ইতিকথা by অজয় দাশগুপ্ত

এক যুগ আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে নবীন অফিসারদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমার বিষয় ছিল সরকারি-বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণ।
ওই দিন আলোচনায় আরও ছিলেন সাবেক এক সরকারি কর্মকর্তা। তার সঙ্গে অল্প সময় আলোচনা হয়। তিনি জানান, ১৯৬৬ সালের ৭ জুন পূর্ব পাকিস্তানের ছয় দফা কর্মসূচির সমর্থনে এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব আওয়ামী লীগ নেতার মুক্তির দাবিতে যে হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল তাতে রাজধানী ঢাকা এবং আশপাশের শিল্পাঞ্চলে বিপুল সাড়া মিলেছিল। মিছিলে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের বাইরেও শ্রমজীবীদের সাড়া ছিল বিপুল এবং প্রাদেশিক সরকার লাঠি-গুলি-টিয়ার গ্যাসে তা দমন করতে চেয়েছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যে ব্যক্তির সঙ্গে কথা হচ্ছিল তিনি তখন অবসরপ্রাপ্ত। তিনি বলেন, পুলিশের গুলিতে অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়। 'আমি তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। ছয় দফা যখন লাহোরে ঘোষণা করা হয়, তখন পূর্ব পাকিস্তানের পত্রিকায় তা প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। কেবল ইত্তেফাক এক লাইনের একটি খবর ছেপেছিল। ৭ জুন গভর্নর মোনায়েম খানের নির্দেশ ছিল, সরকারি প্রেসনোটের বাইরে কোনো কিছু পত্রিকায় লেখা যাবে না। আমিসহ কয়েকজন কর্মকর্তা ছিলাম ছয় দফার সমর্থক। কিন্তু তা প্রকাশের সুযোগ ছিল না। আমাদের ওপর প্রেসনোট লেখার নির্দেশ আসায় আমরা এ সুযোগ কাজে লাগাতে সচেষ্ট হই। আমরা এমনভাবে প্রেসনোটটি লিখি, যাতে আন্দোলনে বিপুলসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণের বিষয়টি স্পষ্ট হয়।'
ওই সময়ে দৈনিক 'সংবাদ' একটি সাহসী ভূমিকা রেখেছিল। আহমদুল কবিরের সম্পাদিত এ পত্রিকা ৮ জুনের সংবাদপত্র প্রকাশ করেনি। পরের দিন (৯ জুন) তারা পাঠকদের জানায়, সত্য প্রকাশে সরকারের হস্তক্ষেপের কারণেই তারা একদিন পত্রিকা প্রকাশ করেনি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আমাদের সংবাদপত্র বিভিন্ন সময়ে অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের অগি্নঝরা দিনগুলোতে তারা সামরিক কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেছে। ৭ জুনের প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ না করার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রবল চাপের প্রতিবাদ করতে গিয়ে দৈনিক সংবাদ যে ভূমিকা রেখেছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সেটা মাইলফলক হয়ে রয়েছে। এ নীরব প্রতিবাদ কার্যত ছিল প্রবলভাবে বাঙ্ময়।
৭ জুনের পরের কয়েকটি মাস রাজপথ উত্তপ্ত ছিল না। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক মনু মিয়া রক্ত দিয়েছেন। কিন্তু তীব্র দমননীতির কারণে তার প্রতিবাদ তেমন জোরালো করা যায়নি। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের পাশাপাশি ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী তখন কারাগারে। আরেক দল হুলিয়া মাথায় নিয়ে গোপনে জনগণের মধ্যে কাজ করছে ঝুঁকি নিয়ে। অবশেষে বাঁধ ভাঙল ১৯৬৯ সালে জানুয়ারিতে। ছাত্রদের ১১ দফা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হলো স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা। ছাত্রদের ডাকে রাজপথে নেমে এলো লাখ লাখ মানুষ। মুক্ত হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। জনগণের কাছে হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। ক্রমে দেশকে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে গেলেন স্বাধীনতার পথে। তিনি সঠিকভাবেই বলেছিলেন, ছয় দফা স্বাধীনতার পথে পেঁৗছানোর সেতু। এ সেতু অতিক্রমের সময় যারা আত্মদান করেছে, তাদের স্মরণে আমাদের কখনও কার্পণ্য নেই।

No comments

Powered by Blogger.