদ করি পদপ্রাপ্ত হয়ে পদগৌরবে তাঁরা ধন্য হোন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷

No comments

Powered by Blogger.