গণজাগরণ মঞ্চের প্রয়োজন শেষ, তাই- by কাজল ঘোষ

রাজনীতি এখন ব্যাকফুটে। মামলা আর দলীয় কোন্দলে কোণঠাসা বিএনপি। লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে জাপা’য় চলছে সরকারিকরণ। অনেকটাই কৌশলী অবস্থানে জামায়াত-হেফাজত। ঠিক এই সময় গণজাগরণ মঞ্চ আলোচনায়। প্রথমে ছাত্রলীগ আর গণজাগরণ পাল্টাপাল্টি। তারপর বামপন্থি পাঁচ ছাত্র সংগঠনের সংবাদ সম্মেলন। মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর দাবি। অর্থ পাচারের অভিযোগে তদন্ত কমিটি। সবশেষ শনিবার একাংশের পক্ষে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ইমরানকে অব্যাহতি। এ নিয়ে গত কিছুদিন থেকেই ফেসবুক, টুইটার আর ব্লগে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। একদিকে যুদ্ধাপরাধ বিচারে ধীরগতি, অন্যদিকে জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সমঝোতার বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে চলছে ব্যাপক আলোচনা। ভবিষ্যতে যুদ্ধাপরাধ বিচার ও জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক- এই দু’টি ইস্যুতে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে গণজাগরণ মঞ্চ। তখন সাধারণ মানুষ আবারও শাহবাগ চত্বরে দাঁড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারের দ্বৈত চরিত্র প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ও রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ চিন্তা থেকেই মঞ্চকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চলছে। সবশেষ ৫ জন সংগঠকের আয়োজনে আওয়ামী লীগের প্রচার কমিটির সদস্য কামাল পাশা চৌধুরী মঞ্চের মুখপাত্রের পদ থেকে ইমরান এইচ সরকারকে অব্যাহতি দেন। এর আগে ছাত্রলীগও ইমরানের বিরুদ্ধে অর্থ জালিয়াতির অভিযোগ আনে। সমমনা এই দু’টি গ্রুপের ইমরান বিরোধিতায় চাউর আছে- সরকার প্রয়োজনে এই সংগঠনকে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দিলেও সামনের দিনে তা সরকারের নকশা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর এ কারণেই বর্তমানে গণজাগরণকে খ- খ- করে অধিকতর দুর্বল করে দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে গণজাগরণের জোয়ারে যে সব সরকার সমর্থিত বুদ্ধিজীবী মঞ্চের প্রথম সারিতে গিয়ে মাইক বাগিয়ে নিয়েছেন তারাই এখন সঙ্কটকালে নীরবতা অবলম্বন করছেন। এটাও বড় রকমের রহস্য। তবে একটি সূত্রে জানা গেছে, নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইমরান এইচ সরকার। নাসির উদ্দিনইউসুফ বাচ্চুকে সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। নিজে হতে  চেয়েছিলেন সেক্রেটারি। কিন্তু সে প্রস্তাবের রাজি হননি বাচ্চু। গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে যা হচ্ছে তা নতুন কোন কৌশল নয়। এই ইস্যুতে ইতিহাসের  চেনা পথেই হাঁটছে সরকার ও সরকারের অঙ্গ সংগঠন। গণজাগরণ মঞ্চের মতো একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গেও একই আচরণ ছিল আওয়ামী লীগের। মূলত নিয়ন্ত্রণ নিয়েই ছিল নির্মূল কমিটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব। তখন অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরীর নেতৃত্বে পাল্টা সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল। নাম দেয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি। পরে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি মিলে গড়ে তোলা হয়েছিল জাতীয় সমন্বয় কমিটি। গণজাগরণ মঞ্চকে নিয়ে বর্তমানে যে খেলা চলছে তার সঙ্গে অনেকেই পূর্বাপর পরিস্থিতি মিলিয়ে দেখছেন।

ঘটনার পরম্পরায় মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া যাবে। কোথাকার জল কোথায় গড়ালো। মানুষের ভেতরকার সুপ্ত অথচ চিরায়ত চেতনার যে জাগরণ ঘটেছিল শাহবাগে সেই আওয়াজ কি থেমে গেল? শাহবাগের জাগরণ কি শুধুই সময়ের প্রয়োজনে? একটি রায়ের পর আইন সংশোধন আর ফাঁসির রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে যে উদ্দেশ্যে জমায়েত তা কি ফুরিয়েছে? ক্ষমতাসীনরা একাট্টা হয়ে যে আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে ফসল নিজেদের ঘরে তুলেছেন, মধুটুকু খেয়ে ছোবড়াগুলো তারা কি ছুড়ে ফেলে দিতে চাইছেন? না হলে হঠাৎ কেন ছাত্রলীগ সবকিছু ছাপিয়ে গণজাগরণের বিরুদ্ধে মাঠে? কেন এই পাল্টাপাল্টি? যে পুলিশ দিনের পর দিন জাগরণ কর্মীদের নিরাপত্তা দিয়েছে তারাই এখন লাঠিয়ালের ভূমিকায়? তাছাড়া, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা গণজাগরণকে দিনের পর দিন শাহবাগে অবস্থান নিতে যখন পৃষ্ঠপোষকতা করেছে- এখন কি এমন ঘটলো যে গণেশ উল্টে গেল। যে কারণে গণজাগরণকে আর্থিক ও অনৈতিকার অভিযোগে বিভক্ত করা হচ্ছে- যদি এ বিষয়ে অভিযোগ থেকেই থাকে তবে সংগঠনের বাইরে এসে অভিযোগ কেন? কিছুদিন আগে পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছে হেফাজতের নেতৃস্থানীয়দের চাঁদাবাজি আর টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে। এখন সংবাদ আসছে জাগরণ মঞ্চের নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে। পুরো বিষয়টির আদ্যোপান্ত জানার চেষ্টা করছি যারা যুক্ত এই আন্দোলনের সঙ্গে তাদের কাছ থেকেই। টাকা-পয়সা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে ভেতর থেকেই। হয়েছে তদন্ত কমিটিও। ব্লগ আর ফেসবুকে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন দেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল এর প্রমাণ পত্র-পত্রিকা আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া। ৫ই ফেব্রুয়ারির পর বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত আর সুস্পষ্ট গাইডলাইন না থাকায় এবং ধারাবাহিকভাবে রাজপথে অবস্থান নেয়ায় এ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান ছিলেন অনেকেই। আর নেতৃত্ব দখলে নিতে বা বাগিয়ে নিতে ধীরে ধীরে সরকার সমর্থিত মহল ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তা তখনকার মিডিয়ার ফুটেজ দেখলেই লক্ষ্য করা যাবে।
প্রবল গণ-আন্দোলনের চাপে সে সময় বিএনপিও প্রথম দিকে এই আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছিল। অন্তত একটি ইস্যুতে বিচার বিরোধী ছাড়া সকল মহলের ঐক্য আদায়ে শাহবাগের বড় সফলতা ছিল। কিন্তু সে সময় সরকার এককভাবে এই জাগরণের ফসল ছিনিয়ে নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করেছে এটা দিন যতই যাচ্ছে তা স্পষ্ট হচ্ছে। না হলে যে ছাত্রলীগ তার দলবল নিয়ে জাগরণের মঞ্চে সরব থেকেছে তারা এখন পিছিয়ে কেন? বা আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করা ছাত্র  নেতারা আজ জাগরণ মঞ্চ নিয়েই পত্র-পত্রিকায় ভিন্ন কথা ছড়াচ্ছেন কেন? তবে সরকার সমর্থিতরা যখনই তাদের বিরুদ্ধে কোন কর্মসূচি দেয়া হবে তারা ক্ষেপবেন এটাই স্বাভাবিক। কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল অরাজনৈতিক শ্রেণী-পেশার মানুষ- তারা তো আড়ালে সরকারের জামায়াতের সঙ্গে আঁতাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতের যে জয় এবং তা দিয়ে সরকারের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে জায়েজ করার মধ্য দিয়ে নতুন কোন খেলা চলছে না তো! অনেকে বলছেন সরকার-জামায়াত গোপন সমঝোতা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন আগামীতে আবারও শাহবাগ জেগে উঠতে পারে। আবারও আন্দোলনের জোয়ারে এগিয়ে যেতে পারে। আর যখন বিরোধী দল তাদের ক্ষমতায় যাওয়া আর সরকার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার খেয়ালে ব্যস্ত সে সময় ওই আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সরকারের নীলনকশা। স্বতঃস্ফূর্ত এ ধরনের গণ-আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কি? উত্তর মিলবে ইতিহাসেই। চীনের থিয়েন আন মেন চত্বর, মস্কোর লাল চত্বর, মিশরের তাহরির চত্বর, তিউনিসিয়ার হাবিব বরগুইবা চত্বর, তুরস্কের তাকসিম চত্বর, নিউ ইয়র্কের জর্জিয়া, ইউক্রেন যুকোতি পার্ক চত্বর আর সবশেষ শাহবাগ চত্বর। দেখা গেছে, এ ধরনের আন্দোলন বরাবরই হয়ে থাকে স্বতঃস্ফূর্ত। এর কোন  নেতা থাকেন না। থাকে না বড় রকমের নেতৃত্বও। বিক্ষুব্ধ, অসংগঠিত জনগোষ্ঠীই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিবাদ জানাতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ ধরনের আন্দোলন বহন করে যুগসন্ধির ইঙ্গিতও। কালে কালে তা বীজ রোপণ করে ভবিষ্যতেরও। কাজেই সময়ের প্রয়োজনে ইতিহাসের ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বা ইতিহাসের নবতর চেতনার বাস্তবায়নে এ ধরনের জাগরণ আবারও হতে পারে এটা বললে অত্যুক্তি হবে না।
গত ৫ই এপ্রিল শাপলায় হেফাজতের উত্থান আমাদের নানাভাবে ভাবিয়েছিল। রাজনীতির গতি-প্রকৃতিতে কি পরিবর্তন আসে আগামীতে। বাস্তবতা হচ্ছে তা হয়নি। নিজেদের গ্রুপিং আর টাকা পয়সার ভাগ-বাটোয়ারায় আজ হেফাজত অনেকটাই তেজ হারাতে বসেছে। নৈতিকভাবেও দুর্বল হয়েছে। এর আগে ৫ই ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে নবজাগরণ ঘটেছিল শাহবাগে। দেশবাসী একাত্ম হয়েছিল সেই মিছিলে। যারা ক্ষমতার বাইরে থেকে দেশকে ভালবাসেন, দেশের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন সেসব মানুষ আশাবাদী হয়েছিল। প্রচলিত ঘুনেধরা নষ্ট হয়ে যাওয়া রাজনীতির বিরুদ্ধে এ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের জাগরণ। ব্লগ, ফেসবুক বা টুইটারে ঘটেছিল সেই চেতনার বিস্ফোরণ। কিন্তু সেই জাগরণ নিয়েও নানা গ্রুপিং আর আর্থিক অনিয়মের কথা এসেছে। বর্তমান বিতর্কের প্রেক্ষাপটে গণজাগরণ আর ইমরান এইচ সরকারকে নিয়ে অনেকে ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ইমরান এইচ সরকারের ওপর খাপ্পা অনেকে। কেউ বলছেন, ব্যাটা বেকুব! আন্দোলনটা আরও আগেই সম্মানজনকভাবে শেষ করে ফেলতে পারতো! আয়োডিনের অভাব!
কেউ বলছেন, ব্যাটা বদ! গোপনে টাকা খেয়েছে!
ভাই, ইমরানের ওপর রাগ তো ইমরানকে নিয়ে কথা বলেন। তাকে নিয়ে মুক্ত মনে আপনার মতামত প্রকাশ করেন। কোন সমস্যা নেই। কিন্তু ‘গজামঞ্চ’ বলে গণজাগরণ মঞ্চকে নিয়ে যখন ভেঙানো শুরু করেন, তখন আপনাকে আর চিনতে বাকি থাকে না!
আমি জানি, গণজাগরণ মঞ্চে আপনি যাননি, সেটা যে আপনার একটা ঐতিহাসিক সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল, সেটা প্রমাণ করতে আপনি এখন  দিবারাত্রি লেগে আছেন। ‘দেখছস আগেই কইছিলাম এমন হইব, এর লাইগা যাই নাই’  এইটা হচ্ছে আপনার সেই লেগে থাকার মতো।
অথবা আপনি গেছিলেন, কিন্তু মাইক্রোফোনের ভাগ পাননি। আপনি যে কত বড় একটা ব্যক্তিত্ব, এটা জাতিকে বোঝানোর কোন সুযোগই আপনাকে দেয়া হয়নি! মাইক্রোফোন-বঞ্চিত হয়ে চোখ মুখ কুঁচকে একটা ম্যাক্রো-আন্দোলনে লেগেই পড়েছেন, গজামঞ্চ কি কুৎসিত খারাপ জঘন্য একটা জিনিস এটা জাতিকে বুঝিয়েই ছাড়বেন!
কি অদ্ভুত আপনার মানসিকতা! লাখ লাখ মানুষের প্রতিবাদের তুমুল রূপটা আপনার চোখে পড়লো না! এই ‘গজামঞ্চ’ বলে যে আপনি কাদেরকে অপমান করলেন তা আপনিও জানেন না।
অবশ্য আপনাকে এসব কথা বলা বৃথা। এসব জেনে বুঝেই হাওয়া সমঝে আপনি গজামঞ্চ গজামঞ্চ বলে হাউকাউ করছেন!
ভয় নেই। আপনাকে জামায়াত-শিবির ট্যাগ করবো না। সুশীল বলেও গাল দেবো না। আপনি নিজেই ভেবে দেখেন আপনি কি। সম্ভবত ওই  ট্যাগগুলোর চেয়ে আরও খারাপ কিছু আপনি!
সময়ের প্রয়োজনে গণজাগরণ প্রশ্নে সরকার আবার কৌশল পরিবর্তন করবে কিনা তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে নেপথ্যের সমঝোতায় বিএনপির জঙ্গি সম্পৃক্ততার কার্ড সরকারের গলায় ঝুলবে এটা বলাই যায়। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সরকারের চরিত্রও বদলে যেতে পারে বিশ্লেষকরা এমনটাই ধারণা করছেন।

No comments

Powered by Blogger.