একমাত্র শেখ হাসিনাই কেন এখন বিএনপির টার্গেট? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা চাইলে স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রকেরও দায়িত্ব নিন, তবু নির্বাচনকালীন সরকারে যোগদান করুন এবং
নির্বাচনে অংশ নিন।’ বিরোধী দলকে সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এরপর তাদের কি উচিত নয় ‘তালগাছটার দাবি’ ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ডাকে
সাড়া দেয়া এবং সন্ত্রাস অবিলম্বে বন্ধ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য এগিয়ে
আসা? নির্বাচন যাতে যথাসম্ভব সুষ্ঠু ও অবাধ হয় তার সর্বাধিক নিশ্চয়তা
বিধানের জন্য তারা সরকারে যোগ দিতে পারেন। তারপরও তারা যদি দেখেন শেখ
হাসিনার কোনো প্রকার হস্তক্ষেপের জন্য নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারছে না, তাহলে
মন্ত্রিত্ব ত্যাগ ও নির্বাচন বর্জনের দরজা তো তাদের সামনে খোলাই থাকবে।
দেশের মানুষকেও তখন তারা এই সত্যটা বোঝাতে পারবেন যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে
গঠিত কোনো সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তখন
দেশের মানুষই তাদের ডাকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেবে। এখনকার
জনসমর্থনবিহীন সন্ত্রাস দ্বারা সাধারণ মানুষের ধিক্কার কুড়াতে হবে না।
বিএনপি ও জামায়াত এখন পর্যন্ত যে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি তার
বড় কারণ, হাসিনা-সরকার তাদের আগের জনপ্রিয়তা হয়তো ধরে রাখতে পারেনি কিন্তু
তাদের অধীনে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব নয়, এ কথাটি জনসাধারণ
এখনও বিশ্বাস করে না। হয়তো বিএনপির নেতানেত্রীরাও মনে মনে বিশ্বাস করেন,
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব।
তার প্রমাণও তারা বিভিন্ন নির্বাচন, উপনির্বাচন ও সিটি কর্পোরেশনের
নির্বাচনে পেয়েছেন। না পেলে সিটি কর্পোরেশনের পাঁচটি নির্বাচনে তারা যেতেন
না এবং জয়ী হতেন না। এখনও তারা জানেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত
নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে যে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তা অবাধ ও
সুষ্ঠু হবে এবং তাতে বিএনপির জয়লাভের সম্ভাবনা ষোল আনা না থাকলেও দশ আনা
রয়েছে।
তবু তারা জেদ ধরেছেন, শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান থাকলে তারা নির্বাচনে যাবেন না, তার একটি বড় কারণ, আমার অনুমান নয়, বিএনপির ঊর্ধ্বতন মহলের ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকেই জেনেছি। কারণটি হল, শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকলে বিএনপি যে ধরনের নির্বাচন-জয় চায় তা পাবে না। শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে এখনও জনপ্রিয়। তিনি সরকারপ্রধান থাকলে বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আওয়ামী লীগ টেনেটুনে নির্বাচনে জয়ী হয়ে যেতে পারে। আর জয়ী না হলে বিএনপি জয় পেতে পারে। কিন্তু নিরংকুশ বিজয়ের অধিকারী হবে না। একটি তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার (সাহাবুদ্দীন-লতিফুর মার্কা) অথবা হাসিনাবিহীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকলে প্রশাসনকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে, ম্যানুপুলেট করে (২০০১ সালের মতো) সংসদে এক-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব বলে মনে করে বিএনপি।
আমার সূত্রের মতে, বিএনপি আগামী নির্বাচনে এই ধরনের ম্যাসিভ ভিক্টরি চায়। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জয়লাভ চায় না। সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেই মাত্র তারা সংবিধান সংশোধন করতে পারবে। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল, তাদের বিচার, দণ্ড সবকিছু বাতিল করে দিতে পারবে। জামায়াতকে শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ ফিরিয়ে দেয়া নয়, দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদেরও আবার ক্ষমতার পার্টনার করা যাবে। পাকিস্তানের মতো সংবিধানে শুধু শরিয়া আইন ঢোকানো নয়, তেতুলতত্ত্বের উদ্গাতা হেফাজতি মাওলানার মধ্যযুগীয় তের দফাকেও রাষ্ট্রের বিধান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর স্বার্থ ও অধিকার চূড়ান্তভাবে খর্ব করা যাবে। সৌদি আরব ও পাকিস্তানকে খুশি করার জন্য বাংলাদেশের আহমদীয়া সম্প্রদায়কে সরকারিভাবে অমুসলমান ঘোষণা করে তাদের ধর্মীয় ও নাগরিক সব অধিকার হরণ করা হবে। তালিকা আরও বড়, সবটা লিখছি না।
আগামী সংসদে ব্রন্টাল মেজরিটি না পেলে, কেবল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে একটি সরকার গঠন করা যাবে; কিন্তু উপরে বর্ণিত উদ্দেশ্যগুলোর কোনোটাই পূরণ করা যাবে না। তাছাড়া সংসদে বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি থাকলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের গণতন্ত্র ও সেক্যুলার দলগুলো এক হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ সংসদের ভেতরে বিএনপি-জামায়াতের সব অপচেষ্টার প্রতিবাদ জানাবে এবং বাইরেও গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দ্বারা তা প্রতিহত করতে চাইবে।
সুতরাং আগামী নির্বাচনে কেবল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিজয় বিএনপির কাম্য নয়। তার কাম্য এক-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে নিরংকুশ বিজয়। যে বিজয় দ্বারা সংবিধান সংশোধন করা যায় এবং সংসদে আওয়ামী লীগের উপস্থিতি একেবারেই অর্থহীন করে দেয়া যায়। কিন্তু বিএনপির ভয় শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকলে তাদের এই উদ্দেশ্য পূরণ কিছুতেই সম্ভব নয়। তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করার জন্য শেখ হাসিনাকে সরকারপ্রধান হিসেবে কোনো প্রভাবই বিস্তার করতে দেয়া হবে না। তার সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলেও বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে তার ইমেজ এবং ব্যক্তিগত ক্যারিশমার ঘাটতি এখনও নেই। এই ইমেজ ও ক্যারিশমার জোরে তিনি আগামী নির্বাচনে সব ঝড়-ঝঞ্ঝার মুখে এই জোটকে জয়ী করে আনতে পারেন।
এখানে জয়ী করতে যদি নাও পারেন, নির্বাচনে বিএনপির জয় সম্ভব, নিরংকুশ বিজয় কিছুতেই সম্ভব হবে না। আর নিরংকুশ বিজয় যে কোনো উপায়ে নিশ্চিত করতে না পারলে বিএনপির উদ্দেশ্য পূরণ সম্ভব নয় এবং নির্বাচনে গিয়েও লাভ নেই। সুতরাং শেখ হাসিনাকে যে কোনোভাবে সরকারের বাইরে রাখার জন্য বিএনপির এই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে না পেরে জামায়াতের সাহায্যে জনজীবনে সন্ত্রাস ও ভীতি সৃষ্টি করে দেশ অচল করা ও সরকারের পতন ঘটানোর জন্য এই পৌনঃপুনিক ব্যর্থ চেষ্টা।
শেখ হাসিনাকে নির্বাচনী সরকারপ্রধান রাখার ব্যাপারে বিএনপির এত এলার্জি কেন, বিএনপির ঊর্ধ্বতন মহলের ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে যেমন আমি তা জানতে পেরেছি, তেমনি জানতে পেরেছেন আমার এক অনুজপ্রতিম সাংবাদিক ও কলামিস্ট বন্ধু মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জুও। অবশ্য এটা তার নিজস্ব বিশ্লেষণও। তিনি তার ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কলামে এই বিশ্লেষণ লিখেছেন এবং টেলিফোন আলাপে আমার সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। মঞ্জুর বিশ্লেষণের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করি।
এখন প্রশ্ন, এত সহিংসতা ও সন্ত্রাস সত্ত্বেও শেখ হাসিনাকে যদি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানের পদ থেকে সরানো না যায়, তাহলে বিএনপি কী করবে? প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তাদের জন্য বড় ধরনের ছাড় ঘোষণার পর তারা নির্বাচনে যোগ দেয়ার জন্য আলোচনার টেবিলে আসবেন, না জামায়াতের সহযোগিতায় এই সন্ত্রাস অব্যাহত রাখবেন? এই সন্ত্রাস যে আরেকটি যুদ্ধাপরাধ তা কি তারা জানেন? ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে গিয়ে বিএনপি যে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধের মতো আরেকটি যুদ্ধাপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, তা কি দলটির নেতানেত্রীরা এখনও উপলব্ধি করছেন না?
’৭১ সালে জামায়াতিরা বাংলাদেশে যে নৃশংস বর্বরতার অনুষ্ঠান করেছে, বর্তমানে ২০১৩ সালে তারা বিএনপির ছাতার আড়ালে সেই একই বর্বরতার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। ’৭১ সালে বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের ঘুমের শয্যা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ঘরে ঘরে অগ্নিসংযোগ, নারী হরণ ও ধর্ষণ করা হয়েছে। অতর্কিত হামলা চালানো হয়েছে নিরীহ মানুষের ওপর, সংখ্যালঘুদের ওপর চলেছে অমানুষিক নির্যাতন। বর্তমানে সেই একই জামায়াত একই হত্যা, নৃশংসতা ও তাণ্ডবের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। তখন তাদের সহযোগী ছিল বিদেশী পাক হানাদাররা; এবার সহযোগী স্বদেশী বিএনপি।
গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোনো সংজ্ঞাতেই এই সন্ত্রাস রাজনৈতিক আন্দোলনের পর্যায়ে পড়ে না। যেমন পড়ে না একাত্তরের হত্যা ও সন্ত্রাস। দুই দেশের মধ্যে ঘোষিত যুদ্ধেও একটি আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলার চেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ বলা হয়, অসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে যেন বোমাবর্ষণ করা না হয়; সিভিলিয়ান যেন হত্যা করা না হয়। রাজনৈতিক আন্দোলনেও লক্ষ্য রাখা হয় নিরীহ সাধারণ মানুষ যেন কোনোভাবে আক্রান্ত না হয়।
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময়েও বঙ্গবন্ধু এই আন্দোলনের নাম দিয়েছিলেন অহিংস আন্দোলন। হরতাল-অবরোধের সময়ও তিনি অ্যাম্বুলেন্স, ছাত্রছাত্রীবাহী বাস, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বহনকারী ট্রাক, ওষুধের দোকান ইত্যাদি হরতালের আওতামুক্ত রেখেছিলেন। কোনো নিরীহ মানুষ যেন আক্রান্ত না হয় সে জন্য তার ছিল আন্দোলনকারীদের প্রতি কঠোর নির্দেশ। দেশের মানুষ তাতে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানিয়েছিল।
বর্তমানে বিএনপি-জামায়াতের এটা কেমন ধরনের আন্দোলন? যেখানে বাসযাত্রী নিরীহ মানুষ, এমনকি চলাচল করছে না এমন বাসেও ঘুমন্ত বালককে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নৃশংসতা দেখানো হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্স আক্রান্ত হচ্ছে, ওষুধের গাড়ি, ধানবোঝাই ট্রাক আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ৩০ লাখ শিশু শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বন্ধ করা হচ্ছে। রেললাইন উপড়ে ফেলে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। শিশুখাদ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দোকান পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। রেহাই পাচ্ছে না বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র।
এটা কি আন্দোলন, না একাত্তরের সমতুল্য যুদ্ধাপরাধ? এই যুদ্ধ তো আসলে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে। হামলার টার্গেট সাধারণ মানুষ। এটা একাত্তরের পুনরাবৃত্তি। সুতরাং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি ২০১৩ সালে জামায়াত কর্তৃক একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। জনগণের সহযোগিতায় কঠোরভাবে এই সন্ত্রাস তথা নতুন যুদ্ধাপরাধ দমনে এগিয়ে যেতে হবে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে। বিএনপি যদি সেই নির্বাচনে না আসে, তাহলে জনগণের কাছে জবাবদিহিতার দায়িত্ব তাদেরই বহন করতে হবে।
বিএনপিকেই এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে সন্ত্রাস বর্জনপূর্বক নির্বাচনে অংশগ্রহণের আলোচনায় আসবেন, না একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সহায়তায় দেশের মানুষের বিরুদ্ধে আরেকটি নৃশংস যুদ্ধাপরাধ ঘটানোর ইতিহাস তৈরি করবেন। জনগণের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধাপরাধের জন্য তারা এখনই যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিবেচিত না হতে পারেন, এমনকি তাদের বিচারও সহসা না হতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের কাছ থেকে তাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। ৪২ বছর পর যদি ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে পারে, তাহলে অনুরূপভাবে আরও ৪০ বছর পর আজকের অপরাধের যে বিচার হবে না তা কে বলতে পারে?
বাংলাদেশের ‘ন্যাশনালিস্টদের’ উচিত ত্রিশের জার্মানির ন্যাশনালিস্টদের পরিণতি (নাৎসি) থেকে শিক্ষা নেয়া। সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে তারা নির্বাচনে আসুন। দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করুন। জামায়াতের সমর্থন ও সন্ত্রাস নয়, জনগণের সমর্থনই তাদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে পারবে। জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ক্ষমতায় আসা যাবে না। শেখ হাসিনা সেখানে থাকবেন অপরাজেয়।
তবু তারা জেদ ধরেছেন, শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান থাকলে তারা নির্বাচনে যাবেন না, তার একটি বড় কারণ, আমার অনুমান নয়, বিএনপির ঊর্ধ্বতন মহলের ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকেই জেনেছি। কারণটি হল, শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকলে বিএনপি যে ধরনের নির্বাচন-জয় চায় তা পাবে না। শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে এখনও জনপ্রিয়। তিনি সরকারপ্রধান থাকলে বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আওয়ামী লীগ টেনেটুনে নির্বাচনে জয়ী হয়ে যেতে পারে। আর জয়ী না হলে বিএনপি জয় পেতে পারে। কিন্তু নিরংকুশ বিজয়ের অধিকারী হবে না। একটি তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার (সাহাবুদ্দীন-লতিফুর মার্কা) অথবা হাসিনাবিহীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকলে প্রশাসনকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে, ম্যানুপুলেট করে (২০০১ সালের মতো) সংসদে এক-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব বলে মনে করে বিএনপি।
আমার সূত্রের মতে, বিএনপি আগামী নির্বাচনে এই ধরনের ম্যাসিভ ভিক্টরি চায়। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জয়লাভ চায় না। সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেই মাত্র তারা সংবিধান সংশোধন করতে পারবে। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল, তাদের বিচার, দণ্ড সবকিছু বাতিল করে দিতে পারবে। জামায়াতকে শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ ফিরিয়ে দেয়া নয়, দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদেরও আবার ক্ষমতার পার্টনার করা যাবে। পাকিস্তানের মতো সংবিধানে শুধু শরিয়া আইন ঢোকানো নয়, তেতুলতত্ত্বের উদ্গাতা হেফাজতি মাওলানার মধ্যযুগীয় তের দফাকেও রাষ্ট্রের বিধান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর স্বার্থ ও অধিকার চূড়ান্তভাবে খর্ব করা যাবে। সৌদি আরব ও পাকিস্তানকে খুশি করার জন্য বাংলাদেশের আহমদীয়া সম্প্রদায়কে সরকারিভাবে অমুসলমান ঘোষণা করে তাদের ধর্মীয় ও নাগরিক সব অধিকার হরণ করা হবে। তালিকা আরও বড়, সবটা লিখছি না।
আগামী সংসদে ব্রন্টাল মেজরিটি না পেলে, কেবল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে একটি সরকার গঠন করা যাবে; কিন্তু উপরে বর্ণিত উদ্দেশ্যগুলোর কোনোটাই পূরণ করা যাবে না। তাছাড়া সংসদে বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি থাকলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের গণতন্ত্র ও সেক্যুলার দলগুলো এক হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ সংসদের ভেতরে বিএনপি-জামায়াতের সব অপচেষ্টার প্রতিবাদ জানাবে এবং বাইরেও গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দ্বারা তা প্রতিহত করতে চাইবে।
সুতরাং আগামী নির্বাচনে কেবল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিজয় বিএনপির কাম্য নয়। তার কাম্য এক-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে নিরংকুশ বিজয়। যে বিজয় দ্বারা সংবিধান সংশোধন করা যায় এবং সংসদে আওয়ামী লীগের উপস্থিতি একেবারেই অর্থহীন করে দেয়া যায়। কিন্তু বিএনপির ভয় শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকলে তাদের এই উদ্দেশ্য পূরণ কিছুতেই সম্ভব নয়। তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করার জন্য শেখ হাসিনাকে সরকারপ্রধান হিসেবে কোনো প্রভাবই বিস্তার করতে দেয়া হবে না। তার সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলেও বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে তার ইমেজ এবং ব্যক্তিগত ক্যারিশমার ঘাটতি এখনও নেই। এই ইমেজ ও ক্যারিশমার জোরে তিনি আগামী নির্বাচনে সব ঝড়-ঝঞ্ঝার মুখে এই জোটকে জয়ী করে আনতে পারেন।
এখানে জয়ী করতে যদি নাও পারেন, নির্বাচনে বিএনপির জয় সম্ভব, নিরংকুশ বিজয় কিছুতেই সম্ভব হবে না। আর নিরংকুশ বিজয় যে কোনো উপায়ে নিশ্চিত করতে না পারলে বিএনপির উদ্দেশ্য পূরণ সম্ভব নয় এবং নির্বাচনে গিয়েও লাভ নেই। সুতরাং শেখ হাসিনাকে যে কোনোভাবে সরকারের বাইরে রাখার জন্য বিএনপির এই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে না পেরে জামায়াতের সাহায্যে জনজীবনে সন্ত্রাস ও ভীতি সৃষ্টি করে দেশ অচল করা ও সরকারের পতন ঘটানোর জন্য এই পৌনঃপুনিক ব্যর্থ চেষ্টা।
শেখ হাসিনাকে নির্বাচনী সরকারপ্রধান রাখার ব্যাপারে বিএনপির এত এলার্জি কেন, বিএনপির ঊর্ধ্বতন মহলের ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে যেমন আমি তা জানতে পেরেছি, তেমনি জানতে পেরেছেন আমার এক অনুজপ্রতিম সাংবাদিক ও কলামিস্ট বন্ধু মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জুও। অবশ্য এটা তার নিজস্ব বিশ্লেষণও। তিনি তার ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কলামে এই বিশ্লেষণ লিখেছেন এবং টেলিফোন আলাপে আমার সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। মঞ্জুর বিশ্লেষণের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করি।
এখন প্রশ্ন, এত সহিংসতা ও সন্ত্রাস সত্ত্বেও শেখ হাসিনাকে যদি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানের পদ থেকে সরানো না যায়, তাহলে বিএনপি কী করবে? প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তাদের জন্য বড় ধরনের ছাড় ঘোষণার পর তারা নির্বাচনে যোগ দেয়ার জন্য আলোচনার টেবিলে আসবেন, না জামায়াতের সহযোগিতায় এই সন্ত্রাস অব্যাহত রাখবেন? এই সন্ত্রাস যে আরেকটি যুদ্ধাপরাধ তা কি তারা জানেন? ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে গিয়ে বিএনপি যে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধের মতো আরেকটি যুদ্ধাপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, তা কি দলটির নেতানেত্রীরা এখনও উপলব্ধি করছেন না?
’৭১ সালে জামায়াতিরা বাংলাদেশে যে নৃশংস বর্বরতার অনুষ্ঠান করেছে, বর্তমানে ২০১৩ সালে তারা বিএনপির ছাতার আড়ালে সেই একই বর্বরতার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। ’৭১ সালে বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের ঘুমের শয্যা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ঘরে ঘরে অগ্নিসংযোগ, নারী হরণ ও ধর্ষণ করা হয়েছে। অতর্কিত হামলা চালানো হয়েছে নিরীহ মানুষের ওপর, সংখ্যালঘুদের ওপর চলেছে অমানুষিক নির্যাতন। বর্তমানে সেই একই জামায়াত একই হত্যা, নৃশংসতা ও তাণ্ডবের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। তখন তাদের সহযোগী ছিল বিদেশী পাক হানাদাররা; এবার সহযোগী স্বদেশী বিএনপি।
গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোনো সংজ্ঞাতেই এই সন্ত্রাস রাজনৈতিক আন্দোলনের পর্যায়ে পড়ে না। যেমন পড়ে না একাত্তরের হত্যা ও সন্ত্রাস। দুই দেশের মধ্যে ঘোষিত যুদ্ধেও একটি আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলার চেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ বলা হয়, অসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে যেন বোমাবর্ষণ করা না হয়; সিভিলিয়ান যেন হত্যা করা না হয়। রাজনৈতিক আন্দোলনেও লক্ষ্য রাখা হয় নিরীহ সাধারণ মানুষ যেন কোনোভাবে আক্রান্ত না হয়।
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময়েও বঙ্গবন্ধু এই আন্দোলনের নাম দিয়েছিলেন অহিংস আন্দোলন। হরতাল-অবরোধের সময়ও তিনি অ্যাম্বুলেন্স, ছাত্রছাত্রীবাহী বাস, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বহনকারী ট্রাক, ওষুধের দোকান ইত্যাদি হরতালের আওতামুক্ত রেখেছিলেন। কোনো নিরীহ মানুষ যেন আক্রান্ত না হয় সে জন্য তার ছিল আন্দোলনকারীদের প্রতি কঠোর নির্দেশ। দেশের মানুষ তাতে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানিয়েছিল।
বর্তমানে বিএনপি-জামায়াতের এটা কেমন ধরনের আন্দোলন? যেখানে বাসযাত্রী নিরীহ মানুষ, এমনকি চলাচল করছে না এমন বাসেও ঘুমন্ত বালককে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নৃশংসতা দেখানো হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্স আক্রান্ত হচ্ছে, ওষুধের গাড়ি, ধানবোঝাই ট্রাক আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ৩০ লাখ শিশু শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বন্ধ করা হচ্ছে। রেললাইন উপড়ে ফেলে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। শিশুখাদ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দোকান পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। রেহাই পাচ্ছে না বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র।
এটা কি আন্দোলন, না একাত্তরের সমতুল্য যুদ্ধাপরাধ? এই যুদ্ধ তো আসলে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে। হামলার টার্গেট সাধারণ মানুষ। এটা একাত্তরের পুনরাবৃত্তি। সুতরাং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি ২০১৩ সালে জামায়াত কর্তৃক একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। জনগণের সহযোগিতায় কঠোরভাবে এই সন্ত্রাস তথা নতুন যুদ্ধাপরাধ দমনে এগিয়ে যেতে হবে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে। বিএনপি যদি সেই নির্বাচনে না আসে, তাহলে জনগণের কাছে জবাবদিহিতার দায়িত্ব তাদেরই বহন করতে হবে।
বিএনপিকেই এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে সন্ত্রাস বর্জনপূর্বক নির্বাচনে অংশগ্রহণের আলোচনায় আসবেন, না একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সহায়তায় দেশের মানুষের বিরুদ্ধে আরেকটি নৃশংস যুদ্ধাপরাধ ঘটানোর ইতিহাস তৈরি করবেন। জনগণের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধাপরাধের জন্য তারা এখনই যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিবেচিত না হতে পারেন, এমনকি তাদের বিচারও সহসা না হতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের কাছ থেকে তাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। ৪২ বছর পর যদি ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে পারে, তাহলে অনুরূপভাবে আরও ৪০ বছর পর আজকের অপরাধের যে বিচার হবে না তা কে বলতে পারে?
বাংলাদেশের ‘ন্যাশনালিস্টদের’ উচিত ত্রিশের জার্মানির ন্যাশনালিস্টদের পরিণতি (নাৎসি) থেকে শিক্ষা নেয়া। সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে তারা নির্বাচনে আসুন। দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করুন। জামায়াতের সমর্থন ও সন্ত্রাস নয়, জনগণের সমর্থনই তাদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে পারবে। জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ক্ষমতায় আসা যাবে না। শেখ হাসিনা সেখানে থাকবেন অপরাজেয়।
No comments