১৬ বছর পরও আশার বাণী!
পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের পর ১৬টি বছর পেরিয়ে গেল। চুক্তির সময় যে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, সে এখন কিশোর। সেদিনের শিশুটি আজ দ্ব্যর্থহীনভাবে সরকারের কাছে চুক্তি অবাস্তবায়নের জন্য জবাব চাইতেই পারে! চুক্তি স্বাক্ষরের ষোলো বছর পর গত ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী আবার খাগড়াছড়ি সফরে গেলেন। ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন শান্তিবাহিনীর প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার কাছ থেকে অস্ত্র গ্রহণ করে পার্বত্যবাসীকে যে আশার বাণী শুনিয়েছিলেন, সেই স্টেডিয়ামে ষোলো বছর পর আবারও আশার বাণী শুনিয়ে এলেন। ষোলোটি বছর ধরে পাহাড়ের মানুষ আশার কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে! সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চুক্তির ৭৭টি ধারার মধ্যে ৫৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে দাবি করে আরও বলেন, পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু পার্বত্যবাসীর মনে একটা প্রশ্নই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে—গত ষোলোটি বছরে আসলে কার উন্নয়ন এবং কী উন্নয়ন হয়েছে? কেবল অবকাঠামো উন্নয়নকেই কি পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়ন বলা যাবে? তুলনামূলক বিচারে অবকাঠামোগত উন্নয়নও উল্লেখযোগ্য নয়। সরকারের ভাষায়, ১৯৯৭ সালে ‘ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি’ সম্পাদিত হয়েছে।
কিন্তু গত দেড় দশকে পাহাড়ের মানুষ কি ‘শান্তি’ নামক জিনিসটি স্বস্তি নিয়ে অনুভব করতে পেরেছে? বরং চুক্তির পর একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলায় পাহাড়ের মানুষ সর্বহারা ও বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক হামলার এই মিছিলে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে এ বছরের ৩ আগস্ট খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা থানার তাইন্দংয়ের সহিংস হামলা। এ হামলায় তাইন্দংয়ের কয়েকটি পাহাড়ি গ্রামের কমপক্ষে ৩৭টি বাড়ি সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এবং দুটি বৌদ্ধমন্দিরসহ শতাধিক বাড়িতে লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়। কিন্তু সরকার এ পর্যন্ত ঘরপোড়া এসব মানুষের পুনর্বাসনের জন্য কী পদক্ষেপ নিয়েছে, দেশবাসী কেউ জানে না। পাহাড়ের মূল সমস্যা যে ভূমিবিরোধকে কেন্দ্র করে, সেটি প্রধানমন্ত্রীর অজানা নয়। তাই তিনি সেদিন তাঁর ভাষণে ভূমিহীন পরিবারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসনের কথা বলেছেন। এর পাশাপাশি চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করে সুকৌশলে নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করেছেন। আবার ক্ষমতায় গেলে চুক্তি বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়ে পাহাড়ের মানুষকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন! কিন্তু পাহাড়ের মানুষ বারবার কি বেলতলায় যেতে চাইবে? গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে পাহাড়ের মানুষ আশ্বস্ত হয়েছিল, কিন্তু সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বর্তমান সরকারের আসল রূপ বেরিয়ে পড়ে। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এ দেশের আদিবাসীরা হয়ে গেল ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও চুক্তির মূল বিষয়গুলো হস্তান্তর করা হয়নি, পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনে সংশোধনী প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদন পেলেও সংসদে উত্থাপন না করে পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনকে হিমাগারে পাঠানো হয়েছে। এসব কথা পাহাড়ের মানুষের মনে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে।
নির্বাচন ঘনিয়ে এলে প্রতিটি দলের মধুর কথার ইশতেহারে সাধারণ মানুষ নমনীয় হয়ে ভোটের ফলাফলের নিয়ামক হন। কিন্তু বিগত পাঁচ বছরে পাহাড়ের মানুষের মনে জন্মানো ক্ষত সারাবেন কিসে? খাগড়াছড়িবাসী কি ২০১০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির ঘরপোড়ার জ্বালা ভুলতে পেরেছে, নাকি সাজেকে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত বুদ্ধপুদি চাকমার সন্তানেরা তাদের মায়ের মরা মুখটি মন থেকে মুছে ফেলতে পেরেছে! ২০১১ সালের এপ্রিলে রামগড়-জালিয়াপাড়ার হামলায় আহত মিইপ্রুর রক্তাক্ত মুখখানি যে একবার দেখেছে, সে কি কখনো মিইপ্রুর বিস্ময় ও রক্তমাখা মুখটি কোনো দিন ভুলতে পারবে? নাকি সাম্প্রতিক কালে তাইন্দংয়ের ঘরপোড়া মানুষ তাদের ওপর বয়ে যাওয়া সহিংসতার কথা ভুলতে পারবে, যাদের ঘরে এখনো ধানের গোলার ধান ধুঁকে ধুঁকে জ্বলছে! গুজবকে পুঁজি করে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে রাঙামাটি শহরে তাণ্ডব চালানো হয়েছিল। সেই তাণ্ডবে একজন সরকারি কর্মকর্তা, যিনি পেশায় চিকিৎসক, যাঁর কাছে রোগী পাহাড়ি নাকি বাঙালি, তা কোনো দিনই বিবেচ্য ছিল না, বীভৎস হামলায় সেই চিকিৎসকের একটি চোখ প্রায়ই নষ্ট হতে বসেছে, সে কথা লোকে ভুলবে কীভাবে! নির্বাচনী হাওয়া কি এসব ক্ষতের ওপর মলমের প্রলেপ ছোঁয়াতে পারবে? চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি ফিরে এসেছে— সরকারের এ দাবির অন্তঃসারশূন্যতার প্রমাণ মেলে যখন দেখা যায় চুক্তি মোতাবেক মৌলিক কতগুলো বিষয় যেমন: ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ (স্থানীয়), পর্যটন—এসব বিভাগ সরকার এখনো জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করেনি। চুক্তি অবাস্তবায়নের আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের বীজ ঢুকে পড়া। চুক্তিকে ঘিরে পাহাড়ের মানুষের মধ্যে কিছুটা আশার আলো দেখা দিলেও চুক্তি বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা ও পরিণতিতে তাদের মধ্যে ক্রমে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম নিচ্ছে। তা কারও জন্যই মঙ্গলময় নয়।
ইলিরা দেওয়ান: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, হিল উইমেন্স ফেডারেশন
ইলিরা দেওয়ান: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, হিল উইমেন্স ফেডারেশন
No comments