সিলেট সেফ হোম-২, কারও কেউ নয় কি ওরা?

সিলেটের বাগবাড়িস্থ মহিলা ও শিশু কিশোরী হেফাজতিদের নিরাপদ আবাসন বা সেফ হোমে প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসেন সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে। ডাক পড়ে নিবাসীদের। তবে কারও কারও ডাক কখনোই পড়ে না। কেউ আসে না তাদের সঙ্গে দেখা করতে। দেখা করার কেউ থাকলে তাদের এ সেফহোমেই থাকতে হতো না। কেউ নেই, কোনও পরিচয় নেই তাদের। এমনকি কারওবা নামও নেই। সেফ হোমের দেয়া নামেই তারা পরিচিত হয়। তবুও সেফহোমে কোন সাক্ষাৎপ্রার্থী এলে উঁকিঝুঁকি দেয়ার চেষ্টা করে তারা। যদি কেউ তাদের চিনতে পারে। যদি কেউ চিনে নিয়ে বার্তা পৌঁছে দিতে পারে স্বজনদের কাছে। সেফ হোম ছেড়ে মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার তাদের স্বপ্ন ধাক্কা খায় কর্তব্যরত আনসারদের ধমকে। যার ডাক পড়ে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ‘নিরাপত্তা’র খাতিরে গেটের কাছে ভিড়তে দেয় না তারা।

সেফ হোমের নিবাসীদের মাঝে তার কোন নাম নেই। অথচ বয়সের খাতায় কম হলেও ১৯টি বছর জমা পড়েছে। এতদিনেও নিজের কোন পরিচিতি হয়ে উঠেনি। বাড়ি কোথায় তার, বাবা কে, কে মা কিছুই জানা নেই। ভাল-মন্দের বোধও নেই তার। ৬ বছর ধরে আছেন সিলেট সেফ হোমে। সেফ হোমের নিবাসী ও সংশ্লিষ্টরা তাকে মামা নামেই ডাকেন। শুধু মামা নয় নাম-পরিচয়হীন আরও অনেকেরই বাস এ সেফ হোমে। সেফ হোম থেকেই তাদের কারও কারও নাম দেয়া হয়েছে। নাম পরিচয়হীন এসব কিশোর-কিশোরীর বোঝা মনে করছে সিলেট সেফ হোমও। নির্ধারিত আসনের চেয়ে নিবাসীর সংখ্যা কম থাকলেও নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে এদের অন্যত্র স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। পরিচয়হীন এসব নিবাসীর বেশিরভাগই সিলেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার হয়েছে। সিলেট সেফ হোমে থাকলে কোন না কোন উপায়ে হয়তো তাদের খবর স্বজনদের কাছে পৌঁছতে পারত। কিন্তু স্থানান্তরিত হলে স্বজনদের কাছে ফিরে যাওয়ার শেষ আশাটুকু একেবারেই নিভে যাবে। ২০০৮ সালের ৮ই জুন সিলেটের বালাগঞ্জ থেকে উদ্ধার হয় প্রায় ১১ বছর বয়সী এক শিশু। কে সে, বাড়ি কোথায় কিছুই জানা যায়নি। নিজে থেকে বলবে এমন বোধও নেই তার। পরিচয় না পেয়ে সিলেটের সেফ হোমে পাঠিয়ে দেয়া হয় শিশুটিকে। পরদিন থেকেই সে এ সেফ হোমের বাসিন্দা। নামহীন এ শিশুটিকেই সবাই মামা নামে ডাকতে শুরু করেন। ১১ বছর বয়সী মান্নার নাম পরিচয় জানা আছে। বাড়ি সিলেটের জৈন্তাপুরের শ্রীগুচ্ছ গ্রামে। পিতা নজরুল ইসলাম মারা গেছেন। মায়ের বিয়ে হয়ে গেছে অন্য জায়গায়। আত্মীয়স্বজন কেউই খোঁজ নেয়নি। তাই তারও ঠিকানা সেফ হোম। সিলেটের আম্বরখানা থেকে উদ্ধার হওয়া শিশু মান্না গত বছরের ৩রা ডিসেম্বর থেকে সেফহোমে আছে। ঠিকানাহীন ১৬ বছর বয়সী শাহিন ২০০১ সালের ১৭ আগস্ট থেকে সিলেট সেফ হোমে আছে। আগের দিন সিলেটের কানাইঘাট থেকে উদ্ধার হয় সে। ঠিকানা পরিচয় না পাওয়ায় ৫ বছর বয়সী মারুফ আহমদ নয়নও এখন সিলেট সেফ হোমের বাসিন্দা। ২০১২ সালের ১৮ই ডিসেম্বর থেকে এখানে আছে সে। এর দু’মাস আগে সিলেটের শাহপরান থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করেছিল। সেফ হোমের বাসিন্দা ১৫ বছরের কালাম আলমের পিতার নাম জানা থাকলেও জানা যায়নি তার বাড়ি কোথায়। ২০০৭ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি সিলেটের বিশ্বনাথ থানা থেকে উদ্ধার হওয়া কালাম পরদিন থেকেই আছে সেফ হোমে। দিরাই থেকে উদ্ধার হওয়া বিপাশা আক্তার মুন্নি ২০১১ সালের ১৯শে অক্টোবর থেকে আছে সেফহোমে। শুধু তথ্য পাওয়া গেছে তার পিতার নাম জামাল আর মায়ের নাম রুনা। ২০০৮ সালে ২৯শে সেপ্টেম্বর থেকে নয়নতারার পরিচয় সেফ হোমের নিবাসী হিসেবে। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী চম্পা সেফ হোমে আছে ২০০৭ সালের ১৯শে নভেম্বর থেকে। পরিচয়হীন এসব শিশুর সংখ্যা কমাতে চাইছে সিলেটের সেফ হোম। নিরাপত্তার অজুহাতে ৫ কিশোরকে অন্যত্র বদলির চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে মামা, শাহীন ও কালামকে ময়মনসিংহের ত্রিশালে ধলা সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে এবং মান্না ও নয়নকে গাজীপুরের টঙ্গি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে স্থানান্তরের প্রস্তাব করা হয়েছে। মহিলা ও শিশু কিশোরী হেফাজতীদের নিরাপদ আবাসন সিলেটের উপ তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে থাকা সমাজসেবা কর্মকর্তা (নিবন্ধন) নিবাস রঞ্জন দাশ মানবজমিনকে বলেন, আমরা পরিচয়হীন শিশুদের তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় সম্ভব হয়নি তা। নিবাসীদের স্থানান্তর প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, মেয়েদের সঙ্গে একই ভবনে ছেলেদের রাখাটা নিরাপদ নয়। নিরাপত্তার স্বার্থে বেশি বয়সীদের অন্যত্র সরানো প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.