হবিগঞ্জে বালুখেকো- ব্যক্তিস্বার্থে সামষ্টিক সর্বনাশ!

ছড়া কিংবা নদী 'বালুমহাল' ঘোষণার যে কুফল দেশজুড়েই দেখা যাচ্ছে, তার নিকৃষ্ট নজির হচ্ছে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার রূপাইছড়া এলাকা। শুক্রবার সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়,
ওই এলাকার দিগাম্বরছড়া ও কালীছড়া নামে দুটি পাহাড়ি জলধারা থেকে বালু উত্তোলনের ইজারা পেয়ে জনৈক প্রভাবশালী আশপাশের টিলা, খাস জমি, এমনকি জনবসতি থেকেও বালু উত্তোলন করছে। রেহাই পাচ্ছে না রূপাইছড়ি সরকারি রাবার বাগানও। টিলাটি কেটে ফেলার পাশাপাশি সেখানকার মূল্যবান গাছপালাও লুট হচ্ছে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে সামষ্টিক সম্পত্তি বিনাশের এই উদগ্র আয়োজনে ব্যবহৃত ট্রাক চলাচলে বিনষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ ওই জনপদের রাস্তাঘাটও। সংলগ্ন মহাসড়কে বালুর স্তূপের কারণে নানা দুর্ঘটনাও ঘটছে বলে জানা যাচ্ছে। আমরা মনে করি, সর্বনাশা এই অপতৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের আন্তরিকতাই যথেষ্ট। হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসকও সমকালের কাছে স্বীকার করেছেন, সেখানে ইজারাকৃত স্থানের বদলে অন্যান্য জায়গা থেকে বালু উত্তোলন হচ্ছে। ইজারাদারকে বালু তোলার সব যন্ত্রপাতি ও মহাসড়ক থেকে বালুর স্তূপ সরানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। আমরা জানতে পারছি, ওই ইজারাদাতার বিরুদ্ধে থানা, উপজেলা ও জেলা প্রশাসনে ছয়টি মামলা ও ১৯টি অভিযোগ রয়েছে। তারপরও কেন প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না? অভিযুক্ত ব্যক্তি জেলা শ্রমিক লীগের নেতা বলে? আমরা মনে করি, কেউই আইনের ঊধর্ে্ব নয়। অবিলম্বে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। ইতিমধ্যে যে ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতিপূরণও আদায় করতে হবে। একই সঙ্গে 'বালুমহাল' ইজারার বিষয়টিও নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করতে বলব নীতিনির্ধারকদের। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়া বা নদীর তলদেশ ও তীরবর্তী ভূমি থেকে ড্রেজার ব্যবহার করে কিংবা স্রেফ কোদালে কেটে বালু উত্তোলন কী মহোৎসবের আকার ধারণ করেছে, তা আর অজানা নয়। এই প্রক্রিয়ায় বালুদস্যু নামে নতুন এক অপরাধী গোষ্ঠীও সমাজে পরিচিতি পেয়েছে। তাদের বেপরোয়া বালু তোলার কারণে অনেক সময় সেতু ও বাঁধসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও হুমকির মুখে পড়তে দেখা গেছে। সন্দেহ নেই, এ জন্য স্থানীয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততা অনেকাংশে দায়ী। বালুদস্যুরা রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও স্থানীয় প্রশাসনকে 'ম্যানেজ' করেই মাঠে নামে। কিন্তু বালু উত্তোলন বন্ধে প্রধান বাধা নীতিগত বিভ্রান্তি। ২০১০ সালের বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে 'পরিকল্পিতভাবে বালু ও মাটি উত্তোলন ও বিপণন' উৎসাহিত করা হয়েছে। সেই সুযোগই গ্রহণ করেছে বালুদস্যুরা। ইজারা ব্যবস্থায় তাদের জন্য নির্ধারিত আয়তন ও পরিমাণের অনেক বেশি বালু তুলে থাকে তারা। এ ধরনের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে রূপাইছড়া রাবার বাগান এলাকায়। আলোচ্য আইনে যে ধরনের জায়গায় বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ করা আছে, ইজারাদাতা জেলা প্রশাসনকেও তা কমই মেনে চলতে দেখা যায়। বালু উত্তোলনে সরকার যে রাজস্ব পায়, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যগত ক্ষতি তার থেকে অনেক বেশি। বালু উত্তোলনের বিরূপ প্রভাবে নদীভাঙন, পাহাড় ও টিলাধস, বনভূমি উজাড় বাড়ছে। এই ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অবৈধ বালু উত্তোলন কঠোর হস্তে দমনের পাশাপাশি খোদ আইনটিও পর্যালোচনার দাবি রাখে। কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মুনাফার জন্য দেশের ও দশের এত বড় ক্ষতি চেয়ে চেয়ে দেখা উচিত হবে না।

No comments

Powered by Blogger.