সব পক্ষেরই চাই আত্মবিশ্লেষণ by হাসান মামুন

নির্বাচনটা যেভাবে হয়ে যাচ্ছে, তাতে সরকারপক্ষও খুশি মনে হয় না। সরকারের একাধিক সিনিয়র সদস্য মাঝে এমনভাবে বলেছিলেন, যেন 'নিয়ম রক্ষার' একটা নির্বাচনই করছেন তারা। তখন অবশ্য সহিংস আন্দোলন চলছিল জোরেশোরে। দেশের বেশ কিছু অঞ্চল প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। সে পরিস্থিতি এখন নেই বললেই চলে। এর মধ্যে যৌথ বাহিনী নামানো হয়েছে। সহিংস আন্দোলনকারীদের প্রতি তাদের কঠোর মনোভাব লক্ষণীয়। অন্যান্য কারণেও 'আন্দোলন' দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এ প্রেক্ষাপটে সরকারের মধ্যেও আস্থা বেড়েছে নির্বাচনটা সম্পন্ন করে ফেলার বিষয়ে। ওইসব নেতাও এখন আর বলছেন না_ নির্বাচন করতে হচ্ছে বলেই করা। প্রধানমন্ত্রীর মনোভাবও তারা বুঝতে পেরেছেন ইতিমধ্যে। তিনি তো খোলাখুলি বলেছেন, মাঠে প্রতিপক্ষ না থাকলে গোল হবেই। বৃহস্পতিবার রেডিও-টিভিতে রাখা বক্তৃতায়ও তিনি বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন। তার ভাষায়, সর্বোচ্চ ছাড় দিতে চাইলেও তারা আসেননি। সংলাপ ছেড়ে সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছেন বিরোধী নেত্রী_ এটাই তার অভিমত।
এ দেশে সংঘাত ছাড়া কখনও আন্দোলন হয়েছে বলা যাবে না। সরকারও পুলিশ দিয়ে আন্দোলন দমাতে চেয়েছে বরাবর। মোটা দাগে এটাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এখান থেকে বেরোতেও চায়নি কেউ। তবে সাম্প্রতিককালে এটা চরমে পেঁৗছে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সে জন্য সরকারকেই বেশি দায়ী করা হচ্ছে। এর প্রতিবাদে যে ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলা হলো, সেটাও কাম্য ছিল না। এটি কারও ধারণায় ছিল বলেও মনে হচ্ছে না। বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতার বক্তব্যে মনে হয়, তারাও প্রস্তুত ছিলেন না এ জন্য। 'অস্তিত্ব রক্ষায়' বেপরোয়া জামায়াতে ইসলামী যুক্ত হয়ে পড়াতেই এমনটি ঘটল কিনা, তা খতিয়ে দেখতে হবে। একাডেমিক গবেষণার বিষয় বলেও বিবেচিত হবে এটা।
সরকারবিরোধী আন্দোলনকে চরমপন্থায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আনতে হলো এ জন্য যে, বিরোধী দলের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পর্যন্ত তার একটি নিবন্ধে অবিলম্বে এ সহিংসতা বন্ধের ওপর জোর দিয়েছেন। একই সঙ্গে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচেষ্টা 'দ্বিগুণ' করতে বলেছেন তিনি। সেটি করেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন থামানোর সুযোগ অবশ্য নেই আর। দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের বৃহত্তর অংশও নির্বাচন স্থগিত করে 'অংশগ্রহণমূলক' নির্বাচনের লক্ষ্যে সংলাপ শুরুর ওপর জোর দিয়েছিল মাঝে। প্রধানমন্ত্রী প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমালোচনা করেছেন আপন ভঙ্গিমায়। এতেও বোঝা গিয়েছিল, একতরফাভাবে হলেও নির্বাচনটি করে ফেলতে তিনি বদ্ধপরিকর।
সংবিধান থেকে 'চুল পরিমাণ' ছাড় না দেওয়ার যে কথাও বলেছিলেন, তা এক অর্থে রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী। সংবিধানে 'সর্বদলীয় সরকার' গঠনের কথা নেই নির্বাচনকালে। মন্ত্রিসভা সংকোচনেরও ব্যাপার নেই আসলে। এর সবই প্রধানমন্ত্রীর জন্য অপশন। আমাদের সংবিধান আগে রাষ্ট্রপতি আর পরে প্রধানমন্ত্রীকে 'অসাধারণ ক্ষমতা' দিয়েছে। সুতরাং এ নির্বাচনকালে তিনি যা যা করেছেন, তার সবই ব্যক্তিগত পছন্দে। না করলেও পারতেন। কথা হলো, বিরোধী দলের দাবি এবং সেটি আদায়ে সহিংসতম আন্দোলনের মুখেও তাদের কথামতো তিনি কিছুই করেননি। ভারত ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রায় পুরোটা তার সরকারকে বারবার বলেছে নির্বাচনকে 'অংশগ্রহণমূলক' করতে। আর এটা তো সত্য, প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া সে রকম নির্বাচন অসম্ভব। পরিষ্কারভাবে এটি বোঝার পরও প্রধানমন্ত্রী অনড় থাকলেন তার অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে। এ ক্ষেত্রে এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে ঠিকমতো সামলে উঠতে না পারাটা ভুগিয়েছে অনেক; তারপরও অনড় থেকেছেন তিনি।
অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন, এর মধ্যে 'অসাংবিধানিক' কিছু হয়তো ঘটে যাবে। বিএনপির একাংশও তেমনটি ভেবে বসে ছিল হয়তোবা। সুশীল সমাজেও এমন কিছু কথাবার্তা হচ্ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও তার সহযোগীদের তখনও দেখাচ্ছিল নিশ্চিন্ত। ওয়ান-ইলেভেন ও তৎপরবর্তী ঘটনাধারা বিশ্লেষণ করলে কিন্তু বোঝা যায়, রাজনীতির কিছু চালু সমীকরণ অনেকটাই পাল্টে গেছে। বিএনপির আগেকার ভরসার জায়গাগুলোয় এসেছে পরিবর্তন। আমাদের অর্থনীতি যেমন অনেকটা বিশ্বায়িত এখন; তেমনি আমাদের দেশরক্ষা বাহিনী। এ বিষয়ে সংবিধানে বিশেষ ধারাও যুক্ত হয়েছে। আর তারা তো দেখেছেন, নেপথ্যে থেকেও এ দেশ পরিচালনা সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকরা যতখানি ব্যর্থ, এর পাশাপাশি তাদের সাফল্যও প্রশ্নবিদ্ধ। নিজেদের ক্ষেত্রে, এমনকি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে তারা কিন্তু খুব সফল। এরই মধ্যে গৃহযুদ্ধকবলিত দক্ষিণ সুদানে নিয়োগের জন্য এক ব্যাটালিয়ন বাংলাদেশি সৈন্য চেয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। সশস্ত্র বাহিনীর দৃষ্টি স্বভাবতই সেদিকে। প্রধানমন্ত্রী এটা ভালোই বুঝতে পারেন। বিডিআর বিদ্রোহ-পরবর্তী ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে তিনি এর নেতৃত্বকে ঢেলেও সাজিয়েছেন।
যা হোক, গণতন্ত্রমনা লোকজন চাইব দেশ সাংবিধানিক ধারায় থাকুক। সংবিধানের মধ্যেই অবশ্য নতুন এক প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এ নির্বাচনটি হতে পারত আর তাতে হয়তো অংশ নিত বিএনপি। নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় জামায়াত কোনোমতেই এতে অংশ নিতে পারত না অবশ্য। সে ক্ষেত্রে তারা কি একইভাবে সহিংস আন্দোলন চালিয়ে যেত বিচারে দণ্ডিতদের বাঁচাতে? এর সদুত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন। নির্বাচনে অংশ নিলে আর তাতে জিতে যাওয়ার সুযোগ থাকলে বিএনপি দলটিকে 'শেল্টার' দিত না অন্তত। তাতে বিগড়ে গিয়ে জামায়াতের সংঘবদ্ধ ভোটাররা বিএনপিকে না দিয়ে ভোট কি বর্জন করত? রাজনৈতিক কারণে তারা বিএনপিকেই বেছে নিত বলে মনে হয়। দলটি রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে এলে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ছাড়টুকু অন্তত আদায় করতে চাইত তারা।

এসব আলোচনা এখন নিরর্থক অবশ্য। যে নির্বাচনটি হচ্ছে, তাতে জামায়াত অংশ নিতেই পারছে না আর বিএনপি অংশ নিচ্ছে না। সমস্যা হলো, নির্বাচন ভণ্ডুলও করতে পারছে না তারা। ৫ জানুয়ারি দিনের বেলাটা কোনোমতে পার করতে পারলেই সরকারের হলো। এদিকে নির্বাচন তো অর্ধেকের বেশি হয়ে আছে। এটা কি পরিকল্পিতভাবেই করেনি সরকার? নতুন সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারা নিয়ে রেখেছেন ভোট ছাড়াই। এটা যত নিন্দনীয়ই হোক_ আইনগতভাবে অসিদ্ধ বলা যাবে না। তামাশাপূর্ণ বটে, কিন্তু চ্যালেঞ্জ তো করা যাবে না। বিএনপি যে কোনো মূল্যে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে এত মশগুল ছিল যে, প্রতিপক্ষের ওই কৌশলের দিকে ফিরেও তাকায়নি। আর তার মিত্র জামায়াত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।
সরকার জনপ্রিয়তা হারালেও দেশে তার একাট্টা সমর্থকগোষ্ঠী উবে যায়নি_ এটা ভুলে যাওয়া ঠিক হয়নি বিএনপির। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে তার বেকায়দা অবস্থাও দলটির নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনকে দুর্বল করেছে ভেতর থেকে। বিএনপি নেতারা যখন একে একে কারারুদ্ধ, তখন এর কর্মী-সমর্থকরা সেভাবে নামেনি বিরোধী নেত্রীর ডাকে। বিরামহীন সহিংসতার পর যে 'শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি' তিনি দিলেন_ সরকার দমননীতি চালালেও সেটি এতটা ব্যর্থ হবে কেন? রাষ্ট্রক্ষমতা রক্ষায় কোনো সরকারই দমননীতি চালাতে পিছপা হয়নি। বর্তমান সরকার হয়তো আরও বেপরোয়া। তার বিরুদ্ধে আন্দোলনও তো অনেক সহিংস উপায়ে পরিচালিত হচ্ছিল।
এসব করেও বিরোধী দল যদি সরকারকে টলাতে পারত, তাহলে দেখা যেত তাদের আর তেমন সমালোচনা হচ্ছে না। দুর্ভাগ্যবশত এটাই আমাদের রাজনীতি এবং তা বিচারের ধারা। মার খেয়ে মাঠ ছেড়ে দেয় যারা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের করুণভাবে হেরে যেতে দেখা যায় নির্বাচনগুলোয়। বহু ভোটার 'হারু পার্টিকে' ভোট দিয়ে তা নষ্ট করতে চায় না এ দেশে। আমরা যারা নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছি না, তাদের অন্তত এসব বলা দরকার। এও বলা উচিত, জাতীয় নির্বাচনকালে অনির্বাচিত সরকার রাখার ব্যবস্থাটি তো গণতন্ত্রসম্মত ছিল না। এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে নিশ্চিন্ত থাকাটা উচিত হয়নি। কোনো ভুল রায় তো দেননি সর্বোচ্চ আদালত। কথা হলো, সে প্রেক্ষাপটে রাজনীতিকরা কোনো তরফ থেকেই দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করেননি। নির্বাচন কমিশন ও জনপ্রশাসনের দলনিরপেক্ষতা নিশ্চিত না করেই প্রধানমন্ত্রী সংশোধন করে বসলেন সংবিধান। এ ক্ষেত্রে নিজ দলভুক্ত সংসদীয় কমিটি সদস্যদের মতও গ্রাহ্য করেননি তিনি। তারা আবার সেটা মেনে নিয়েছেন! এদিকে বিএনপি এমন একটি কার্যক্রম থেকেও নিজেকে বিযুক্ত রেখে মুখস্থ বুলি আওড়ে গেছে 'নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই' বলে। অতঃপর দেখা গেল, জামায়াতের সহায়তায় নজিরবিহীন সহিংস আন্দোলন করেও সেটি আদায় করতে পারলেন না তারা। এ প্রশ্নে বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিরাট সমর্থন আর সুশীল সমাজের জোরালো ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও সুবিধা করতে পারল না দলটি। তাদের তো উচিত হবে এ ব্যর্থতা পর্যালোচনা করা।
প্রশ্ন এটিও_ সরকারই-বা কী পাবে এমন একটা নির্বাচন সম্পন্ন করে? আইনগত বৈধতা পেলেও এটি রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। বিশ্ব সম্প্রদায় এমন একটি সরকারকে সমর্থন জুগিয়ে যাবে বলে কি মনে করছে সরকার নিজেও? দেশের ভেতর থেকেও চাপ বাড়বে দ্রুত একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ তথা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের। ভালো যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় ব্যয় হচ্ছে কম। ব্যক্তি খাতে ব্যয়ও। এতে দেশটির ভাবমূর্তি অবশ্য খারাপ হলো। ভয়ানক সহিংসতা আর সরকারের দমননীতির কারণেও নেতিবাচক প্রচার পেলাম আমরা। সবাই দেখল, আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে দ্রুত এগিয়ে চলা এ দেশের রাজনীতিকরা তাদের জায়গাটায় কীরকম ব্যর্থ।
hmamun67@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.