স্বাগত ১৪২১- নব আনন্দে জাগো

পুরনো ভুলে নতুনের আবাহনে পথচলার দিন আজ। আজকের আহ্বান গ্লানি মুছে, ক্লেদ, পাপ, মূঢ়তা কিংবা যা কিছু জীর্ণ-শীর্ণ-দীর্ণ আর যা কিছু পুরনো তাকে পুড়ে ছাই করার। সব পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া সামনের পানে। আজ সেই পহেলা বৈশাখ। গতকালের সূর্যাস্তের পর আজকের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা শুরু আরেকটি বছরের। আজকে রাত পোহানোর সঙ্গে সঙ্গে এলো আহ্বান, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়...’।

বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির নানা আয়োজনে রঙে-বর্ণে, উৎসবে দেশজুড়ে বরণ করা হবে নতুন বছরকে। আবহমান এ বাংলার দিক-দিগন্ত ঔজ্জ্বল্যে ভরিয়ে দিতে; আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিকে অগ্নিস্নানে শুচি করে তুলতে আবার এসেছে বৈশাখ। শুভ নববর্ষ ১৪২১। আর এরই মাধ্যমে কালের আবর্তে হারিয়ে গেল ১৪২০। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- দূরের পলাতক বলাকার ঝাঁকের মতো করে এ হারিয়ে যাওয়া বিগত বছরের। বাঙালির কায়মন আজ প্রার্থনা করবে, জরা-জীর্ণতা মুছে বৈশাখের রুদ্র দহনে পুড়ে ছাই হওয়ার। আবর্জনা দূর করতে গেয়ে উঠবে বাঙালির প্রাণের অনুরণন, এসো হে বৈশাখ এসো এসো...। এ কথামালার স্রোতে বর্ষবরণের উৎসবের আমেজ বেড়ে মুখরিত হবে বাংলার চারদিক। আসবে কালবোশেখ। বিদ্যুৎ-চঞ্চুবিদ্ধ দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে প্রলয়ঙ্করী ঝড় ধেয়ে আসবে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে নগরে-বন্দরে। আঁছড়ে পড়বে বারান্দায়। পহেলা বৈশাখ নিয়ে বাঙালির উৎসব-উদ্দীপনার শেষ নেই। আজকের দিনটাকে উদযাপন করতে কয়েক দিন আগে থেকেই শুরু হয় প্রস্তুতি। আজ ঘটবে সব প্রস্তুতির সমাপ্তি। হবে আনন্দ আয়োজন। হবে উৎসব বর্ষবরণের। সারা দিন আনন্দে কাটাবে সবাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট সকালে বের করবে সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী র‌্যালি। ঐতিহাসিক রমনার বটমূলে হবে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। সারা দিন মুখর থাকবে রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। দেশের প্রত্যেক শহর, গ্রাম-গঞ্জে বাঙালিরা মেতে উঠবে প্রাণের আবাহনে। বসবে মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ এক অন্যরকম দিন। অন্যরকম সর্বজনীনতা। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মেতে উঠবে উৎসবে। রঙ ছিটিয়ে রঙিন করে তুলবে মন ও পরিবেশ।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী জোটনেত্রী খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এ ছাড়া সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদও দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানান। প্রেসিডেন্ট তার বাণীতে বলেন, অতীতের সব গ্লানি ও বিভেদ ভুলে বাংলা নববর্ষ জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমাদের ঐক্য আরও সুদৃঢ় করবে এবং বয়ে আনবে অফুরন্ত আনন্দের বারতা। বাঙালির জীবনে বাংলা নববর্ষের আবেদন চিরন্তন ও সর্বজনীন। ফেলে আসা বছরের সব তমসা দূর হয়ে অনাবিল আলোয় স্নাত হবে আমাদের ব্যক্তিক ও সামষ্টিক ভবিষ্যৎ- এ প্রত্যাশা করি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নববর্ষ সামপ্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও দেশবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি যোগাবে। জরা ও গ্লানি মুছে দিয়ে বাঙালির জীবনে ১৪২১ সন সুখ, সমৃদ্ধি ও অনাবিল আনন্দ বয়ে আনবে।
বাঙালির সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। আমরা নববর্ষকে আবাহন করি প্রাণের স্পন্দনে, গানে-কবিতায়, আবেগের উত্তাপে। পহেলা বৈশাখে বাঙালি সংস্কৃতির এ চর্চা আমাদের জাতিসত্তাকে আরও বিকশিত এবং আমাদের আরও ঐক্যবদ্ধ করবে। খালেদা জিয়া তার বাণীতে বলেন, সুদীর্ঘকাল ধরে নতুন আঙ্গিক, রূপ, বর্ণ ও বৈচিত্র্য নিয়ে জাতির জীবনে বারবার ঘুরে আসে পহেলা বৈশাখ। অনন্তকাল ধরে গড়ে ওঠা আমাদের ভাষা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অহঙ্কারকে বিদেশী আধিপত্যবাদী প্রভুরা খর্ব করার নানা ফন্দি করেছে, কিন্তু সফল হয়নি। ১লা বৈশাখ আমাদের গর্বিত ঐতিহ্যকেই স্মরণ করিয়ে দেয়, এদিন জেগে ওঠে জাতির আত্মপরিচয়। এ বছরের এই দিনে আমি সবার কল্যাণ কামনা করি।
আজ সরকারি ছুটির দিন। জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ সংখ্যা। রেডিও-টেলিভিশনে প্রচার হচ্ছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। সেই সঙ্গে আছে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নানা আয়োজন, ব্যবসায়ীদের হালখাতাও। তবে পান্তা-ইলিশ খেতে ভুল করেন না অনেকেই। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বর্ষবরণ উৎসবটি অনুষ্ঠিত হবে রাজধানীর রমনার বটমূলে। এটি প্রায় ৫০ বছর ধরে আয়োজন করে আসছে দেশের শীর্ষস্থানীয় সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। কৃষির সঙ্গে বাংলা নববর্ষের ঘনিষ্ঠতা জড়িয়ে আছে এ সন প্রবর্তনের সূচনা থেকেই। মোগল সম্রাট আকবর প্রচলন করেন বাংলা সনের। এর আগে মোগল বাদশাহরা রাজকাজে ও নথিপত্রে ব্যবহার করতেন হিজরি সন। হিজরি চান্দ্র বছর, যা ন্যূনধিক ৩৫৪ দিনে পূর্ণ হয়। কিন্তু সৌর বছর পূর্ণ হয় ন্যূনধিক ৩৬৫ দিনে। বছরে প্রায় ১১ দিনের পার্থক্য হওয়ায় হিজরি সন আবর্তিত হয় এবং ৩৩ বছরের মাথায় সৌর বছরের তুলনায় এক বছর বৃদ্ধি পায়। কৃষকের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতে হলে সারা দেশে একটি অভিন্ন সৌর বছরের প্রয়োজন। আর এ ধারণা থেকেই সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তা কার্যকর হয় তার সিংহাসন আরোহণের সময় অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ই নভেম্বর থেকে। আকবরের নবরত্ন সভার আমির ফতেউল্লাহ খান সিরাজী বাংলা সন প্রবর্তনের কাজটি সম্পন্ন করেন। প্রথমে এর নাম ছিল ফসলি সন। পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। বৈশাখ নামটি নেয়া হয়েছিল নক্ষত্র বিশাখার নাম থেকে। আর সেই থেকে ক্রমান্বয়ে নববর্ষের ব্যাপ্তি আরও বিস্তৃত হয়েছে। এখন এটি রূপান্তর হয়েছে বাঙালি লোকজ উৎসবে। কালের বিবর্তনে নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরনো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে, আবার সংযোগ ঘটেছে অনেক নতুন উৎসবেরও। বাংলা সন। বৈশাখ। এ দু’টির সঙ্গে হালখাতা জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য হয়ে। তবে মজার ব্যাপার হলো, পুরনো এ ‘হালখাতা’র ঐতিহ্য এখন খুব কমই দেখা যায়। যদিও অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়। তবে তা কম। পুরান ঢাকা আর ব্যবসায়িক লোকের কাছে এখনও জীবিত আছে। বিশেষ করে আড়তদারদের কাছে এখনও হালখাতা গুরুত্ব বহন করছে নানা কারণে। বৈশাখে আজ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হবে সেই হালখাতা। মিষ্টিমুখ করানো হবে ক্রেতাদের।
প্রস্তুতি শেষ: বরণের পালা
রাজধানীতে বর্ষবরণকে ঘিরে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। দিনটিকে নির্বিঘ্নে উদযাপন করতে শহরজুড়ে নেয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা। রমনা উদ্যানসহ বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। রমনা বটমূলে মূলমঞ্চ তৈরির কাজ শেষ হয়েছে গতকালই। মঙ্গল শোভাযাত্রার সব প্রস্তুতিও শেষ হয়েছে এদিন।
বিকালে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নববর্ষের শুভেচ্ছাসংবলিত ফেস্টুনে ছেয়ে ফেলা হয়েছে রমনা উদ্যান। বটতলায় তৈরি করা হয়েছে পহেলা বৈশাখের মূলমঞ্চ। ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত পরিবেশনা থাকবে এখানে। মূলমঞ্চ ছাড়াও বেশ কয়েকটি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। নববর্ষকে ঘিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে নবরূপে সাজানো হয়েছে। এখানে উন্মুক্ত অনুষ্ঠান পরিবেশনা ছাড়াও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বর, হাকিম চত্বর, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ও চলবে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। নিরাপত্তার স্বার্থে রমনাপার্কে বিকাল ৫টা এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সন্ধ্যা ৬টার পর থাকা যাবে না বলে নির্দেশনা জারি করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। ক্যাম্পাসের প্রবেশপথসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো রাস্তায় আঁকা হয়েছে বৈশাখের আলপনা। সকাল থেকে শুরু হয়ে সারা দিনই চলবে নানা অনুষ্ঠান। বাংলা একাডেমি বর্ষবরণের সব প্রস্তুতি শেষ করেছে। একইভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সকালে বেলুন উড়িয়ে নববর্ষ উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করবে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক ও নানা অনুষ্ঠানের মধ্যমে বর্ষবরণ করবে।

No comments

Powered by Blogger.