প্রাচীন কঙ্কাল বদলে দেবে ইতিহাস

সম্প্রতি এক শিশুর দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। তিন-চার বছরের এই শিশুকে বৈকাল হ্রদের কাছে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। প্রাগৈতিহাসিক ওই বালকের ডিএনএ থেকে সম্প্র্রতি এমন কিছু তথ্য মিলেছে, যা উত্তর আমেরিকায় মানব অনুপ্রবেশের মূল তত্ত্বের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাস, এশিয়া থেকে আসা মানুষের দল সাইবেরিয়ার এ অঞ্চলে বসতি জমিয়েছিল। তারাই প্রথম বেরিং প্রণালি পার হয়ে আলাস্কা ও কানাডা হয়ে বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র ছেয়ে গিয়েছিল। এখন পর্যন্ত এই তত্ত্বই মেনে নেওয়া হয়। এবার কি তাহলে সেই ধারণা বদলের সময় এসেছে? প্রদীপ সাহাসেই বহু প্রাচীনকালে অর্থাৎ আজ থেকে ২৪ হাজার বছর আগে সাইবেরিয়ার পূর্বে বৈকাল হ্রদের কাছে সমাধিস্থ করা হয়েছিল তিন-চার বছরের এক শিশুকে। প্রাগৈতিহাসিক ওই শিশুর ডিএনএ থেকে সম্প্র্রতি এমন কিছু তথ্য মিলেছে, যা উত্তর আমেরিকায় মানব অনুপ্রবেশের মূল তত্ত্বের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। সাইবেরিয়ার এ অঞ্চলে বহু আগে থেকেই যে আধুনিক মানুষের আগমন ঘটেছিল, তা ১৯৫০-এর দশকের শেষ থেকেই জানা গিয়েছিল। রুশ বিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে তখন থেকেই এ এলাকায় খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। কিছুদিন পরই একটি পাথরের চাঁইয়ের নিচ থেকে পাওয়া যায় বালকটির দেহাবশেষ। বালকটির বয়স ৩ কিংবা ৪। মাথায় হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি একটা মুকুট। গলায় হাড়ের মালা, তাতে অনেকটা পাখির মতো দেখতে একটা পেন্ডেন্ট। সমাহিত দেহটির আশপাশ থেকে পাওয়া গিয়েছিল অন্তত ৩০টি ভেনাস মূর্তি। পুরনো পাথর যুগের শেষ পর্যায়ে তৈরি এমন ভেনাস মূর্তির খোঁজ ইউরোপের প্রায় সব জায়গা থেকেই পাওয়া গেছে।
বালকটির দেহাবশেষ উদ্ধারের পর প্রায় ৫০ বছর ধরে সেটি রাখা ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গের জাদুঘরে। কিছুদিন আগে এই দেহাবশেষের কিছু অংশ নিয়ে পরীক্ষা করার আগ্রহ দেখান ডেনমার্কের কোপেনহেগেন ইউনিভার্সিটির প্রাচীন ডিএনএ বিষয়ক গবেষণা বিশেষজ্ঞ এসকে ভিলারস্লেভ। মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণে জানা গেল, ওই বালকের ডিএনএ 'ইউ' গোত্রের অন্তর্গত। ৪৪ হাজার বছর আগে আধুনিক মানুষের যে গোষ্ঠী ইউরোপে প্রবেশ করেছিল, তাদের দেহে এই গোত্রের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ-ই পাওয়া যায়। কিন্তু অন্য পদ্ধতিতে গবেষণা চালাতেই নতুন করে দেখা গেল এক চমক। তা-ও একবার নয়, পর পর দু'বার। প্রথমত, ২৪ হাজার বছর আগে মারা যাওয়া ওই বালকের ডিএনএর নকশা হুবহু মিলে যায় পশ্চিম ইউরোপীয়দের সঙ্গে। দেহাবশেষের মধ্যে চামড়া বা লোমের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীদের দাবি, জীবিত অবস্থায় ওই বালকের গায়ের রঙ ছিল ফরসা এবং লোম ছিল ইউরোপীয়দের মতো সোনালি বা পিঙ্গল।
প্রচলিত বিশ্বাস, এশিয়া থেকে আসা মানুষের দল সাইবেরিয়ার এ অঞ্চলে বসতি জমিয়েছিল। তারাই প্রথম বেরিং প্রণালি পার হয়ে আলাস্কা ও কানাডা হয়ে বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র ছেয়ে গিয়েছিল। এখন পর্যন্ত এই তত্ত্বই মেনে নেওয়া হয়। এবার কি তাহলে সেই ধারণা বদলের সময় এসেছে? আনুমানিক ১৮ হাজার বছর আগে চতুর্থ তুষার যুগের শেষ অবস্থায় যারা সাইবেরিয়া থেকে উত্তর আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিল, তারা কি আসলে পশ্চিম ইউরোপের বাসিন্দা? তবে নৃতাত্তি্বকরা এত তাড়াতাড়ি ধৈর্য হারাতে নিষেধ করছেন। তাদের আস্তিনে রয়েছে আরও এক চমক। বৈকাল হ্রদের পাড় থেকে খুঁজে পাওয়া বালকের দেহ থেকে মিলেছে আরও এক সংকেত। প্রাচীন ডিএনএ জানান দিচ্ছে, উত্তর আমেরিকায় বসবাসকারী রেড ইন্ডিয়ানদের ডিএনএ নকশার ২৫ শতাংশই মিলে যায় প্রাগৈতিহাসিক ওই বালকের দেহ থেকে পাওয়া ডিএনএ নকশার সঙ্গে।
নৃতাত্তি্বকদের জন্য এটা সত্যিই একটা বিরাট চমক। এই সন্ধান যেন আগের খোঁজকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে। উত্তর আমেরিকার আদি বাসিন্দাদের ডিএনএর সঙ্গে যদি পশ্চিম ইউরোপীয়দের পূর্বপুরুষদের ডিএনএর এমন মিল থাকে, তা হলে এতদিনের জানা ইতিহাস সত্যি সত্যিই বদলে যাবে। মানতে হবে_ এশীয়রা নয়, পশ্চিম ইউরোপীয়রাই প্রথম আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিল। নৃতাত্তি্বকরা এখন এই তত্ত্বের সবদিক খতিয়ে বিচার করতেই ব্যস্ত। এক দল বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, সাইবেরিয়া আর আলাস্কার মাঝে থাকা সরু বেরিনজিয়ান প্রণালি পার করেই আদি মানবরা আমেরিকায় গিয়েছিল। অন্য দলের ধারণা, হেঁটে নয়, পশুচর্মের তৈরি ছোট নৌকায় চেপে দুই মহাদেশের মাঝের কয়েক কিলোমিটার পথ পার হয়েছিল তারা। ১৮ হাজার বছর আগের মহাদেশ পাড়ি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। কিন্তু যে আবিষ্কারে আমেরিকার আদি বাসিন্দাদের ঠিকুজি বা সংক্ষিপ্ত কুষ্ঠি বদলে যেতে চলেছে, তাকে কেমন চোখে দেখছেন বিজ্ঞানীরা? এ ব্যাপারে আমেরিকার উটাহ ইউনিভার্সিটির গবেষক ডেনিস ও'রুরক বলেছেন, 'নৃতত্ত্বের অন্যতম সেরা আবিষ্কার হতে চলেছে এই আবিষ্কার। আর আমরা এই আবিষ্কারে সত্যিই অভিভূত।'
সূত্র :সায়েন্স ডেইলি

No comments

Powered by Blogger.