সুন্দরবন থেকে হরিণ বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা- অবাধ শিকার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না by এরশাদ আলী

সুন্দরবন থেকে হরিণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে! ব্যাপারটা কল্পনা করতে কষ্ট হলেও রূঢ় বাস্তবতা সেটাই বলে আশঙ্কা করছেন সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট এবং বন বিভাগের লোকেরা। অবাধে হরিণ শিকার এবং ট্যুরিস্টদের (ভিআইপি ও সাধারণ) হরিণের গোশত খাবার প্রবণতা দমন করতে না পারলে সুন্দরবন থেকে মহিষ ও গণ্ডারের মতো হরিণ বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। সুন্দরবনের প্রিয়দর্শন জন্তু হরিণ। এই বনে হরিণের সংখ্যা সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে সংখ্যাটা কয়েক লাখ হবে বলে ধারণা করা হয়। এখন এই সংখ্যাও দ্রুত কমে আসছে বলে জানিয়েছেন বন বিভাগ সূত্র ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞরা। হরিণ শিকার বর্তমানে মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়েছে। সব শ্রেণীর মানুষ ইচ্ছেমতো হরিণ শিকার করছে। এক সময় ফাঁস দিয়ে হরিণ ধরা হতো এবং পরে বন্দুক দিয়ে গুলি করা হতো। এখন যোগ হয়েছে জাল পেতে হরিণ ধরা। বন বিভাগ বনের সর্বত্র হরিণ শিকার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা করছে না কেউই। সাম্প্রতিককালে দেশের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি সরকারি ব্যবস্থাপনায় সুন্দরবন ভ্রমণে গেছেন এবং বনের রেস্ট হাউজে রাত যাপন করেছেন। এসব ভ্রমণ হয়েছে অত্যন্ত গোপনে। অনেক ভিআইপিকে আস্ত হরিণ রোস্ট করে রসনা তৃপ্ত করা হয় বলে জানা গেছে।
এ এফ এম আব্দুল জলিল রচিত সুন্দরবনের ইতিহাস বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘কোনো হোমরাচোমরা ব্যক্তি সুন্দরবনে প্রবেশ করলে ডজনখানেক হরিণ শিকার না করিয়া নিরস্ত হন না।’ এখন অবশ্য ভিআইপিরা নিজে শিকারের কষ্ট করেন না। পেশাদার শিকারিদের দিয়ে হরিণ ধরা হয়, ভিআইপিরা শুধু খাওয়ার কষ্টটুকু স্বীকার করেন। ভিআইপিরা একবার হরিণ শিকার করলে তাদের অনুসারীদের জন্য ইচ্ছেমতো শিকার করা হালাল হয়ে যায়। বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, অন্য সরকারি অফিসের ব্যবস্থাপনায় এসব ট্যুর হয়েছে। হরিণ ধরে রোস্ট করার কথা স্বীকার করে তারা বলেন, ‘আমাদের চুপ থাকা ছাড়া উপায় নেই।’ একইভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যারা বনে ট্যুর করতে যান তাদের বেশির ভাগই হরিণের গোশত দিয়ে ভূরিভোজ সেরে তারপর ফেরেন। এ ব্যাপারে ট্যুরিস্টদের সহায়তা করেন বলে অনেক ট্যুর অপারেটরের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি বন বিভাগের কর্মচারীরাও টাকার বিনিময়ে ‘ম্যানেজড’ হন।
সুন্দরবনে শিকার নিষিদ্ধ থাকায় হরিণ শিকারে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয় না। বন্দুকের শব্দে আকৃষ্ট হয়ে বন বিভাগের লোকজন অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে ঝামেলা পাকান। পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় দড়ির ফাঁস। তার সাথে যোগ হয়েছে জাল। বন বিভাগ সূত্র জানায়, ভেটকি মাছ ধরার জাল বলে সেগুলো নিয়ে লোকজন বনে ঢোকে। তারপর বনে সেই জাল পেতে হরিণ তাড়া করা হয়। দল ধরে হরিণ জালে আটকা পড়ে। কটকা, কচিখালী এলাকায় এখন এ পদ্ধতিতে ব্যাপক হরিণ ধরা হচ্ছে। পাথরঘাটা এলাকা থেকে ট্রলারে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কটকা পৌঁছে শিকারিরা হরিণ নিয়ে আবার ফিরে যায়। পাথরঘাটার জ্ঞানপাড়া গ্রাম হরিণ বিকিকিনির অতি পরিচিত স্থান বলে বন বিভাগ সূত্র জানায়। সেখানে অনেক বাড়িতে আন্ডারগ্রাউন্ড কুঠুরি আছে। সেখানে হরিণ রাখা হয়। কেউ গিয়ে কিনতে চাইলে দাম দর ঠিক করে ভূগর্ভস্থ কক্ষ থেকে বের করে দেয়া হয়। পিরোজপুরের অন্য একটি সূত্র থেকেও জ্ঞানপাড়ার হরিণ বিক্রির তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। বন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ‘তিন বছর আগে অফ সিজনে (আগস্ট মাসে) আমি বনের কচিখালীর একটি মাঠে কয়েক লাখ হরিণ দেখেছিলাম। এবারে একই সময়ে গিয়ে আমি আর হরিণ দেখতে পাইনি।’ ব্যাপক শিকারের কারণে হরিণসংখ্যা মারাত্মকভাবে কমেছে বলে তিনি জানান।
এ ছাড়া বনের পাশের অধিবাসীরা সবসময় হরিণ শিকার করে থাকেন। বিশেষ করে কাঠ কাটা, গোলপাতা সংগ্রহ, মাছ ধরা বা মধু সংগ্রহের জন্য যারা বনে যান তাদের হরিণ ধরে খাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। সাতক্ষীরার বনের পাশের পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুল আজিজ এক সময় বাদায় নিয়মিত কাঠ কাটতেন। তার ভাষায়, কয় শ’ হরিণ খাইছি তার হিসেব নেই। দস্যু বাহিনীর লোকজনের খানাপিনা তো হরিণের গোশত আর বনের মাছ দিয়েই চলে। কয়েক দিন আগে খুলনার কয়রা থেকে হরিণের চামড়া উদ্ধার হয়েছে। হরিণের গোশত ও চামড়াসহ প্রায়ই লোকজন আটক হয়। পুবে পাথরঘাটা থেকে পশ্চিমে সাতক্ষীরার বুড়ি গোয়ালিনী পর্যন্ত হরিণের গোশত বিক্রির অনেক নেটওয়ার্ক আছে। খুলনা মহানগরী, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট প্রভৃতি শহরের অনেকেই এসব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে হরিণের গোশত এনে খেয়ে থাকেন।
গণহারে হরিণ শিকারের জন্যে সবচেয়ে বড় সুযোগ হয় দুবলার চরের রাসমেলা অনুষ্ঠানের সময়। মেলায় যাওয়ার নামে সারা দেশ থেকেই হাজার হাজার মানুষ নানা ধরনের নৌযান নিয়ে বনে যান। সেখানে তিন দিন থাকার অনুমতি নিয়ে এসব লোকজন সাত-আট দিন পর্যন্ত বনে অবস্থান করেন এবং ব্যাপক হারে হরিণ নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠেন। হরিণ শিকারিদের ব্যবসায়ের এটা মোক্ষম সময়। বন বিভাগ সূত্রগুলো জানায়, রাসমেলার সময় অন্তত তিন লাখ হরিণের প্রাণ যায়। এবার রাসমেলা ৫ নভেম্বরে প্রথম হবে বলে জানা গেছে। আগে থেকেই হরিণ শিকারি এবং গোশত ভক্ষণে আগ্রহীদের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে হরিণ নিধন বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু সুন্দরবনের ভৌগোলিক বাস্তবতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামর্থ্য তাতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না।
এ ব্যাপারে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক কার্তিক চন্দ্র সরকারের সাথে কথা বলা হয়। তিনি জানান, আমরা কোস্ট গার্ড, র‌্যাব নিয়ে হরিণ শিকার বন্ধের চেষ্টা করছি। তারপরও কিছু হচ্ছে। সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.