প্রাকৃতিক সম্পদ-এই সমুদ্র লইয়া কী করিব! by শেখ রোকন

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বহুল উদ্ধৃত বাক্যটিকে_ এই জীবন লইয়া কী করিব_ ব্যক্তিগত জীবনের বদলে সামষ্টিক সমুদ্রের ক্ষেত্রেও অনায়াসে ব্যবহার করা যায়। কেবল আজ (৮ জুন) বিশ্ব মহাসাগর দিবসকে সামনে রেখেই নয়; ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটকে প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেও প্রশ্নটি উঠতে পারে।
আমরা বহু বছর সমুদ্রসম্পদের ব্যবহার দূরে থাক, সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করার মতো প্রাথমিক কর্তব্য নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করিনি। বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশের সমুদ্রসীমা নেই। 'ল্যান্ডলকড' ওইসব জাতি জানে সার্বভৌম সমুদ্রপথের কী মর্যাদা! আমাদের বিস্তীর্ণ সমুদ্রসীমা, দীর্ঘ তটরেখা অবহেলায় বহুদিন পড়ে থেকেছে পাদদেশে। আমাদের সমুদ্রগামী জেলেরা জলদস্যু ও ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস-নিম্নচাপের মুখে জীবনবাজি রেখে মৎস্য আহরণে দুঃসাহসী 'অভিযান' পরিচালনা করেছে। মাঝে-মধ্যে নৌবাহিনীর নিয়মিত মহড়া হয়েছে। আর চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের প্রয়োজনে সাগরের বুক চিড়ে জাহাজ যাতায়াত করছে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ সমুদ্রের পারে উইন্ড মিল বসিয়ে হাওয়াই বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথাবার্তা বলেছেন। হালে এর তলদেশ দিয়ে ফাইবার অপটিক টানিয়ে ইন্টারনেটের গতি বাড়িয়েছি আমরা। এর বাইরে আমাদের কাছে সমুদ্র বহুকাল ছিল 'পৃথিবীর দীর্ঘতম' সৈকতে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাওয়া কিংবা প্রবাল দ্বীপে প্রমোদ বিহারে যাওয়ার মতো রোমান্টিক উপাদান।
গত দশকে সমুদ্রবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের প্রশ্ন ওঠার পর; আমাদের চিহ্নিত কিছু ব্লক ভারত ও মিয়ানমারও দাবি করার পর এবং জাতিসংঘে সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত দাবি পেশের সময়সীমা প্রায় শেষ পর্যায়ে আসার পর; প্রাকৃতিক সম্পদের বিস্তীর্ণ আধার এবং কৌশলগত সুরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চল সম্পর্কে আমাদের টনক নড়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে উপকূলে দুর্যোগের পরম্পরা, স্থায়িত্ব ও ধরন পরিবর্তনের পর ওই অঞ্চলের ভৌত সুরক্ষা নিয়েও আগের তুলনায় মনোযোগ বাড়ে। লোনা ও মিঠা পানির মিশ্রণের সঙ্গে 'বিশ্বের বৃহত্তম' প্রাকৃতিক গরানভূমি সুন্দরবনের টিকে থাকার সম্পর্ক এবং ক্রমবর্ধমান দুর্যোগে এই 'প্রাকৃতিক ঢাল' কীভাবে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করে, সেসব স্পষ্ট হওয়ার পর মোহনা অঞ্চলের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকে।
এবার দেখা গেল, মাননীয় অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় মৎস্য খাত উন্নয়ন প্রসঙ্গে বঙ্গোপসাগরে নতুন নির্ধারিত সমুদ্রসীমায় মৎস্য আহরণ কেন্দ্র চিহ্নিতকরণের উদ্যোগের কথা বলেছেন। উত্তম প্রস্তাব। মিঠা পানির মৎস্যসম্পদ যখন জলাভূমি ভরাট, দূষণ ও কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের কারণে ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে, তখন অভ্যন্তরীণ পুষ্টি এবং রফতানি স্বাস্থ্য টিকিয়ে রাখার জন্য সমুদ্রের কাছেই হাত পাততে হয় বৈকি! কিন্তু সামুদ্রিক সম্পদ কি অফুরন্ত? আমাদের জলসীমায় কী পরিমাণ মাছ আছে, বার্ষিক কী পরিমাণ আহরণ করা হলে সেগুলোর প্রজনন ও মজুদ বিনষ্ট হবে না, সে-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত কি আমাদের আছে? তা না করেই কেবলই আহরণ ক্ষেত্র চিহ্নিত করা কি ঠিক? আমাদের জলসীমায় অন্যান্য দেশের জেলেরা নেমে কী কায়দায়, কী পরিমাণ মাছ ধরে নিয়ে যায়, তার হদিস কি আমরা রাখি। খুব সম্প্রতি থাইল্যান্ড আগ্রহ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ থেকে জেলে জনশক্তি রফতানির। নির্বিচার স্বাগত জানানোর আগে এর নিকট কারণ ও দূরবর্তী পরিণতি কি আমরা ভেবে দেখেছি? জীবন হাতে নিয়ে সমুদ্রগামী জেলের জানমাল নিয়ে যারা পৈশাচিক খেলায় মেতে ওঠে, সেই জলদস্যুদের নিবারণের ব্যাপারেই বা কর্তৃপক্ষ কতটা সাফল্য, নিদেনপক্ষে আন্তরিকতা দেখাতে পেরেছে, সেই প্রশ্নও উঠবে।
সমুদ্রসীমায় মৎস্য ছাড়া অন্যান্য জলজ সম্পদ আহরণের বিষয়টিও এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট। গত বছর মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মীমাংসিত হওয়ার পর সমকালের পক্ষে এর নেপথ্য নায়ক রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ খুরশেদ আলমের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, জ্বালানি ও মাছ ছাড়াও পলিমেটালিক সালফাইডসহ কপার, ম্যাগনেশিয়াম, নিকেল সংগ্রহ করা যাবে বঙ্গোপসাগর থেকে। দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান এসব খনিজ পদার্থ আহরণ নিয়ে ভাবতে হবে। তারপর ভাবনা-চিন্তা কতদূর এগিয়েছে?
বাজেট বক্তৃতায় জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায় সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধারের জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে ক্রস ড্যাম ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের যে পরিকল্পনার কথা অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তাও কি নতুন কিছু? সত্তর দশক থেকেই 'বাংলাদেশের সমান ভূমি' জেগে ওঠার সংবাদ আমরা দেখে আসছি। কিন্তু বাস্তবে কতটা ভূমি পেয়েছি? গত চার দশকে নোয়াখালী ও ভোলার কতটা ভূমি বরং সাগরে বিলীন হয়েছে? দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন পানি বিশেষজ্ঞ একবার বলেছিলেন, ভূমি উদ্ধার পরিকল্পনা আসলে একচোখা। এতে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। এখানে কেবল চর জেগে ওঠার হিসাবই করা হয়। ওইসব বাঁধের প্রতিক্রিয়ায় অন্যদিকে কত ভূমি বিলীন হতে পারে, সেই হিসাব থাকে না। যাই হোক না কেন, বিষয়টি নিয়ে সামগ্রিক চিত্র ও সমন্বিত চিন্তা-ভাবনার অভাবই আমরা খালি চোখে লক্ষ্য করি।
একই ধরনের ধরি মাছ না ছুঁই পানি জাতীয় আলোচনা রয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের সক্ষমতা ও সচলতা বৃদ্ধি নিয়ে যেমন দীর্ঘ আলোচনা চলছে, তেমনই আলোচনা নতুন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন নিয়ে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে আগে এ নিয়ে জনপরিসরে আলোচনা শোনা যায়। মোড়ের চায়ের দোকানগুলোতেও এমন আলোচনা শোনা যায় যে প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের মধ্যে এর নির্মাণ ও পরিচালনা কর্তৃত্ব নিয়ে দর কষাকষি চলছে। সেই আলোচনা অনেক সময় 'ঘাঁটি স্থাপন' পর্যন্তও চলে যায়। এবার অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কয়েকটি পর্যায়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। ইতিমধ্যে 'সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর আইন-২০১২' মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর এখন 'কতিপয় রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে' আলোচনা চলছে। তার মানে বিষয়টি আর কানাকানির পর্যায়ে নেই। কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনার বিষয়ে কি নাগরিক সমাজ, দেশীয় বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে যথেষ্ট আলাপ-আলোচনা হয়েছে? আমরা জানি না।
বঙ্গোপসাগরের যে বিষয়টি একেবারে অনালোচিত থেকে যায়, তা হচ্ছে দূষণ। এবারের বাজেট বক্তৃতাতেও দেখা গেল অর্থমন্ত্রী 'পরিবেশগত সংকটাপন্ন' নদীগুলোকে শিল্প দূষণ থেকে রক্ষার জন্য ব্যবস্থা ও বরাদ্দের কথা বলছেন; কিন্তু সমুদ্র দূষণ নিয়ে কোনো কথা নেই। অথচ সমুদ্র-তীরবর্তী শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো সমুদ্র দূষণ ঘটিয়েই চলছে। এর কারণে আমাদের মূল্যবান মৎস্য ও জলজ সম্পদ হুমকির মুখে পড়েছে। পড়ছে উপকূলীয় বনাঞ্চলও। পেট্রোলিয়াম ও রাসায়নিকবাহী জাহাজডুবি কিংবা দুর্ঘটনার কারণে 'মাইলের পর মাইল' বিস্তৃত ক্ষতিকর আস্তরণের সচিত্র সংবাদ বহুবারই দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে নাগরিকদের। কিন্তু সমুদ্রকে দূষণমুক্ত করার কোনো উদ্যোগই চোখে পড়ে না। ভারত মহাসাগরের বঙ্গীয় ব-দ্বীপ সংলগ্ন অঞ্চলকে যদি চরিত্রগত দিক থেকে পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখা না যায়, তাহলে সমুদ্রসম্পদ আহরণের স্বপ্ন এক পর্যায়ে দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে। ভাবতে হবে জন ও প্রাণিজ স্বাস্থ্যের কথাও। একই কথা বলা চলে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ব্যাপারেও। 'জাতীয় স্বার্থ রক্ষা'র প্রশ্ন তো আছেই; এসব তৎপরতায় পরিবেশ-প্রতিবেশ বাধ্যবাধকতা কতটা মেনে চলা হচ্ছে? মিয়ানমারের সঙ্গে মীমাংসার পর ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আমরা কতটা দক্ষ ও কৌশলী হতে পারি, সেদিকে সবার নজর থাকবে।
সবমিলিয়ে, বিশ্ব মহাসাগর দিবস উপলক্ষে স্বল্প পরিসরে বলা যায়, সমুদ্রসীমা ও সম্পদ নিয়ে গোটা বিশ্ব যখন আরও সংহত ও সমন্বিত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, তখন আমরা যেন বিক্ষিপ্ত উদ্যোগ কিংবা বিস্তর নির্লিপ্ততায় মগ্ন। সন্দেহ নেই, ইতিমধ্যে যথেষ্ট সময় ব্যয় হয়েছে। কিন্তু সমুদ্রসীমা ও সম্পদ নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা ও কার্যকর উদ্যোগের সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি।
স সাংবাদিক ও গবেষক
ংশৎড়শড়হ@মসধরষ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.