সময়ের প্রতিবিম্ব- নির্বাচন না হলেও ফলাফল পাওয়া যাবে by এবিএম মূসা
প্রধান নির্বাচন কমিশনার তফসিল ঘোষণা করে ফেলেছেন। ইতিপূর্বে তিনি বলেছিলেন, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতার জন্য অপেক্ষা করবেন। মনে হচ্ছে, তিনি কোথাও থেকে তাড়া খেয়ে কোনো অজ্ঞাত কারণে তাড়াহুড়ো করে টেলিভিশনে ‘ভাষণ’ দিয়েই নির্বাচনসংক্রান্ত দিন-তারিখসমূহ নির্ধারণ করে দিলেন।
বোঝা গেল, যাঁরা তাড়া দিয়েছিলেন তাঁরা নির্বাচনটি সঠিক বা বেঠিক, সর্বজনগ্রাহ্য হবে কি না সেই ভাবনার তোয়াক্কা না করে নির্বাচন-জাতীয় কিছু করেই ফেলবেন। সাজানোই হোক অথবা ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ’ যাই হোক, কিছু যায় আসে না।
সত্যিকারের অথবা সাজানো কত রকমের নির্বাচনই তো সুদীর্ঘ জীবনে দেখলাম। যুক্তফ্রন্টের ১৯৫৪ সালের নির্বাচন ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ভোটদান। সেই নির্বাচন সঠিক ও নিরপেক্ষ হওয়ার কৃতিত্ব তৎকালীন ক্ষমতাসীন মোসলেম লীগ সরকারের। এবার অবশ্য শেখ হাসিনা সরকার তেমন নিরপেক্ষ হবেন, এমনটি কেউ বিশ্বাস করে না। মোদ্দা কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর ছকবাঁধা পন্থায় ‘করে’ ফেলবেন। সেই পথে তিনি অনেকখানি এগিয়ে গেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ‘পারবেন’ তো? উত্তর হচ্ছে, না পারলেইবা কী, পঞ্চদশ সংশোধনী অনুসরণে প্রধানমন্ত্রিত্ব থাকবে।
তবে অনেকেই আমাকে যখন প্রশ্নটি করেছেন আমি বলেছি, কেন পারবেন না? জিয়াউর রহমান আর এরশাদ সাহেব তো গণভোট করে ভোট পান বা না পান শতকরা ১১০ জনের সমর্থন পেয়েছেন বলে ঘোষণাটি করে ফেলেছিলেন। ভোটকেন্দ্রে ভোটার ছিল কি না তা দেখার জন্য বিদ্যমান স্বল্পসংখ্যক গণমাধ্যম প্রতিনিধি ছিলেন না। বিদেশি পর্যবেক্ষক প্রথাটি তখন চালুই হয়নি। ইচ্ছামাফিক ফলাফল ঘোষণা করলে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি না, তা বিবেচনার প্রয়োজন ছিল না। এখন তাঁদের আসতে ভিসা না দিলেই হলো।
সর্বোপরি পরম শুভাকাঙ্ক্ষী (আইনি ঝামেলায় পড়ার আশঙ্কায় বশংবদ বললাম না) কমিশন তো আছেই। আরপিও তথা জনপ্রতিনিধিত্ব আইন একটুখানি সংশোধন করে অনেক ব্যবস্থা করা যাবে। নির্বাচনের আগে-পরের জ্বালাও-পোড়াও নিয়ে ‘ডোন্ট কেয়ার’ বলে মাথা না ঘামালেই হলো। উলুখড় পুড়বে পুড়ুক না, ঘরে-বাইরে নিন্দা-সমালোচনা হবে, হোক না। বিরোধী দল অথবা জনগণ অথবা ‘জ্বালাও-পোড়াও’ করা দুর্বৃত্তরা হয়তো ভোটারের ভোটকেন্দ্রে যাওয়া বন্ধ করতে পারবে, করুক না। কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন কমিশনের ফলাফল ঘোষণায় বাধা নেই। থাকলেও সংসদে আইন করে তা অপসারিত করলেই হলো। সুতরাং ভোট নাইবা পড়ল, ভোটারও না এলেও কিছু যায় আসে না, আওয়ামী প্রার্থীদের শুধু নির্বাচন কমিশনের কাছে ফলাফল চাই।
একটি নির্বাচন করে ফেলা নয়, যথাযথ ভোটে পরাজয়ের পরও জয়ী ঘোষণার তরিকাটির উদাহরণ দেব। তরিকাটির নাম ‘মিডিয়া ক্যু’, আবিষ্কারক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এই পদ্ধতির কীভাবে সফল প্রয়োগ করা যায়, এ সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শুধু নয়, অংশগ্রহণ আছে। অভিজ্ঞতাটি ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের, সেটি আগেও বলেছি কি না মনে নেই, পাঠকদেরও মনে থাকার কথা না। আসন্ন নির্বাচনী প্রহসনের মঞ্চস্থকারীদের জন্য পুনর্ব্যক্ত করছি।
আমি তখন বাসস, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক। এরশাদ সাধারণ নির্বাচন করতে ১৯৮৬ সালে সামরিক শাসন বৈধ করার জন্য সংসদ বানাবেন। মানে গণতন্ত্রের একটি ভেক পরবেন। শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া উভয়ে অংশগ্রহণ করবেন বলে যুক্ত সিদ্ধান্ত নিলেন। উভয়েই ১৫০-১৫০ আসনে একাই প্রার্থী হবেন। বস্তুত কৌশলটি ছিল চমৎকার। কিন্তু তাঁরা চলেন ডালে ডালে, এরশাদ পাতায় পাতায়। সামরিক ফরমান বলে আরপিও সংশোধিত হলো, কেউ তিনটির বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। সুতরাং দুই দল সিদ্ধান্ত নিল নির্বাচনে যাবে না। দুই নেত্রীর বর্জন ঘোষণার পর সেই রাতে আর অফিসে থাকার প্রয়োজন ছিল না। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ নেত্রী চট্টগ্রামে জনসভায় ঘোষণা দিলেন, ‘যারা এই নির্বাচনে যাবে, তারা জাতীয় বেইমান।’ তাই বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। টেলিফোনে বিশেষ স্থান থেকে নির্দেশ পেলাম, রাতভর দপ্তরে থাকতে হবে। চমক দেওয়া খবর আসছে, সেই চমকটি ছিল ঢাকায় ফিরে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিলেন শেখ হাসিনা। রাত দুইটায় খবরটি টেলিপ্রিন্টারে সর্বত্র পাঠিয়ে দিলাম। অপরদিকে খালেদা জিয়া রইলেন অনড়, মাথায় পরলেন ‘আপসহীন’ মুকুটটি।
নির্দিষ্ট দিনে এরশাদের পাতানো নির্বাচন হলো। ব্যবস্থা ছিল ফলাফল ঢাকার কমিশন কার্যালয় থেকে ঘোষণা করা হবে, কেন্দ্র অথবা জেলা রিটার্নিং অফিস থেকে নয়। আমি আর রিপোর্টার মরহুম গিয়াস কামাল এবং স্বল্প কয়েকটি পত্রিকার প্রতিনিধি প্রধান নির্বাচন কমিশন দপ্তরে গেলাম। জেলা সদর থেকে ভোটের সংখ্যা আসছে একটি কামরায়। পাশের কামরায় ফলাফল লেখা হচ্ছে। বিরাট গণনা কক্ষ থেকে একজন বেরিয়ে এসে বোর্ডে ফলাফল চক দিয়ে লিখছেন। সেই ক্রমান্বয়ে পাওয়া ফলে দেখছি—আওয়ামী লীগ ১০০, জাতীয় পার্টি ৫০। অবাক কাণ্ড বটে। মনে মনে বেশ খুশি, হঠাৎ দেখি পাশের কামরা থেকে কেউ আসছে না। মিনিট-ঘণ্টা পার হয়ে গেল। ব্যাপার কী দেখার জন্য গণনাকক্ষে গিয়ে দেখি অন্ধকার, কেউ নেই।
বুঝলাম, ভোট গণনা বন্ধ করে কেন জানি সবাই পালিয়েছে। আমরা দুজনে বের হওয়ার জন্য বাইরে এসে দেখি, নির্বাচন কমিশন চারদিকে সেনাবাহিনী ঘেরাও করে রেখেছে। একটি চিপা পথ দিয়ে বের হয়ে বাসসে এলাম। এদিকে দুই দিন পরও ভোটের ফলাফল দেশবাসী জানছেন না। দুদিন পর আমার কাছে নির্দেশ এল, ভোটের ফল পাঠানো হচ্ছে, সেটিই সব পত্রিকায় টেলিপ্রিন্টারে যাবে। সেই ঘোষিত তথা পাঠানো ফলাফলে আওয়ামী লীগকে বোধ হয় ৪০-৪৫টি আসন দেওয়া হয়েছিল। সেই ফল আওয়ামী লীগ মেনে নিল, কারচুপি হয়েছে বলে তখনই প্রত্যাখ্যান অথবা সংসদ ‘বর্জন’ করল না।
এরই নাম ‘মিডিয়া ক্যু’, যা ২০১৪ সালে অনুসরণ করার পরামর্শ দিচ্ছি আওয়ামী লীগকে। ইতিমধ্যে বিরোধী দলের হরতাল বর্জন-অবরোধ চলতে থাকুক না। গাড়ি পুড়ুক, মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিট রোগীতে ভরে যাক। তবে বর্তমান মিডিয়া যুগে বর্ণিত পদ্ধতি কতখানি কার্যকর হবে তা ভেবে অনেকে আমার বক্তব্যটি পরিহাস বলে উড়িয়ে দিতে পাবেন। তা ছাড়া এখন গণনা হয় কেন্দ্রে, সেখানে ফলাফল ওলটানো যাবে কী করে? অতি সহজ উপায়, নির্বাচন কমিশন বলবে, ওই পদ্ধতি বাতিল করা হলো। ইতিমধ্যে সাজানো আমলাতন্ত্রে ফলাফল ওলটপালট করে বশংবদ রিটার্নিং অফিসার যদি দুয়ে-দুয়ে পাঁচ গণনা করে শেরেবাংলা নগরে পাঠান, সেটিই কমিশন ঘোষণা করে মিডিয়ায় পাঠাবে। একই সঙ্গে নিজেদের প্রতিনিধির পাঠানো নিজস্ব সূত্রে পাওয়া ফলাফল মিডিয়ায় ছাপা হলেই কী আসে-যায়। তদুপরি কেন্দ্রে মিডিয়ার ‘প্রবেশ নিষেধ’ করলেই হলো। আর বিদেশি পর্যটক? ভিসা না দিলেই হলো।
এতদূর যা লিখলাম তা পড়ে পাঠক বলবেন আওয়ামী লীগকে বদবুদ্ধি দেওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ আওয়ামী লীগকে কিছু করতে হবে না, যা করার নির্বাচন কমিশনই করবে। তারা ইচ্ছে করলে সারা দেশের জন্য একটি সাজানো নির্বাচনী ফলাফল ছকনির্দেশ অনুযায়ী তৈরি করতে পারবে। কেন্দ্রে রিটার্নিং কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট সব ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবেন। এ জন্য অবশ্য কমিশনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলতে আমরা যা বুঝি, সেই পুলিশ-বিজিবি-আনসার ছাড়াও সেনাবাহিনীর সাহায্য চাই। আর যদি একটি যেমনটি বললাম তেমনটি না করে নির্বাচনী প্রহসনের মঞ্চ সাজাতে হয়। দেশের ৩৯০০ কেন্দ্র পাহারা দেওয়া, ব্যালটে সিল মেরে হাজার হাজার বাক্স পুরানো এবং প্রার্থী ও লাখ খানেক পোলিং অফিসার ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। এই কাজটি করতে শুধু র্যাব, পুলিশ আর সীমান্ত অরক্ষিত রেখে নিয়ে আসা বিজিবি দিয়ে সম্ভব হবে না। তাই তো প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সেনা সাহায্য দরকার। তবে ইতিমধ্যে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সেনাবাহিনীকে, যাদের নামোচ্চারণে দেশপ্রেমিক শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তাদের দেশের সংখ্যাগুরু জনগণের মুখোমুখি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আবার কোনো ঝামেলা বাধিয়ে ফেলবেন না তো? বলা হয়েছে সেনাবাহিনী হবে স্ট্রাইকিং ফোর্স, দরকার হলেই শুধু অকুস্থলে যাবে। খুব ভালো কথা, কিন্তু সেই কর্তব্যটি করতে গেলে যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়? সেই প্রশ্নের উত্তর যথাস্থান থেকে চাই।
সবশেষে প্রশ্ন, আমার সলাপরামর্শ অনুযায়ী বর্ণিত এত ঝামেলায় কেন যাবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? ষোড়শ সংশোধনী করতে পাঁচ মিনিট লাগবে। সংবিধান সংশোধন করে সংসদ তথা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল দুই-পাঁচ বছর বাড়িয়ে নিলেই হয়। নির্বাচন প্রতিরোধকারীদের মরতে বা মারতে হবে না। জনগণও হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও, পুলিশের গুলি, আগুনে ঝলসানোর দুর্ভাগ্য, মর্মান্তিক মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার পাবে। যাঁরা সমঝোতা-সংলাপের জন্য ছোটাছুটি করছেন, পত্রিকায় কলাম লিখছেন, টক শোতে দুশ্চিন্তার ঝাঁপি খুলে বসেছেন, তাঁরাও বিশ্রাম পাবেন।
সর্বোপরি, তফসিলভুক্ত প্রার্থীদেরও এলাকায় যাওয়ার ভীতি বা ঝুঁকি থাকবে না। কথাটি বললাম এ জন্য, দুদিন আগে আমার গ্রামের এলাকা, ফুলগাজী-পরশুরামের আওয়ামী মনোনয়ন পাওয়া কোন এক তপন ঘোষ না বোসকে জনতার তাড়া খেয়ে ভাঙা গাড়িতে এলাকা ছাড়তে হয়েছে। নিশ্চিন্তে ঢাকায় বসে থাকবেন আর টেলিভিশনে কমিশনের সরবরাহকৃত ফলাফল ঘোষণা শুনবেন, এলাকায় তাড়া খেতে যেতে হবে না। সেই ফলাফল যত দিনই টিকুক, প্রাক্তন সাংসদ বা মন্ত্রী কথাটি নামের শেষে লিখতে পারবেন।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments