অভিনন্দন, বাংলাদেশের মানুষদের by আনিসুল হক

মাত্র চার-পাঁচ মাস আগেও আমরা জানতাম না, আদৌ কি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কিংবা এশিয়া কাপ বাংলাদেশে হতে পারবে? কী সব দিনই না আমরা পার করেছি। লাগাতার অবরোধ— বাসে-ট্রাকে পেট্রলবোমা ছোড়া হচ্ছে, রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে ফেলায় দুর্ঘটনায় পড়ছে ট্রেন। নাগরিকেরা বেঁচে থাকবেন কি থাকবেন না, এই নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, এই দেশে এশিয়া কাপ কিংবা বিশ্ব টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট হবে কি হবে না, সেটা একেবারেই গৌণ প্রশ্ন। সেই বাংলাদেশে মার্চ-এপ্রিলজুড়ে হলো এশিয়া কাপ আর বিশ্বকাপের বড় আসর এবং সুসম্পন্ন হলো কোনো রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই। তারও আগে এল শ্রীলঙ্কা দল, বড় একটা সিরিজ হয়ে গেল বাংলাদেশের সঙ্গে। এসব খেলায় দল হিসেবে মোটেও ভালো করেনি বাংলাদেশ, কিন্তু দারুণ ভালো করেছে আয়োজক, স্বাগতিক হিসেবে। এ জন্য বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য, এ নিয়ে আমরা গৌরব বোধ করতে পারি।

কারওয়ান বাজারের চায়ের ঝুপড়িগুলো বন্ধ। একটা দোকানই খোলা, তা-ও ছোট পরিসরে। সেই চা-বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, অন্য দোকানগুলো গেল কই? দোকানি বললেন, ‘বিশ্বকাপ হচ্ছে তো, সেই জন্য এগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’ আমার মনে পড়ল, ২০১১ সালে বাংলাদেশে ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজনের সময়ও এই চায়ের দোকানগুলো তুলে দেওয়া হয়েছিল ফুটপাত থেকে। একটা বড় আয়োজন যখন করতে হয়, তখন সব মানুষেরই তাতে অবদান, অংশগ্রহণ থাকে। কাজেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, একই সঙ্গে নারী ও পুরুষের, আয়োজন করার মাধ্যমে বাংলাদেশ যে সক্ষমতার পরিচয় দিল, তার কৃতিত্ব দেশের সব নাগরিককেই দিতে হবে। দিতে হবে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া ফুটপাতের ফেরিওয়ালাকেও। অভিনন্দন অবশ্যই প্রাপ্য সরকার ও বিসিবির; আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ ও সংগঠন, প্রশাসন ও সংস্থার। তবে একটা বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য কিন্তু বিরোধী দলেরও, কারণ তারা এই সময়টায় কোনো কর্মসূচি দেয়নি। তারা নিশ্চয়ই দেশের ভাবমূর্তির প্রশ্নটাকেই সবার ওপরে স্থান দিয়েছে। চ্যাম্পিয়ন ট্রফি হাতে রিকশায় বসে আছেন শ্রীলঙ্কা পুরুষ দলের অধিনায়ক লাসিথ মালিঙ্গা কিংবা অস্ট্রেলিয়া নারী দলের অধিনায়ক মেগ ল্যানিং—এই দৃশ্য নিশ্চয়ই বাংলাদেশের একটা বড় বিজ্ঞাপনও।
সব দেশই এ রকম বড় আয়োজনের স্বাগতিক হতে চায়। অলিম্পিক কিংবা বিশ্বকাপ ফুটবল কোথায় হবে, এই নিয়ে তো এক যুগ আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় কূটনৈতিক প্রতিযোগিতা, প্রচারপর্ব, প্রস্তুতি। কারণ, এ ধরনের আয়োজন সারা বিশ্বে দেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তুলে ধরে, পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও স্বাগতিক দেশ লাভবান হয়।
বাংলাদেশের এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সফল, নির্বিঘ্ন, নির্ঝঞ্ঝাট আয়োজন নিঃসন্দেহে শতমুখে অভিনন্দন জানানোর যোগ্য। আমরা নিজেদের মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক ছোটখাটো ভুলত্রুটি নিয়ে আলোচনা করব, করাই উচিত ভবিষ্যতের শিক্ষার জন্য। যেমন এ আর রাহমান আর অ্যাকনের কনসার্টটা কি আদৌ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল? তাহলে সেটা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে ব্যর্থই হয়েছে। আসলে তো সেটা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিলই না। কাজেই সেটাকে সে হিসেবেই দেখতে হবে। এ ধরনের বিশ্ব আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সব দেশই নিজেদের গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্যই তুলে ধরে, আমরা কি একটা সুযোগ হারালাম না?
তবে আরেকটা বড় ধন্যবাদ প্রাপ্য দর্শকদের। বাংলাদেশের দর্শকেরা দলে দলে স্টেডিয়ামে গেছেন, গ্যালারি ভরে তুলেছেন, নিজের দেশের খেলা না থাকলেও গেছেন। নিজের দলের বিরুদ্ধে কেউ সেঞ্চুরি করলেও হাততালি দিয়েছেন। নিজের দেশের খেলোয়াড়েরা হেরে ফিরে আসছেন, তার পরও দর্শকেরা দাঁড়িয়ে তালি দিয়েছেন—‘ওয়েল প্লেইড।’ অন্য দেশের সমর্থকেরা তাঁদের মতো করে সেজে গ্যালারিতে বসেছেন, তাঁদের এ দেশের মানুষ সম্মান দেখিয়েছেন, যত্ন করেছেন। বাংলাদেশ খারাপ করেছে, একটা ঢিলও পড়েনি, একটা কাচও ভাঙেনি। স্বাগতিক হিসেবে এই দেশের দিলদরিয়া মানুষের ঐতিহ্যবাহী আতিথেয়তাই কেবল আমরা প্রদর্শন করেছি।
বাংলাদেশ থেকে যখন কোনো বিদেশি বিদায় নেন, তাঁকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এই দেশের কী তোমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে? উত্তর পাওয়া যায়: এই দেশের মানুষ। এই দেশের মানুষের আন্তরিক আতিথেয়তার কোনো তুলনা নেই। আর এই দেশের মানুষের হার না-মানা জীবনযজ্ঞ। তাঁরা বলেন, কক্সবাজার নয়, এমনকি সুন্দরতম সুন্দরবন নয়, আমাদের মুগ্ধ করে শাঁখারীবাজার। একটা ছোট গলিতে কত কী যে ঘটছে। জীবন এখানে কত প্রাণবন্ত, কত বিচিত্র।
একই সঙ্গে আমাদের বোধ হয় আরেকটা বিষয় নিয়ে গৌরব করতে হবে, স্বাধীনতা দিবসে আমরা অনেকে মিলে একসঙ্গে জাতীয় সংগীত গেয়েছি। আরেকবার, আরেকটা বড় আয়োজনে, সম্ভবত বেইজিং অলিম্পিকের সময়ে, বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংগীত বিষয়ে একটা শীর্ষ তালিকা করা হয়েছিল, তখন পৃথিবীর ১৯০-ঊর্ধ্ব দেশের মধ্যে আমার সোনার বাংলার স্থান হয়েছিল ২ নম্বরে। বলা হয়েছিল, এই সংগীতটায় কোনো হামবড়া কথা নেই, আমার দেশই সেরা বলে অন্ধ অভিমান নেই, আছে নিজের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাব্যময় বর্ণনা আর আছে তাকে ভালোবাসার কথা। সত্যি, আমাদের জাতীয় সংগীতের কথা অনবদ্য, এই গান আমি যতবার গেয়েছি, আপনা-আপনিই আমার চোখ জলে ভিজে উঠেছে। গত ২৬ মার্চ সকালে আমি প্যারেড ময়দানে যেতে পারিনি, কিন্তু দেশ টেলিভিশনের সামনে দাঁড়িয়ে যাই। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আমরা শ খানেক মানুষ একই সময়ে জাতীয় সংগীত গাই গলা খুলে। একই সময়ে বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিরা একত্র হয়ে জাতীয় সংগীত গেয়েছেন। জাতীয় প্যারেড ময়দানের জাতীয় সংগীতে দুই লাখ ৫৪ হাজার ৫৩৭ জন অংশ নিয়েছেন বলে গিনেস রেকর্ড বুকে লেখা থাকছে, কিন্তু এর বাইরেও হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন, যাঁরা ভেতরে ঢুকতে পারেননি। অভিনন্দন বাংলাদেশ, একটা নতুন রেকর্ড গড়ার জন্য। জানি, এই আয়োজন নিয়েও নানা কথা হয়েছে। গিনেস বুকে নাম তোলার দরকারই বা কী, এই বইয়ে তো সবচেয়ে বড় গোঁফওয়ালার নামও থাকে, কতটা সাপের সঙ্গে কে কত বেশিক্ষণ ধরে যাপন করল তা-ও থাকে। তার জন্য এত টাকা খরচ করারই বা দরকার কী! এটা দিয়ে কতগুলো স্কুল হতো বা টিউবওয়েল হতো। কিংবা এত টাকা কেন দরকার হবে, আর তা খরচ করাই বা হলো কীভাবে? ব্লগ-ফেসবুকে এ নিয়ে কথা উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো এই দেশের বাক্স্বাধীনতা ও ব্যক্তি মানুষের মতপ্রকাশের একটা অভূতপূর্ব ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে, এটাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। তবে সব সময় এসব মাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়। যেমন বলা হলো, গিনেস বুকে আমাদের জাতীয় সংগীতের রেকর্ডটা গ্রহণ করা হবে না। আমি বলি, একটু ধৈর্য ধরে থাকলে কী ক্ষতি, কিংবা কোনো মত প্রচারের আগে তথ্যটা যাচাই-বাছাই করে নেওয়া কি উচিত নয়? যা-ই হোক, নাগরিকদের উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়া কিন্তু সরকারের কাজ। আমার মনে হয়, যেকোনো সাংবাদিক তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে জানতে চাইতে পারেন, জাতীয় সংগীত গাইতে কত টাকা উঠল, কীভাবে খরচ করা হলো, বাকি টাকা কীভাবে খরচ করা হবে।
রবীন্দ্রনাথের একটা উক্তির সারমর্ম হলো, মানুষ সাড়ে তিন হাত লম্বা। কিন্তু ঘরটা সে সাড়ে তিন হাত উঁচু করে না, আরও বড় করে। সবাই মিলে জাতীয় সংগীত গাওয়ার জন্য বেসরকারি অনুদান নিলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। এটা অনেক পুরোনো বিতর্ক, যা আমাদের কোনো কাজে লাগে না, এমন জিনিসের চর্চা আমরা করব কি না। এই বিতর্কের বহু আগেই অবসানও ঘটে গেছে। যেমন, কুমড়ো ফুল আমাদের কাজে লাগে, আমরা তা দিয়ে বড়া বানিয়ে খাই, আর গোলাপ ফুল কোনো কাজে লাগে না, তা এমনকি ফল কিংবা বীজও উৎপাদন করতে পারে না। তবু বিশ্বব্যাপী চিরটাকাল গোলাপেরই কদর। কবিতা নিয়েও এই প্রশ্ন আছে, কবিতা কী করতে পারে, তা কি শেয়ারবাজারের দরপতন, স্টেডিয়ামের উইকেট পতন, কিংবা যুদ্ধরত দেশের শিশুদের ওপরে ক্লাস্টার বোমার পতন রোধ করতে পারে?
‘সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে বাঁচা, বিচিত্রভাবে বাঁচা।’ অন্ধকারের বিরুদ্ধে আপনি তরবারি দিয়ে লড়াই করে জিততে পারবেন না, আপনাকে আলো জ্বালাতে হবে। সংস্কৃতির চর্চাই হতে পারে সবচেয়ে বড় আলোর উৎস। আমি তো ভীষণ খুশি যে চার-ছক্কা হই হই নিয়ে নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ার থেকে শুরু করে রংপুরের স্কুলটিতে ফ্লাশমব হয়েছে, সম্ভবত পৃথিবীতে একটা গান নিয়ে এত বেশি ফ্লাশমবের নজির আর নেই। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যদি পারে, সারা দেশে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জোয়ার তৈরি করে দিক। স্কুলে স্কুলে পাড়ায়-মহল্লায় পাঠাগার আন্দোলন, খেলাধুলার আয়োজন আর একটা বড় সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ তৈরি করতে পারলে বহু লড়াইয়ে আপনা-আপনিই জয়লাভ করা সম্ভব হবে।
‘আমার সোনার বাংলা’ সবাই মিলে গাইতে আমার কোনোই আপত্তি নেই, বরং যতবার বলা হবে, ততবারই আমি যেখানে আছি, সেখানে দাঁড়িয়েই আন্তরিকভাবে গাইব, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.