রাজধানীর গণপরিবহন- ঠাঁই নাই, আছে ঝুঁকি–ভোগান্তি by সামছুর রহমান

যে শহরের গণপরিবহনব্যবস্থা যত ভালো ও সুশৃঙ্খল, সে শহর তত বেশি নাগরিকবান্ধব, বাসযোগ্য। সে বিচারে রাজধানী ঢাকার অবস্থা কী? গণপরিবহনের ওপর নির্ভর করে ঢাকায় যাতায়াত যে কী যন্ত্রণার, তা কেবল ভুক্তভোগীরা বলতে পারেন। ঢাকার গণপরিবহন নিয়ে আজ থাকছে বাসে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা
সোমবার সকাল নয়টা। রাজধানীর কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে শ খানেক মানুষ বাসের অপেক্ষায়। গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী পথে চলাচলকারী (২২/এ নম্বর রুট) একটি মিনিবাস আসামাত্রই ওঠার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন ২০-২৫ জন। কিন্তু টেকনিক্যাল মোড়ের দিক থেকেই মিনিবাসটি এসেছে যাত্রীতে পূর্ণ হয়ে, তিলধারণের ঠাঁই নেই। যাওয়ার তাড়ায় দরজার পাদানিতে কোনোরকমে পা রেখে হাতল ধরে ঝুলে পড়লেন কয়েকজন।
পাদানিটি মূলত বাসের চালকের সহকারীর দাঁড়ানোর জন্য। এখান থেকেই যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে হাঁকডাক করে সহকারী। এই মিনিবাসে ঝুলন্ত যাত্রীর সংখ্যা এত বেশি ছিল যে চালকের সহকারীও বলতে বাধ্য হন, ‘গেটে ঝুইলেন না ভাই, কইতাসি না ভাই, ঝুইলেন না।’
গণপরিবহনে এই ভোগান্তি কতটা, তা দেখতে এই প্রতিবেদকও হাতল ধরে ঝুলে পড়েন মিনিবাসটিতে। চলতে শুরু করে মিনিবাস। এই যাত্রা শেষ হয় যাত্রাবাড়ী মোড়ে গিয়ে। কিছুক্ষণ পর অবশ্য ঠেলে কোনোরকমে দরজায় দাঁড়ানো সম্ভব হয়। দরজায় কোনোমতে দাঁড়ানো যাত্রীদের একটু পর পরই চালকের সহকারী বলছিলেন, ‘ভাই, একটু চাইপা দাঁড়ান’, ‘আপনি ওই পাশের রডটা ধরেন।’ কিন্তু দরজা আর বাসের ভেতর—সব স্থানেই রড ধরার জায়গা পেতেও সংগ্রাম করতে হচ্ছিল।
প্রতিবেদক যাত্রাবাড়ী নেমে আরেকটি মিনিবাসে চড়ে কুড়িল বিশ্বরোডে যান। সেখান থেকে একটি মিনিবাসে চেপে মহাখালীতে যখন নামেন, তখন বিকেল সোয়া চারটা। ভ্রমণ দূরত্ব ৩৯ কিলোমিটার। কিন্তু সময় লেগেছে সোয়া সাত ঘণ্টা। সব পথেই বাস-মিনিবাসের চিত্র প্রায় এক, পুরোটাই ভোগান্তি আর ঝুঁকিতে ভরা। বাস–মিনিবাসই অধিকাংশ নগরবাসীর যাতায়াতের মূল ভরসা।
রাজধানীর গণপরিবহনের চিত্র বর্তমানে এমনই; বিশেষ করে সকালে দাপ্তরিক কাজকর্ম শুরুর আগে এবং বিকেলে ছুটির পর একসঙ্গে অনেক মানুষ রাস্তায় নেমে এলে। যাত্রীর এই চাপ রাজধানী ও এর আশপাশে চলা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বাস-মিনিবাসের পক্ষে নেওয়া একেবারেই অসম্ভব।

>>ভিড় ঠেলে প্রতিদিন গণপরিবহনে উঠতে হচ্ছে যাত্রীদের। গতকাল বিকেল সাড়ে চারটায় ফার্মগেটে বাসটি এলে হুমড়ি খেয়ে পড়েন যাত্রীরা l ছবি: প্রথম আলো
কল্যাণপুর থেকে যাত্রাবাড়ী: কল্যাণপুর থেকে চলতে শুরু করা ২২/এ নম্বর রুটের মিনিবাসটি শ্যামলী, শিশুমেলা, কলেজগেট, আসাদগেট—সব স্থানে থেমেছে। দু-একজন যাত্রী নামার বিপরীতে ওঠার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন কয়েকজন। সংকেত, যানজটে আটকে থাকার পরও যাত্রীতে পূর্ণ মিনিবাসটি সব জায়গায় থেমেছে তিন থেকে পাঁচ মিনিট পর্যন্ত। এ সময়ে প্রাণান্ত চেষ্টায় কষ্টকর যাত্রায় শামিল হয়েছেন কয়েকজন। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর মাঝামাঝি এসে চালক ইঞ্জিন বন্ধ করে দেন। কারণ, সামনে আটকে থাকা যানবাহনের দীর্ঘ সারি। ফার্মগেটের খামারবাড়ী মোড় থেকে সারি দীর্ঘ হতে হতে তখন সেখানে ঠেকেছে। সব বাস-মিনিবাসেই যাত্রীতে ভরপুর। অবস্থা বেগতিক দেখে যাত্রীদের অনেকেই নেমে ফার্মগেটের দিকে হাঁটা শুরু করেন। ফলে কিছুটা ফাঁকা হয় মিনিবাস। প্রতিবেদকের সুযোগ হয় ভেতরে প্রবেশের। সুযোগও হয় বসার। পাখাহীন ভেতরটায় গুমোট অবস্থা। হাঁটু লেগে যাচ্ছিল সামনের আসনে। যানজটের সুযোগে বাসের ভেতরে, জানালার পাশে হাঁকডাক শুরু হয় বাদাম, আমড়া, পপকর্ন, চিপসের হকাররা। কেউ কেউ কিনলেনও।
খেজুরবাগান পার হওয়ার পর আটকা পড়ে খামারবাড়ী সিগন্যালে। এভাবে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, রূপসী বাংলা মোড়, শাহবাগ যেন একেকটি বিভীষিকার নাম। প্রতিটি স্থানে যানজট, যেখানে-সেখানে যাত্রী নামানো-ওঠানো আর ধীরগতির চালনায় কল্যাণপুর থেকে যাত্রাবাড়ী পৌঁছতে সময় লাগল সাড়ে তিন ঘণ্টা। এই পথের এক নিয়মিত বাসযাত্রী জানান, সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে এই পথ যেতে লাগে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা।
যাত্রাবাড়ী থেকে কুড়িল-বিশ্বরোড: যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেট তুরাগ নামের টঙ্গীগামী মিনিবাসে উঠতে তেমন সমস্যা হয়নি। কারণ, এর যাত্রা শুরুই সেখান থেকে। যাত্রাবাড়ীর মেয়র হানিফ উড়ালসড়কের (ফ্লাইওভারের) নিচে চলাচলের জায়গা সংকীর্ণ। এর ওপর বাস-মিনিবাস সারি করে রেখে পথ আরও সংকীর্ণ করা হয়েছে। ফলে ধীরগতির কারণে যানজট লেগেই থাকে। তবে সায়েদাবাদ আসতে না-আসতেই মিনিবাস যাত্রীতে ভরে যায়। জনপথ মোড় থেকে গোলাপবাগ পর্যন্ত রাস্তার বেহাল অবস্থায় এক যাত্রীর সরস মন্তব্য, ‘মাজা ব্যথার ওষুধ কেনার টাকা দিবে কে?’
বাসযাত্রীদের অভিযোগ, সিটিং সার্ভিসের কথা বলে ভাড়া বেশি নেওয়া হচ্ছে, আবার দাঁড়িয়েও যাত্রী নিচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হয় না। বেশির ভাগ যাত্রী এর প্রতিবাদও করেন না। এ বিষয়ে মিনিবাসের চালক-সহকারীর বক্তব্য, ‘রাস্তায় গাড়ি নাই। মানুষ কী করবে। আমরা তো উঠাইতে চাই না। পাবলিক জোর করে ওঠে।’
মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে মিনিবাসে উঠলেন শহীদা বেগম। মহিলা ও শিশুদের জন্য সংরক্ষিত আসনে পুরুষেরা বসে ছিলেন। আসন ফাঁকা করে দিতে বললেও চালকের সহকারী নিরুপায়। সহকারী মো. রাকিব বললেন, ‘মহিলা সিটে ব্যাটারা বইসা থাকে। কইলেও সিট ছাড়ে না। মহিলাগোরে এমন ভিড় গাড়িতে উঠতে মানা করলেও শুনে না।’
যানজট ঠেলে যাত্রাবাড়ী থেকে কুড়িল বিশ্বরোডে পৌঁছতে লাগল তিন ঘণ্টা।
কুড়িল বিশ্বরোড থেকে কারওয়ান বাজার: কুড়িল বিশ্বরোড় থেকে বলাকা পরিবহনের একটি মিনিবাসে মহাখালী আসতে আসতে বিকেল সোয়া চারটা। সেখানে এক সহকর্মীকে পেয়ে কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচার জোগাড় হয়। কারণ, তাঁর সঙ্গে ছিল মোটরসাইকেল। যানজট থাকলেও বাকি পথ পাড়ি দিতে কোনো বেগ পেতে হয়নি।
মোটরসাইকেলে আসার পথে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজারে আবারও কয়েক শ যাত্রীকে বাসের অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। দু-একজন বাসের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে উঠতে না পেরে হাঁপাচ্ছিলেন। মিরপুর ১০ নম্বরগামী বাসে উঠতে ব্যর্থ হওয়া ব্যাংক কর্মকর্তা রফিকুল আলম বললেন, ‘পাবলিক বাস কী জিনিস, তা এর পেছনে না দৌড়ালে বোঝা যায় না। প্রতিদিন একই যুদ্ধ। কিন্তু বাড়ি তো যাওয়া লাগবে। আর এটি তো শুধু ফার্মগেটের নয়, এখন পুরো ঢাকার রোজকার চিত্র।’

No comments

Powered by Blogger.