আয়কর কেন ভীতিকর by শরীফুল ইসলাম খান

বাড়ছে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি। ২০১৫ সালের মিলেনিয়াম গোলের যে লক্ষ্যমাত্রা বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে ও প্রবৃদ্ধিতে অর্জনের কথা, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই আমাদের সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হতে যাচ্ছে। গত ৫ বছর ধরে বাংলাদেশের জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি) ৬ শতাংশের ওপরে। বিশ্ব যখন টালমাতাল বিভিন্ন অর্থনৈতিক খরায়, তখনও এদেশের কৃষক জোগান দিয়ে গেছে ১৬-১৭ কোটি মানুষের খাদ্য শুধুই নিজস্ব উদ্যোগে। এ দেশে ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী লোকের মধ্যে কর্মক্ষম প্রায় ৫৫ থেকে ৫৮ শতাংশ। পৃথিবীর আর কোথাও তা বিরল। অমর্ত্য সেন তার নতুন প্রকাশিত বই ‘এন আনসারটেন গ্লোরিতে’ উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও কিছু বিষয়ে মান উন্নয়ন সূচকে চমকে দেয়ার মতো এগিয়ে আছে, অথচ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় অর্ধেক। ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রায় সর্বক্ষেত্রে যে রাষ্ট্রের কানায় কানায় ভরে আছে অনৈতিকতা, স্বার্থপরতা, চরম অব্যবস্থা ও সার্বক্ষণিক অস্থিরতা, যে দেশে প্রকৃতিও বিরূপ আচরণ করে সময়ে সময়ে, যে দেশ থেকে বিদেশীরা নানা অজুহাতে বারবার মুখ ফিরিয়ে নেয়ার ভান করে গড়তে চায় বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যবাদের বসতি- সেদেশে ধুঁকে ধুঁকে হলেও সাধারণ মানুষ চালাচ্ছে উন্নয়নের প্রচেষ্টা, বদলে দিচ্ছে যতটুকু সাধ্য এ দেশকে। কৃষি, শিল্প, সেবাখাতে উন্নয়ন সূচক বাড়ছে। একটি দেশের নিজস্ব অর্থ ও মানবসম্পদ দিয়ে সেই দেশটাকে গড়তে পারাই হচ্ছে মূল উন্নয়ন। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, সরকারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান পুলিশ, র‌্যাব ইত্যাদির মান উন্নয়নে সরকারকেই করতে হয় প্রচুর ব্যয়। যে দেশের বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের অভাবে বিদেশী পুঁজি বা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মতো রাষ্ট্রীয় কাঠামো বা ব্যবস্থা নিতান্তই অপ্রতুল, সে দেশের নিজস্ব মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই মূল চালিকাশক্তি দেশকে বিশ্বদরবারে এমন একটি অবস্থানে টেনে আনার জন্য, যাতে করে বিশ্ব তার প্রয়োজনের খাতিরেই তাদের দিকে আকর্ষিত হয়।
আমি নিশ্চিত সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়ন ও বিকাশের মধ্যে নিহিত আমাদের ভালো থাকার বিষয়টি, এর অন্য কোনো বিকল্প নেই। যে বিষয়টি মূল আলোচনার তা হচ্ছে, আমাদের অভ্যন্তরীণ জোগান দিয়ে আমরা কিভাবে অনেক দূর পথ এগোতে পারি। আমাদের রাজস্ব আদায়ের গুণগত ও সংখ্যাগত পরিমাণ বাড়িয়ে এবং এই আদায়কৃত রাজস্ব সঠিক খাতে বণ্টন করে উন্নয়ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের দেশে প্রতি বছর রাজস্ব আয় বাড়ানোর প্রচেষ্টা প্রত্যেক সরকারই অব্যাহত রেখেছেন। আমাদের দেশের রাজস্ব আয়ের সিংহভাগই আসে পরোক্ষ কর থেকে। পরোক্ষ করের মূল স্রোত বা উপাদান হচ্ছে মূল্যসংযোজন কর, সাধারণ শুল্ক, আমদানি শুল্ক, রফতানি শুল্ক ইত্যাদি। মোট রাজস্ব আয়ের ৭০ থেকে ৭৫ ভাগই এই পরোক্ষ করের অংশ। বাকি ২৫ থেকে ৩০ ভাগ প্রত্যক্ষ কর আয়করের অংশ। বর্তমান অর্থবছরের রাজস্বের মাত্রা ধরা হয়েছে (২০১৩-১৪) ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা। রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি প্রবাহের ওপর নির্ভর করবে পরোক্ষ করের আদায়ের পরিমাণ। কিন্তু আমাদের দেশের একটি বিরাট অংশ যা প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর থেকে আসে তা শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর বাড়বে সেটি বোধ করি নয়। বরং এই আয়কর আদায়ের পরিমাণ বাড়ানোর কলা-কৌশল একদিকে যেমন রাজস্ব আদায়ে নিয়োজিত কর্মীদের দক্ষতা, নৈতিকতা, কর অবকাঠামো ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল, তেমনিভাবে প্রণোদনা ব্যক্তি খাতের আয়কর বাড়িয়ে দিতে পারে প্রচণ্ডভাবে। সেদিকে আমাদের দেশের সরকার, আইনপ্রণেতা, বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের নজর অনেক কম। আমরা যদি একটু খতিয়ে দেখি এ দেশে শুধু আয়ের ওপর কর প্রদান করতে হয় তেমনটি নয়, যে কোনো ব্যয়ের ওপরও আমাদের কর প্রদান করতে হয় ভ্যাটের নামে। যে কোনো পণ্য ক্রয়ে কখনও ভ্যাট, কখনও অন্য খরচের বোঝা যেমন পথিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের চাঁদা ও ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার ভার ক্রেতাদের ওপরই বর্তায়। সামান্য খাবার গ্রহণ করতে গেলেও বিলের সঙ্গে যে ভ্যাটযুক্ত হয় তাও বহন করতে হয় ক্রেতাকেই। কিন্তু আয়কর প্রদানে আগ্রহী করে তোলার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রণোদনামূলক কোনো কিছু এখন পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি। প্রণোদনা বলতে বছরে গুটিকয়েক ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারী হিসেবে পুরস্কৃত করা, সিআইপি প্রদান করা, এতটুকু। অন্যদিকে রাজস্ব বা আয়কর সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো এর সামগ্রিক বা সুদূরপ্রসারী প্রভাবকে কখনও মাথায় নেয়া হয় বলে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বরং বড় বড় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক দিক ও স্বার্থ বিবেচনা করে অনেক সময় রাজস্ব সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। করের আওতাভুক্ত ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র আয়কর হিসেবে পরিশোধ করা হয়। তথ্যপ্রযুক্তি ও আধুনিক কলা-কৌশলের অভাবে আমাদের প্রত্যক্ষ করের একটি বিরাট পরিমাণ অংশ থেকে সরকার বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে যারা আয়কর প্রদান করেন তারাও মন থেকে আয়কর প্রদান করেন না, কখনও ভয়ে, কখনও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না বলে ট্যাক্সের বিরাট অংশের ফাঁকি দিয়ে কর পরিশোধ করেন এবং কর আদায়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনৈতিকতা এ ক্ষেত্রে সহায় হয়। তাছাড়া এনবিআরের অনেক কলা-কৌশল ও সিদ্ধান্ত কর প্রদানকারীদের জন্য যুগোপযোগী ও মনস্তাত্ত্বিকবান্ধব নয়। এই অর্থবছরে আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা গত বছরের তুলনায় প্রায় ২৪.৮৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। যদিও গত অর্থবছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার আয়কর বকেয়া রয়েছে, যা আয়কর বিভাগের জন্য হতাশার বিষয়। অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি খুব একটা ভালো নেই দেশের। তবুও এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ আমৃত্যু নিজের অবস্থান যাই হোক দেশকে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এ অর্থবছরেও আয়কর অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা হয়তো অর্জিত হবে। তাই বলে যারা আয়কর প্রদান করেন তাদের ভোগান্তি তৈরি করে তা অর্জন করা ফলপ্রসূ নয়। একজন আয়কর প্রদানকারী হিসেবে আমার মনে হয়, সরকারি কিছু ইতিবাচক ভূমিকা আমাদের আয়কর প্রদানে উৎসাহী করবে। করদাতা যেন কর প্রদানে উৎসাহ পান, সে ধরনের কিছু প্রণোদনা সরকারকে অচিরেই চালু করা প্রয়োজন। পৃথিবীতে যারা কর প্রদান করেন তারা নিজেদের গৌরান্বিত মনে করেন। ট্যাক্স পেয়ি সিটিজেন এ উচ্চারণের মধ্যে দিয়েও তারা অনেক ক্ষেত্রে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও আদায় করতে পারেন। আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো কথা যদি কোনো করদাতা বলে বসেন, তবে ভোগান্তির মাত্রা আরও বেড়ে যাবে, এটা পরীক্ষিত সত্য। অথচ জনগণের কর দিয়ে সরকারি প্রশাসনের বেতন, ভাতা ও সুবিধা প্রদান করা হয়। যদিও ইতিমধ্যে সরকারিভাবে এবং এনবিআর কিছু ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তা একেবারেই নগণ্য। সরকার শনাক্তকৃত করদাতাদের কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার মাধ্যমে প্রণোদনা সৃষ্টি করে আরও বেশি পরিমাণ কর আদায় করতে পারেন। শনাক্তকৃত করদাতাদের বিষয়টি একটি উপমা দিয়ে বোঝালে কিছুটা সহজবোধ্য হয়। মনে করি সরকার সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যক্তি করদাতাদের মধ্যে যিনি বছরে ৫ লাখ টাকা আয়কর প্রদান করেন তিনি বিশেষ শ্রেণীর প্রিভিলাইজড কার্ড হোল্ডার হবেন। যে কার্ডের বদৌলতে দেশের বিভিন্ন সরকারি ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারমূলক সেবা ও সম্মান পাবেন। যেমন যাতায়াত বা পরিবহনে টিকিট কাটায়, হাসপাতালে, থানা-পুলিশে, টেলিফোন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওয়াসা এসব জায়গায় তাদের সেবার প্রয়োজনের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। তাহলে যদি কোনো করদাতা দেখেন কোনো অর্থবছরে তার ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা আয়কর নিরূপিত হয়েছে তখন ৫ লাখ টাকার বিশেষ অগ্রাধিকারমূলক কার্ডটি অর্জনের জন্য ২০ হাজার টাকা বেশি আয়কর দিতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না, এতে সরকারের আয়কর অর্জিত হবে বেশি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ওপরের উপমায় বর্ণিত ক্ষেত্রে ১০-১৫ হাজার টাকা যথাস্থানে খরচ করে আয়কর কমিয়ে ফেলেন, নিদেনপক্ষে নিরূপিত আয়করের ৩০-৪০ ভাগ, কখনও তারও বেশি। এতে সরকার রাজস্বের বিরাট অংশ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। বর্তমান বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে একজন প্রকৃত এবং সঠিক করদাতা হয়েও রাস্তায় ট্রাফিক বা সার্জেন্টের, থানা-পুলিশে, বিশেষ বাহিনীতে, হাসপাতালে, সরকারি পরিবহনে টিকিট কাটায় ইত্যাদিতে যে বিড়ম্বনা ও আচার-আচরণের শিকার হন তাতে কর প্রদানে তার অনীহা ছাড়া আর কী থাকতে পারে? আমরা জানি অনেক বিত্ত ও ক্ষমতাধর বিলাসবহুল গাড়ি, বাড়ির মালিক হয়েও কৃষিখাতে আয় দেখিয়ে কর ফাঁকি দেন অথচ তাদের হাতের মুঠোয় থাকে কর বকেয়া নেই, এ ধরনের সনদ। তাদেরও তো আমরা বাহবা বাহবা রবে সম্মান দেখাই। তাহলে করদাতাদের বেলায় কিছু সুযোগ-সুবিধা তৈরিতে সরকারের বাধা কোথায়? প্রশাসনের ভারি ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, আমলা, অন্যান্য পেশার বিশেষ ব্যক্তি অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন, একজন বিশেষ শ্রেণীর করদাতাও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তেমন সুযোগ-সুবিধার দাবিদার। প্রকৃত করের একটি অংশ যদি সরকার, করদাতাদের অবসরের সময়ে এককালীন বা মাসিক পেনশন হিসেবে প্রদানের প্রতিশ্র“তি দেয় তাহলেও ভবিষ্যৎ খোরাকের প্রাপ্য অংশ হিসেবে বহুজন সঠিকভাবে কর প্রদানে উৎসাহী হবে। কর আদায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের সহযোগিতামূলক আচরণ (বর্তমানে কর কর্মকর্তাদের প্রতি আমাদের ভয়-কম্পন ইত্যাদি কাজ করে), তথ্যের অবাধ প্রবাহ, আয়কর আদায়ের পন্থা সহজীকরণের বিষয়টিতে আরও নজর দিতে হবে। যদিও এ বিষয়ে আগের তুলনায় এনবিআর যথেষ্ট চেষ্টা করছেন। আয়কর নির্ধারণের আগে সরকারকে ইনফ্লেশন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রবাহ, হিডেন ট্যাক্স, (সামগ্রিক ভোক্তা হিসেবে দ্রব্যের ওপর নির্ণীত কর, ভ্যাট, চাঁদা ইত্যাদি আমাদেরই বহন করতে হয়) ইত্যাদি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। জাকাত যেমন আমরা ধর্মীয় অনুভূতির কারণে মনের ভেতর থেকে দিই, করও তেমনই দেশের জন্য, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নয়নের জন্য মন থেকে দিতে হবে। করযোগ্য ব্যক্তিদের বোঝাতে হবে একজন সার্বিক করদাতা রাষ্ট্র উন্নয়নের বিনিয়োগকারী। বোঝাতে হবে সেই কর দিয়ে রাষ্ট্রের কী কী খাত পরিচালিত হয়, কারা এর সুবিধাভোগী। বক্তৃতায়, বিশেষ গোষ্ঠীর সিম্পোজিয়ামে, আসার প্রচারে নয়, মানুষের ভেতরকার চিরে যাওয়া মনটাকে জাগাতে হবে। সাধারণ মানুষের ঘামে ধোয়া হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার নয়, বরং দিনে দিনে ক্ষেত্র ও প্রণোদনা বাড়িয়ে প্রকৃত করদাতাদের উপযুক্ত সম্মান দিয়ে দেশের ভেতর থেকেই কর-রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে গড়তে হবে অর্থনীতির শক্ত ভিত, বদলে দিতে হবে বহির্বিশ্বে আমাদের ইমেজ।
শরীফুল ইসলাম খান : ব্যাংকার

No comments

Powered by Blogger.