সঙ্কুচিত হয়ে আসছে জনশক্তি রপ্তানি by দীন ইসলাম

সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সীমিত হয়ে পড়ছে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির গন্তব্য। নতুন বাজারগুলোয়ও কাঙিক্ষত হারে শ্রমিক পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। এর প্রভাব পড়েছে জনশক্তি রপ্তানিতে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ কম হয়েছে।
রিক্রুটিং ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানালেন, এতদিন মোট জনশক্তি রপ্তানির বেশির ভাগই সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে হতো। এ দুই দেশের ভিসা এখন বন্ধের ফলে জনশক্তি রপ্তানির হার দিন দিন কমছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে কর্মী গেছেন মাত্র ৯৬ হাজার ৬৮ জন। ২০১৩ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৬২৬। আর ২০১২-এর প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয় এক লাখ ৮৬ হাজার ২৮১ জন শ্রমিক। জনশক্তি রপ্তানির গন্তব্য সীমিত হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানালেন, এক দুই বছর আগেও জনশক্তি রপ্তানি সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমান নির্ভর ছিল। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় শ্রম বাজারে অঘোষিত ধস নেমে এসেছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে নতুন বাজার হিসেবে থাইল্যান্ড, ম্যাকাও, হংকং, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, কানাডা, সুইডেন, অ্যাঙ্গোলা, গ্রিস, জর্ডান, ইতালি, সাইপ্রাস, অস্ট্রেলিয়া, সুদান, লাইবেরিয়া, তানজানিয়া, এস্তোনিয়া, আজারবাইজান, নাইজেরিয়া, বতসোয়ানা, সিয়েরালিয়ন, তাইওয়ান, স্পেন, পোল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, চেক রিপাবলিক, বেলজিয়াম, জার্মানি, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি  দেশে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন তারা। গত পাঁচ বছরে এসব দেশে মন্ত্রণালয়ের কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ খরচ করে প্রতিনিধি দল একাধিকবার সফরও করে এসেছে। মন্ত্রণালয়ের দাবি, এসব দেশে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে অনেক দেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ওইসব দেশ বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেবে। কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক জানালেন, দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ শ্রম বাজারগুলো চালু করা যায়নি। উপরন্তু কূটনৈতিক অদক্ষতায় মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি শ্রম বাজার নতুন করে বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া, মানব পাচার আইন, ব্যয় সাশ্রয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী ছাঁটাইয়ের কারণেও জনশক্তি রপ্তানিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে দেশের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতা। অন্যদিকে গত কয়েক বছরের  চেষ্টায় সরকার নতুন যেসব শ্রম বাজার সৃষ্টি করেছে, সেগুলোয়ও বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ কমানো হয়েছে। একেও জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন তারা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ  থেকে সবচেয়ে বেশি জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে। এ সময় প্রায় সব দেশেই জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছিল। ২০০৭ সালে মোট জনশক্তি রপ্তানি হয় ৮ লাখ ৩২ হাজার ৬০৯ জন। ওই বছর আরব আমিরাতে ২ লাখ ২৬ হাজার ৩৯২, সৌদি আরবে ২ লাখ ৪ হাজার ১১২, মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৭৬২ ও সিঙ্গাপুরে যান ৩৮ হাজার জন। ওমান, কাতার, বাহরাইন ও কুয়েতেও ওই বছর উল্লেখযোগ্য জনশক্তি রপ্তানি হয়েছিল। ওই সময় সব শ্রম বাজারেই জনশক্তি রপ্তানিতে  মোটামুটি সমতা ছিল। এরপর ২০০৮ সালে জনশক্তি রপ্তানি সবচেয়ে বেশি হয়। এ বছর ৮ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ জন লোক কাজ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। এ সময় সব শ্রম বাজারেই বাড়তি জনশক্তি রপ্তানির ধারা অব্যাহত ছিল। ওদিকে বাংলাদেশের জন্য শ্রম বাজার হিসেবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে সৌদি আরব। ২০০৯ সাল থেকে দেশটিতে জনশক্তি রপ্তানি আশঙ্কাজনক হারে কমছে। বিএমইটি হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭ সালে সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছিল ২ লাখ ৪১১২ জন। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১ লাখ ৩২ হাজার ১২৪ জনে। তবে ২০০৯ সালে দেশটিতে যান ১৪ হাজার ৬৬৬ জন বাংলাদেশী শ্রমিক। ২০১০ সালে  গেছেন ৭০৬৯ এবং ২০১১ সালে ১৫ হাজার ৩৯ জন। গত তিন বছরে সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানিতে আরও খারাপ অবস্থা। বর্তমানে সৌদি আরবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি জনশক্তি রপ্তানি অব্যাহত রয়েছে। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, বড় শ্রম বাজারগুলোর মন্দা কাটিয়ে তোলার জন্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। সরকারি উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে এসব দেশে জনশক্তি রপ্তানি আবার বাড়ানো সম্ভব হবে। জনশক্তি রপ্তানির গন্তব্য সীমিত হয়ে পড়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএমইটির মহাপরিচালক বেগম শামছুন নাহার জানান, একটি বা দু’টি দেশের ওপর জনশক্তি রপ্তানি নির্ভরশীল থাকে না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি বেশি হচ্ছে। বর্তমানে অনেক নতুন দেশে জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.