কি সিদ্ধান্ত নেবেন খালেদা? by সাজেদুল হক

সিদ্ধান্ত নেয়ার জটিলতায় তিনি বহুবারই পড়েছেন। কখনও তার সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমাণিত হয়েছে কখনও-বা ভুল। নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থাকার কারণে এক সময় পরিচিতি পেয়েছিলেন আপসহীন নেত্রী হিসেবে। তবে ৫ই জানুয়ারির পরের বাংলাদেশ আলাদা। সময় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকেও মুখোমুখি করেছে নতুন বাস্তবতার। গত দুই যুগ ধরে তিনি ছিলেন কখনও প্রধানমন্ত্রী, কখনও-বা বিরোধীদলীয় নেত্রী। প্রটোকল বিহীন বর্তমান জীবনে তার পরিচিতি রাজপথের বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে। যদিও রাজপথে বিএনপির তৎপরতা একেবারেই সীমিত। প্রেস ক্লাব আর শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেই বন্দি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটি। দল গোছানোর কথা বলেছিলেন তিনি। সময় নিচ্ছিলেন প্রস্তুতির। তবে তিনি সময় আর কত পাবেন সে প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছে জোরে-শোরেই। একটি ট্রাস্ট মামলায় তার বিচার কার্যক্রম শেষ করার তৎপরতা চলছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হতে পারে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, দল গোছাতে গিয়েও বারবার হোঁচট খাচ্ছেন তিনি। নীলফামারীর জনসভায় খালেদা জিয়া প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন, সরকার বিরোধী আন্দোলনে সারাদেশে বিএনপি সফল হলেও ঢাকা মহানগর কমিটি ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকা মহানগরে এরই মধ্যে আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। যদিও এ কমিটিরও শীর্ষ এক নেতার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলার অভিযোগ রয়েছে। ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে তৈরি হয়েছে বিদ্রোহ। গত পাঁচ বছরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে তাদের কোন উপস্থিতি লক্ষ্য করা না গেলেও বিএনপি অফিস আর প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ম্যুরাল ভাঙার ক্ষেত্রে তাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। সরকারের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহে ইন্ধনের অভিযোগ আনা হয়েছে। সরকার সুযোগ নেবে তা তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু বিএনপির ভেতর থেকে কেউ খেলছেন কিনা সে প্রশ্নও সামনে এসেছে। বিএনপির অন্য সহযোগী সংগঠনগুলোর পুনর্গঠনও এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আবার নতুন করে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তার সঙ্গে বৈঠকরত ৬৪ নেতা-কর্মীকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ গ্রেপ্তারের মাধ্যমে হয়তো নতুন করে কঠোর বার্তাই দেয়া হয়েছে বিএনপিকে। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা আশা করেছিলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোন গ্রহণযোগ্যতাই পাবে না। আন্তর্জাতিক চাপে আওয়ামী লীগ খুব শিগগিরই নতুন নির্বাচন দেবে বলেও আশান্বিত ছিলেন তারা। এটা সত্য পশ্চিমা দুনিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিগত নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক মনে করেনি। একটি নতুন নির্বাচনের আহ্বানও তাদের পক্ষে ছিল। কিন্তু শুধু লিফ সার্ভিস ছাড়া আন্তর্জাতিক বন্ধুরা বিএনপিকে আর তেমন কিছুই দেয়নি। অন্যদিকে, সরকারের বন্ধুরা ছিল সক্রিয়। সর্বশেষ ভারতে নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় আসাতে আশান্বিত হয় বিএনপি। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের ব্যাপারে নিরপেক্ষ ভূমিকা আশা করে দলটি। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে কংগ্রেস ও বিজেপির নীতি এখন পর্যন্ত অভিন্ন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। সর্বশেষ সিপিএ ও আইপিইউতে বাংলাদেশের বিজয়ের পর স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী এবং সাবের হোসেন চৌধুরীর সংবর্ধনায় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার সন্দীপ চক্রবর্তী বলেছেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে। এ বিজয় শুধু বাংলাদেশের নয়, পুরো উপমহাদেশের।’ যদিও ভারতের সঙ্গে অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বিএনপির যোগাযোগ বেড়েছে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশকে ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতি যখন শ্লথ তখন ঢাকার একটি জানাজা নিয়েও তুমুল আলোচনা চলছে। দৃশ্যত জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে স্বাধীনতাবিরোধী গোলাম আযমের জানাজায় সরকার কোনও বাধাই দেয়নি। হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এ জানাজায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রটেকশন ছিল লক্ষণীয়। ওদিকে, গোলাম আযমের মৃত্যুতে বিএনপি কোন শোক প্রকাশ করেনি। দলটির কোন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা তার জানাজায় অংশও নেননি। এ জানাজার পর সরকার-জামায়াত সমঝোতার গুঞ্জন নতুন করে সামনে এসেছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সমঝোতা ছাড়াও নতুন করে কোন ধরনের অস্থিরতা যেন তৈরি না হয় এ কারণেও সরকার জানাজায় সহযোগিতা দিয়ে থাকতে পারে। তবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব তৈরির বিষয়টি এখন অনেকটাই স্পষ্ট।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সুপ্রিম কোর্টে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দায়ের করা লিভ টু আপিলের শুনানির দিন এগিয়ে আনা হয়েছে। আগে ২৭শে নভেম্বর এ আপিলের শুনানির দিন ধার্য করা হলেও নতুন করে ৬ই নভেম্বর তারিখ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, নিম্ন আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ঠিক করা হয়েছে ৯ই নভেম্বর। আদালতে গিয়ে খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি রক্ষা করতে পারেননি। অন্যদিকে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দৃশ্যত রক্ষণাত্মক কৌশলই অবলম্বন করছেন তিনি। দুর্নীতি দমন কমিশনের এক আইনজীবী জানিয়েছেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খুব দ্রুত রায় ঘোষণার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে একটি সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়া অব্যাহতভাবে আদালতে অনুপস্থিত থাকলে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করা হতে পারে।
দৃশ্যত বিএনপির ভেতরেও একা বেগম খালেদা জিয়া। তার দলের বেশির ভাগ নেতার বিশ্বাসযোগ্যতাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। গুলশানের আলোচনা সরকারের কানে পৌঁছতে সময় লাগছে খুবই কম। এ অবস্থায় নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন বেগম খালেদা জিয়া। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর প্রতিরোধের মুখে আন্দোলনে সক্ষম নেতৃত্ব রয়েছে কিনা তা নিয়ে সর্বোচ্চ সন্দেহ রয়েছে। যে কারণে কর্মসূচি ঘোষণায় দেরি করছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সরকার নতুন নির্বাচনের আয়োজন করবে সে আশায় এখনও বুক বেঁধে রয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। তবে বিএনপি আরও অপেক্ষা করবে না আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবে- সে সিদ্ধান্ত একান্তই বেগম খালেদা জিয়ার। ব্যর্থতা-সফলতারও হিসাবও কষতে হচ্ছে তাকে। তবে শেষ পর্যন্ত কোন একটা সিদ্ধান্ত তাকে নিতেই হবে।

No comments

Powered by Blogger.