‘সকলেই সরকারে থাকতে চায়’ by উৎপল রায়
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর সভাপতি অধ্যাপক মোজফ্ফর আহমদ বলেছেন, রাজনীতি জনগণের জন্য হলেও জনগণের জন্য কেউ রাজনীতি করে না।
গণতন্ত্রে কিছু না কিছু ছাড় দিতে হয়। আগে তা হতো। কিন্তু এখন কারও ছাড় দেয়ার মানসিকতা নেই। আর যদি তা না থাকে তাহলে সঙ্কট উত্তরণ হবে না। সমপ্রতি বারিধারার ৪৮ পার্ক রোডের বাসায় মানবজমিনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট ও তা থেকে উত্তরণসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন তিনি। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘নেপথ্য’ (বিদেশী) শক্তি রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক মোজফ্ফর বলেন, আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা ও বিএনপির খালেদা জিয়া ‘নেপথ্য’ শক্তি দিয়ে পরিচালিত হন। এরা নিজেরাও তা জানেন না। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করে তিনি বলেন, দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা চলছে। কেউই সাধারণ জনগণের জন্য বোধগম্য সমাধান দিতে পারছে না। অনেকটা ‘পাটা-পোতায় ঘষাঘষি, মরিচের জান যায়’-এর মতো অবস্থা। যদি রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক বিধিবিধান মেনে চলতো তাহলে এ সঙ্কট হতো না। তারা গণতন্ত্র ও জনগণকে বিশ্বাস করে না। তাছাড়া বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণ বিরোধী দলে না থাকার মানসিকতা। গণতন্ত্রে একজনকে হারতে হয়। কিন্তু তারা কেউই হারবে না। দু’দলের কেউ বিরোধী দলে থাকতে চায় না। সকলেই সরকারে থাকতে চায়, এ ফর্মুলা ত্যাগ করতে হবে। নতুন ফর্মুলা গ্রহণ করতে হবে। সমঝোতায় আসতে হবে। সংলাপ, নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশী ও কূটনৈতিক তৎপরতার কঠোর সমালোচনা করে বাংলাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম এ পুরোধা বলেন, মরণোন্মুখ সমাজব্যবস্থাকে দীর্ঘায়ু করার জন্য, নতজানু সরকার সৃষ্টির জন্য দেশী-বিদেশী সুবিধাভোগীরা তৎপর। তারা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ, ডব্লিউটিএ, এনজিও এবং নানা রকম কোরামিনসহ বিভিন্ন ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও ফন্দিফিকির করছে। অবস্থার প্রেক্ষিতে আমাদের মতো দেশে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন করে ক্ষমতায় যেতে হলে এসব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের অংশীদার হতে হয়। বিদেশী সুবিধাভোগীদের কথা না শুনলে সরকার পরিচালনা ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এজন্য সরকারকে নামে মাত্র গণতন্ত্রের চর্চা করতে বাধ্য করা হয়। আমাদের দেশেও তা-ই চলছে। এ যেন অনেকটা ‘সুতার টানে পুতুল নাচে’র মতো। হরতালের সমালোচনা করে তিনি বলেন, হরতাল এখন ‘ডরতাল’। হরতাল ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। আন্দোলনের শেষ অস্ত্র। কিন্তু এ শেষ অস্ত্র আগেই দিয়ে দেয়া হচ্ছে। যেনতেনভাবে এর অপব্যবহার করা হচ্ছে। এ কারণে হরতালের গুরুত্ব এখন আর আগের মতো নেই। তাছাড়া যারা হরতাল ডাকে, তারা নিজেরাও হরতালে বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। হরতাল ডেকে তারা মাঠে নামে না। ঘরে বসে থাকে। এ ধরনের হরতাল আইন করে বন্ধ করা উচিত। দেশের জনগণ ‘চেইঞ্জ ইজ দ্য টেস্ট’ (পরিবর্তনই স্বাদ)- এ নীতিতে বিশ্বাসী মন্তব্য করে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের একমাত্র জীবিত এ উপদেষ্টা বলেন- তাদের বোঝা, তাদের ভাষা বোঝা রাজনীতির প্রথম পাঠ। জনগণের ভাষা বুঝতেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান। দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ বুঝতে চায় না বোঝে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’। বোঝে দুই দাবি ‘বৈষম্য’ ও ‘গণতন্ত্র’র জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। তারা মনে করে ধর্ম হচ্ছে মাথার তাজ। পবিত্র ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে এনে কলুষিত করা অধার্মিক কাজ। জনগণ একটা অপরাধকে আরেকটা অপরাধের সাফাই হিসেবে সমর্থন করে না। সে কারণে তারা একই চরিত্রের এক দলকে পর পর দু’বার ভোট দিতে চায় না। সুশীল সমাজের সমালোচনা করে ন্যাপ সভাপতি বলেন, ডিগ্রিধারী কুশিক্ষিতদের জনতার কাতারে ফেলা যাবে না। এদের নিয়েই সমাজের তথাকথিত উপরতলা। তাদের থেকেই রাজনীতির নেতৃত্ব আসে। কিন্তু আজ তারা সর্বদিক দিয়ে পচে গেছে। সঙ্কটকালে তাদের পাওয়া যায় না। উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করছে তারা। রাজনৈতিক সঙ্কট কেটে যাবে- এ আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, হতাশার কোন কারণ নেই। সমাধান হবে। দ্রুতই হবে। সমঝোতাও হবে। এজন্য নেতৃত্বে আসার একটি উজ্জ্বল উৎস হতে পারে ছাত্র-যুবক-তরুণ সমাজ। জয় সুনিশ্চিত। ইতিহাস তা-ই বলে।
No comments