হরতাল-অবরোধ কি চলতেই থাকবে? by মীর আবদুল আলীম

মনে হচ্ছে, হরতাল-অবরোধ বন্ধ হবে না। আরও সহিংস হবে। ফোনালাপ হবে, বৈঠক হবে না। হুমকি-ধমকি চলবে, সমঝোতা হবে না। গাড়ি পুড়বে, মানুষ মরবে; একদল গদি ছাড়বে না, অন্য দল গদির নেশায় হরতাল-অবরোধ দেবে; সংঘাতে জড়াবে। এখন হরতালের আগের দিনই ভাংচুর ও নৈরাজ্যের মাধ্যমে দেশজুড়ে আতংক সৃষ্টি করা হয়। ফলে মানুষ ভয়ে রাস্তাঘাটে বের হয় না। হরতাল আহ্বানকারী রাজনৈতিক দল এ চিত্র সামনে রেখে দাবি করে, হরতাল সফল হয়েছে। বাস্তবে হরতাল নয়, সফল হয় ভয়তাল। একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকের শিরোনাম ছিল এরকম- Pre-strike violence rocks city. অপর দুটি বাংলা দৈনিকের শিরোনাম- হরতালের আগেই বোমা হামলা, রাজধানীতে হরতাল-পূর্ব নাশকতা। অন্যদিকে টেলিভিশনে যা দেখলাম, তা সংবাদপত্রের ছবি ও শিরোনামের চেয়ে আরও বেশি ভয়ংকর। হরতাল ছাড়া প্রতিবাদের আরও অনেক ভাষা আছে। সেসবের চর্চা না করে অবরোধ-হরতালের মতো ধ্বংসাÍক কর্মসূচি নেয়ার কারণ কী? জনকল্যাণের জন্যই যদি রাজনীতি হয়, তাহলে হরতালের নামে জ্বালাও-পোড়াও কেন? হরতালে সরকারি দল বিরোধী দলের কর্মসূচি ভণ্ডুল করতে চায়। আর বিরোধী দল দেশব্যাপী ভাংচুর ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। দু’দশক ধরে দেশে হরতালের নামে এসবই চলছে।
এক সময় হরতাল ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও জনমুখী। তখন হরতাল ছিল বিদেশি শাসকদের শোষণ, জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে। তখন হরতাল পালনের জন্য কাউকে বাধ্য করা হতো না। কিন্তু হরতালের নামে এখন জ্বালাও-পোড়াও, ভাংচুর ও লুটতরাজের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। মজার ব্যাপার হল- শাসক দল সব সময়ই হরতালের বিরুদ্ধে থাকে এবং তখন তারা বুঝতে পারেÑ হরতালে দেশের ক্ষতি হয়, প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। এরপর যখন তারা বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়, তখন আর এসব কথা তাদের মনে থাকে না। তারা হরতালের পর হরতাল আহ্বান করতে থাকে। এক পরিসংখানে দেখা যায়, ১৯৭২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ২৮ বছরে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৪৩৩টি পূর্ণ দিবস ও ৫৭৯টি অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭২ সালের শুরু থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচটি পূর্ণ দিবস ও ১২টি অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের ২৩ আগস্ট পর্যন্ত পালিত হয় ১০টি পূর্ণ দিবস ও ৪৩টি অর্ধদিবস হরতাল। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০৪টি পূর্ণ দিবস ও ১৯৪টি অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। ১৯৯০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত পূর্ণ দিবস হরতালের সংখ্যা ১৫৫ ও অর্ধদিবস হরতালের সংখ্যা ২২৩টি। ১৯৯৬ সালের ৩১ মার্চ থেকে ২০০০ সালের ১২ জুন পর্যন্ত পালিত হয় ১৫৯টি পূর্ণ দিবস ও ১০৭টি অর্ধদিবস হরতাল। পত্র-পত্রিকার হিসাব অনুযায়ী, ২০০০ সালের ১২ জুনের পর থেকে ২০১০ সালের ২৭ জুন পর্যন্ত ১৭৭টি হরতাল পালিত হয়। ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশে কোনো হরতাল পালিত হয়নি। এরপর ২০১০ সাল থেকে আবার হরতাল কর্মসূচি শুরু হয়েছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে খুব বেশি হরতাল হয়েছে- তা বলব না। তবে যেভাবে টানা হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি ঘোষিত হচ্ছে, তাতে শংকিত না হয়ে পারা যায় না। হরতালে দেশের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির একটা হিসাব পাওয়া যায় ইউএনডিপির স্থানীয় একটি গবেষণা থেকে। ২০০৫ সালে প্রকাশিত ইউএনডিপির একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৯০-৯১ অর্থবছর থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর পর্যন্ত হরতালের কারণে প্রতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গড়ে ক্ষতি হয়েছে ৮৪ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। কেন ও কীভাবে হরতাল সফল হয়, তা সাধারণ মানুষের জানতে বাকি নেই। বস্তুত কর্মনাশা হরতাল দেশের কোনো স্বার্থই রক্ষা করতে পারে না। নিছক ক্ষমতার লড়াইয়ের অংশ হিসেবে, এক দলকে হটিয়ে আরেক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার অস্ত্র হিসেবে হরতাল ডাকা হয়। স্বাভাবিক কাজ-কর্ম থেকে বিরত থাকতে মানুষকে বাধ্য করা সংবিধান বহির্ভূত। হরতাল আহ্বানকারীদের কথিত ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’-এর নামে প্রকারান্তরে দেশের মানুষের নাগরিক অধিকার হরণ করা হয়। আমাদের সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯ অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোথাও হরতালকে ‘সাংবিধানিক অধিকার’ বলা হয়নি। তাহলে হরতাল নামের এ ভয়তাল কোন অধিকারের মধ্যে পড়ে- জানতে ইচ্ছে করে।
পঞ্চাশের দশকে মাথাপিছু গড় আয়ের দিক থেকে ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কোরিয়া ও তাইওয়ানের তুলনায় বাংলাদেশ খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু ২০১৩ সালের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ পর্যায়ে আমাদের দেশের তুলনায় উল্লিখিত দেশগুলো, বিশেষ করে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কোরিয়া ও তাইওয়ান প্রভূত উন্নয়ন করেছে। বাংলাদেশের উন্নয়নে মন্থরগতি বা স্থবিরতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন অনেকে। মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরিকল্পনায় শৃংখলার অভাব, অবকাঠামোগত অনুন্নয়ন, নানামুখী দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র, শিল্প-কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ, অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, বিশ্ববাজারে অস্থিতিশীলতা, আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে সুষম নীতিমালার অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি দুর্বল অর্থনীতির কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তবে সুপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রক্রিয়ার আওতায় বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর দক্ষতা কাজে লাগানো সম্ভব হলে আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বপ্ন বাস্তবে রূপলাভ করবে বলেই মনে হয়। এজন্য স্থানীয় উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের নানাভাবে উৎসাহ ও প্রণোদনা দেয়া প্রয়োজন। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। এটা আমাদের রাজনীতিকরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল।
মীর আবদুল আলীম : কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.