অর্থনৈতিক অগ্রগতি

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত যেদিন দুই হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেল, তার আগের দিনই বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার প্রতি বিশ্বব্যাংকের সপ্রশংস মন্তব্য কাকতালীয় মনে হলেও দুইয়ের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত সম্পর্ক রয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, পদ্মা সেতুর জটিলতা বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের সহায়তায় কোনো সমস্যা হবে না। গত কয়েক বছরে সংস্থাটির আর্থিক ঋণ অনেকাংশে বাড়লেও পদ্মা সেতু প্রশ্নটি এখনো আমাদের বিদ্ধ করছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন আটকে যাওয়ায় দেশের বৃহত্তম এই প্রকল্প তো বিলম্বিত হলোই, পাশাপাশি যাদের কারণে এটি ঘটল, তাদের চিহ্নিত না হওয়ার বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ সমীক্ষায় বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে অনেক ইতিবাচক কথা থাকলেও গত বছরের রাজনৈতিক হানাহানিকে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা যে কথাটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, সেটি হলো অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। বিশ্বব্যাংক বলেছে, গত বছরের সহিংস ও ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি থেকে ১ শতাংশ খেয়ে ফেলেছে। যেখানে সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা, সেখানে সেটি ৫ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসবে বলে তাদের ধারণা। একই সঙ্গে তারা এই আশাবাদও ব্যক্ত করেছে যে আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ শতাংশে নেওয়া কঠিন হবে না, যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত থাকায় অর্থনীতির সূচকগুলো যেমন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তেমনি জনগণের মধ্যেও নতুন উদ্দীপনা লক্ষ করা গেছে। ফলে, প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও আমাদের রপ্তানি-আয় ও প্রবাসী-আয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।এর সঙ্গে বিনিয়োগের স্থবিরতা কেটে গেলে দেশের অর্থনীতি প্রকৃতপক্ষে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। কিন্তু এই সম্ভাবনাকে আমরা কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা নির্ভর করছে রাজনীতির গতি-প্রকৃতির ওপর। ভবিষ্যতে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হানাহানি বেড়ে যায়, যদি আমরা হরতাল-অবরোধের যুগে প্রত্যাবর্তন করি, তাহলে অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পূর্বশর্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জোরদার করা। সে ক্ষেত্রে গত ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন কিংবা সংঘাতময় উপজেলা নির্বাচন আদর্শ হতে পারে না। বিরোধী দল সংসদে না থাকলেও তাদের সঙ্গে একটা কর্মসম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। তাদের শান্তিপূর্ণ সভাসমাবেশ পালনেরও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আবার বিরোধী দলেরও উচিত হবে না ইতিহাসের মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তোলা। বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো বিদেশি সংস্থা বলেছে তা-ই নয়, আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই ধ্বংসাত্মক ও বিভেদাত্মক রাজনীতি পরিহার করতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় হরতাল-অবরোধ যেমন পরিত্যাজ্য, তেমনি পরিত্যাজ্য একতরফা এবং বিতর্কিত নির্বাচনও। ক্ষমতাসীন দলটি নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে বসার যে আগ্রহ ব্যক্ত করেছিল, তা থেকে সরে আসা সমীচীন হবে না।

No comments

Powered by Blogger.