তুষ্টি-অসন্তুষ্টির ভারসাম্যই প্রাধান্য পেয়েছে স্ববিরোধিতা নিয়ে বড় বাজেট

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জন্য প্রায় সোয়া দুই লাখ কোটি টাকার বাজেট জাতির সামনে উপস্থাপন করলেন।
এতে নানা কিছু করতে চাওয়ার বিপুল প্রত্যাশার যে প্রতিফলন অর্থমন্ত্রী ঘটিয়েছেন, তা অনেকাংশেই বাস্তবতা থেকে দূরে। একদিকে তিনি বিভিন্ন শ্রেণীগোষ্ঠীকে তুষ্ট করতে চেয়েছেন, অন্যদিকে আবার সম্পদ সংগ্রহে সাধারণ মানুষের ওপর একটু বেশি চাপ তৈরি করেছেন। ফলে বাজেটে স্ববিরোধিতাও কম নয়, বরং বাজেট বাস্তবায়নের প্রথাগত চাপটি আরও বেড়েছে।
ব্যক্তির করমুক্ত আয়ের সীমা কিছুটা বাড়িয়ে তিনি তাঁদের স্বস্তি দিতে চাইলেও বিভিন্নভাবে সীমিত ও নির্দিষ্ট আয়ের বহু মানুষকে সুকৌশলে করের আওতায় নিয়ে আসা হবে। ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আবার ফ্ল্যাট, প্লট বা জমি কিনে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে অর্থমন্ত্রী একদিকে জমি-বাড়ির বাজারদর ওপরের দিকে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা যেমন করেছেন, তেমনি ভবিষ্যতেও কর ফাঁকি দেওয়াকে প্রকারান্তরে উৎসাহ জুগিয়েছেন। এটা কতটা নৈতিক ও যৌক্তিক? একই সঙ্গে সম্পদশালীদের ওপর সম্পদের স্ফীতি অনুসারে বাড়তি সারচার্জ আরোপ করার মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য রোধের একটা চেষ্টা রয়েছে।
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রাখার ঘোষণা এসেছে বাজেটে। এর ফলে যোগাযোগ খাতের সার্বিক ব্যয় বরাদ্দ অনেক বেড়ে গেলেও বাস্তবে সড়ক, নৌ ও রেলে বরাদ্দ তেমন বাড়েনি। রেলওয়ের উন্নয়নের পাঁচসালা পরিকল্পনার বিশাল বিবরণী তুলে ধরলেও রেলওয়ের স্লিপার আমদানির ওপর শুল্কহার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি স্বল্প মেয়াদে বাড়তি রাজস্ব দিলেও মধ্য মেয়াদে রেলওয়ের লোকসানের বোঝা বাড়াতে পারে। কৃষি খাতে মোট বরাদ্দ কমেছে মূলত ভর্তুকি কমানোয়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গতানুগতিকতার বাইরে কিছু নেই। তবে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ যথাযথ হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে উন্নয়ন প্রকল্প নির্বাচন ও তাতে বরাদ্দ দিতে হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে চেয়েছেন। সে জন্য নানা করছাড় দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন শিল্প খাতে কর অবকাশ ও কর অব্যাহতির সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। এগুলো অবশ্যই ইতিবাচক দিক। আবার এটা করতে গিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভোক্তার স্বার্থও উপেক্ষিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনয়নের দুরূহ কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করা যায়নি বলেই আমাদের ধারণা।
যেকোনো রাজনৈতিক সরকার যখন তার মেয়াদের শেষ দিকে আসে, তখন তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে অনিয়ম-দুর্নীতি বেশি প্রকাশিত হতে থাকে। আর তা জনগণের সামনে তুলে ধরার কাজটি করে সংবাদপত্র। ফলে সংবাদপত্রের প্রতি একধরনের বৈরী মনোভাব তৈরি হয় সরকারের, সংবাদপত্রকে চাপে রাখার প্রয়াসও পরিলক্ষিত হয়। বাজেটে সংবাদপত্রের নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করে নিয়ে অর্থমন্ত্রী কি সেই বার্তাটিই দিলেন?

No comments

Powered by Blogger.