১৮ অতিরিক্ত সচিব ও ৬৬ যুগ্ম সচিব ঝুঁকিতে by আশরাফুল হক রাজীব

মহাজোট সরকারের শুরু থেকেই ওএসডি হয়ে থাকা অর্ধশতাধিক কর্মকর্তার সামনে বাধ্যতামূলক অবসরের খৰ ঝুলছে। বিশেষ করে তাঁদের মধ্যে যাঁরা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস),
বিভিন্ন জেলার ডিসি বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের এভাবে অবসরে পাঠানোর সম্ভাবনা প্রবল। গত সাড়ে চার বছরে যেখানে মাত্র একজনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে, সেখানে গত এক সপ্তাহেই দুজনকে পত্রপাঠ বিদায় করা হয়েছে। দুজনই ওএসডি কর্মকর্তা। বর্তমান সরকার মেয়াদের শেষ সময়ে এসে প্রশাসন পরিচালনায় বিএনপির পথে হাঁটছে। পূর্বসূরিদের মতো বেছে নিয়েছে বাধ্যতামূলক অবসরদানের মোক্ষম অস্ত্র।
সরকারের এই সিদ্ধান্তে দীর্ঘদিন থেকে ওএসডি হয়ে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যেই কেবল আতঙ্ক বিরাজ করছে না, বর্তমান সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পিএস, বিভিন্ন জেলার ডিসি বা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাও এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। তাঁদের বক্তব্য হলো, এ রকম চলতে থাকলে ক্ষমতার পালাবদল হলে তাঁদের এর চেয়েও খারাপ পরিণতি ভোগ করতে হবে। কারণ প্রতিশোধ সব ক্ষেত্রেই বেশি খারাপ হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যে দুইজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে, তাঁদের আইন বহির্ভূতভাবে অবসর দেওয়া হয়নি। কারো চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হলেই গণকর্মচারী (অবসরগ্রহণ) আইনে সরকারকে অবসর দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আর যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ওএসডি হয়ে আছেন, যাঁদের সার্ভিসের প্রয়োজন নেই, তাঁদেরকে সরকার কেন বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেবে?'
বর্তমানে ছয় শতাধিক কর্মকর্তা ওএসডি রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তিন শতাধিক শিক্ষাছুটি, সংযুক্তি, লিয়েন ও পদায়নজনিত কারণে ওএসডি। অবশিষ্ট ওএসডি কর্মকর্তাদের কোনো কাজ নেই, বসার জায়গা নেই। তাঁরা সচিবালয়ের বারান্দায় ঘুরে বেড়ান। কর্মরত সহকর্মী-বন্ধুদের রুমে বসে আড্ডা দেন। তাঁরা পরিবার ও সামাজিকভাবেও হেয় হচ্ছেন।
ওএসডি কর্মকর্তাদের মধ্যে সচিব রয়েছেন দুইজন। অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার ৩৯ জন কর্মকর্তা ওএসডি হিসেবে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৮ জন বর্তমান সরকারের শুরু থেকেই ওএসডি হয়ে আছেন। যুগ্ম সচিব ওএসডি আছেন শতাধিক। তাঁদের মধ্যে ৬৬ জন দীর্ঘ সময় ধরে ওএসডি। একইভাবে উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব এমনকি সহকারী সচিবও ওএসডি রয়েছেন।
সরকারের প্রায় শুরু থেকেই ১৮ জন অতিরিক্ত সচিব ওএসডি হয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন মোখলেসুর রহমান, আকমল হোসাইন আযাদ, ড. শেখ আবদুর রশীদ, মাহমুদুল করীম, আসলাম ইকবাল, আবুবকর মোহাম্মদ শাজাহান প্রমুখ। মোখলেসুর রহমান প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি সাইফুর রহমানের নিজ জেলা মৌলভীবাজারের ডিসির দায়িত্ব পালন করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিবেরও দায়িত্ব পালন করেছেন। আকমল হোসাইন আযাদ সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদের পিএস ছিলেন। তিনি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও ছিলেন। ড. শেখ আবদুর রশিদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের প্রথম স্থান অধিকারী এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় তদন্ত শেষ হয়েছে। জোট সরকারের সময় তিনি টাঙ্গাইলের ডিসি ছিলেন। মাহমুদুল করীম যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ মিশনের ইকনোমিক মিনিস্টার ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালকেরও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বহুল আলোচিত কর্মকর্তা নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ফাইল উপস্থাপন করেছিলেন। আসলাম ইকবাল সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ারের পিএস ছিলেন। আবুবকর মোহাম্মদ শাজাহান ঝিনাইদহের ডিসি ছিলেন।
এ ছাড়া জোট সরকারের সময়ের ডিসি আফতাব হাসান, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব মাসুদ এলাহী, মফিজুল করীম, এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর সাবেক মহাপরিচালক মুসতাক হাসান মো. ইফতেখার, সাবেক এপিডি ও পরিবহন কমিশনার আবুল কাশেম, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হুমায়ুন কবীর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা মাকসুমুল হাকীম চৌধুরী প্রমুখ কর্মকর্তাও সরকারের প্রায় শুরু থেকে ওএসডি অবস্থায় রয়েছেন। এ ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারের মামুনুর রশিদ চৌধুরী, মাহবুবুল আলম ও ইউলিয়ম অতুল কুলুন্তুলুও সরকারের প্রায় শুরু থেকে ওএসডি হয়ে রয়েছেন।
শতাধিক ওএসডি যুগ্ম সচিবের মধ্যে ৬৬ জন সরকারের প্রায় শুরু থেকেই ওএসডি হয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যেও অনেকে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে যেসব যুগ্ম সচিব ওএসডি অবস্থায় রয়েছেন, তাঁরা হচ্ছেন সাতক্ষীরার সাবেক ডিসি ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক ড. আকরামুল হক, ঢাকার ডিসি ও ডিভিশনাল কমিশনার আবদুল বারী, উত্তরা ষড়যন্ত্রের জন্য বহুল আলোচিত এ কে এম জাহাঙ্গীর, ঢাকার ডিসি ও বিমানের এমডি ড. এম এ মোমেন প্রমুখ।
সরকার গত ২৯ মে ওএসডি অতিরিক্ত সচিব নাসিমুল গণিকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়। নাসিমুল গণি সাবেক স্পিকার ও বিএনপি নেতা জমিরউদ্দিন সরকারের পিএস ছিলেন। গত ২ জুন ওএসডি যুগ্ম সচিব মো. শফিউল্লাহকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়। শফিউল্লাহ ছিলেন চারদলীয় জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামী নেতা মতিউর রহমান নিজামীর পিএস। এর আগে ২০০৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তথ্যসচিব আবু করিমকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয় সরকার। 'বাগানে ফুটে আছে অসংখ্য গোলাপ' নামের কবিতার বইয়ে আবু করিম আপত্তিকর ইঙ্গিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে।
গত বিএনপি সরকারও ১৯৭৪ সালের অবসর আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে। সেই সময় ১১১ জন মেধাবী কর্মকর্তাকে ঢালাওভাবে অবসর আইনের ফাঁদে ফেলে চাকরিচ্যুত করে। যাঁদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল তাঁদের মধ্যে সচিব এ এইচ এম নুরুল ইসলামের ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের বিষয়ে একটি তদন্তের নির্দেশ দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের রোষের শিকার হন। এ ছাড়া যুগ্ম সচিব শাজাহান সিদ্দিকী বীরবিক্রম, মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী বীরপ্রতীক, শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার, পুলিন বিহারী দেব প্রমুখ মেধাবী কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
বিএনপি সরকার বাধ্যতামূলক অবসর দিলেও পরে উচ্চ আদালত তাঁদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। চাকরিচ্যুত হাতেম আলী খান মামলা করলে আদালত শুধু চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ারই নির্দেশ দেননি, তাঁদের সব আর্থিক পাওনাও মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু আদালতের এ মামলার রায় বের হতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। এই সময়ে বেশির ভাগ কর্মকর্তারই অবসরের বয়স হয়ে যাওয়ায় তাঁরা আর চাকরিতে ফিরতে পারেননি। তাঁরা চাকরিতে ফিরতে না পারলেও আদালত তাঁদের আগের তারিখে (ভূতাপেক্ষ) পদোন্নতি দেওয়ার নির্দেশ দেন। এর ফলে কর্মকর্তারা দুই তিন ধাপে পদোন্নতি পান। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাধ্যতামূলক অবসর আইনের যথেচ্ছ ব্যবহারের মাসুল দিতে হয়েছে বর্তমান সরকারকে। অবসরে পাঠানো কর্মকর্তাদের পাঁচ থেকে সাত বছরের বকেয়া বেতন, পেনশন, বিভিন্ন ভাতাসহ তাঁদের প্রাপ্য সব আর্থিক সুবিধা বকেয়া হিসাবে পরিশোধ করতে হয়েছে। এমনকি ওই সময়ের টেলিফোন ও খবরের কাগজের বিলও তাঁদের পরিশোধ করতে হয়েছে। কর্মকর্তাদের এসব পাওনা পরিশোধে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৫০ কোটি টাকা।
১৯৭৪ সালের গণকর্মচারী অবসর আইনে সরকারকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইনের ৯-এর ২ ধারায় বলা হয়েছে, 'চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যেকোনো সময়, সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করিলে, কোনোরূপ কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে যেকোনো গণকর্মচারীকে চাকরি হইতে অবসর প্রদান করিতে পারিবে।' আইনের এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সরকারের মনঃপূত না হলেই কর্মকর্তাদের বিদায় করা হচ্ছে।
বর্তমান সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম নীতিনির্ধারক মন্ত্রীর পিএস নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, মন্ত্রীর পিএস হলেই দলবাজ হয় না। মন্ত্রী আমাকে পছন্দ করেছেন আমার ফলাফল দেখে। আমি জীবনের সব পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় হয়েছি। বিএনপি ক্ষমতায় এলে কি তাহলে আমাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেবে? কিংবা পদোন্নতি বঞ্চিত বা ওএসডি করবে? পরিস্থিতির কারণে আমি পিএস হয়েছি। অনেক কর্মকর্তাকে প্রেক্ষাপট বাধ্য করে পিএস হতে। কোনো সরকারেরই উচিত না এই আইনের ফাঁদ তৈরি করা। বর্তমান সরকার করলে নতুন সরকার এসে প্রতিশোধ নেবে। সেই প্রতিশোধ হবে আরো বেশি পরিকল্পিত ও ভয়ঙ্কর।
ঢাকা বিভাগের একজন জেলা প্রশাসক বলেছেন, সবচেয়ে মেধাবী কর্মকর্তাকে ডিসি বানানো হয়। আর সেই কর্মকর্তাকে যদি ওএসডি, পদোন্নতি বঞ্চিত করা বা বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়, তাহলে রাষ্ট্র বঞ্চিত হবে। কারণ একজন কর্মকর্তা বানাতে অনেক শ্রম দিতে হয়। অনেক অর্থ বিনিয়োগের ফসল একজন কর্মকর্তা। ঢাকা বিভাগের এই ডিসি অবসর আইনের বাধ্যতামূলক অংশ বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেন। একই পরামর্শ দিয়েছিল রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশন (আরআরসি)। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খানের নেতৃত্বে এ কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু বর্তমান সরকার আরআরসির সুপারিশ আমলে নেয়নি। ১৯৭৪ সালের এ কালো আইনকে জিইয়ে রাখা হয়েছে সরকারের স্বার্থে। এই আইন দিয়ে সরকার দলবাজ কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দেয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কর্মকর্তাদের বিদায় করে দেওয়াটা বাধ্যতামূলক অবসর না বলে চাকরিচ্যুতি বলা উচিত। দেশের সবচেয়ে বড় আদালত সুপ্রিম কোর্ট অসংখ্য মামলার রায়ে ১৯৭৪ সালের গণকর্মচারী (অবসর) আইন বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছেন। এসব পুরনো বিষয়। দেশের সব মানুষ জানে। এগুলো বলে কোনো লাভ নেই।'

No comments

Powered by Blogger.