আইনি প্রক্রিয়া বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ তারেককে ফিরিয়ে আনতে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ by কামাল আহমেদ

সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে নিতে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
হাইকমিশনের কর্ম-কর্তারা জানান, বিদেশে অবৈধ অর্থ লেনদেনের মামলায় তারেকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশের একটি আদালত পররাষ্ট্রসচিবের প্রতি নির্দেশ জারি করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনকে নির্দেশ দেয়। হাইকমিশন সেই নির্দেশ অনুযায়ী, অভিযুক্ত তারেক রহমানকে প্রত্যর্পণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে একটি চিঠি ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা হস্তান্তর করেছে। গত ৩১ মে এসব নথিপত্র ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো হয়।
কর্মকর্তারা আরও জানান, আদালতের আদেশে ইন্টারপোলের সহায়তায় প্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকরের নির্দেশ থাকায় ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো চিঠিতেও একই অনুরোধ জানানো হয়েছে। হাইকমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরা এখন ব্রিটিশ সরকারের জবাবের অপেক্ষায় আছেন।
প্রায় চার বছর পর গত ২০ মে লন্ডনে দলীয় সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার পর বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার একটি আদালত তারেক রহমানকে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তামিল করার নির্দেশ দেন।
এক দিন আগে আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ঢাকায় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সরকার ইন্টারপোলের মাধ্যমে তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার সম্পন্ন করবে। কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি ও পলাতক অপরাধীর বিষয়ে ইন্টারপোলের ভূমিকা শুধু সদস্যদেশগুলোর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে সীমাবদ্ধ থাকলেও সরকারের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিরোধী দল এক দিন হরতালও পালন করে। এরপর গত বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে জানান, তারেক রহমান পলাতক এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রেপ্তারি পরোয়ানার কথা ব্রিটিশ সরকারকে জানানো হয়েছে।
তারেক রহমান ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে বসবাস করলেও তাঁর অভিবাসনের ধরন সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বুধবার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, তারেক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ভিসা নিয়ে সেখানে অবস্থান করছেন। এর আগে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে, তিনি ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে সরকারিভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কেননা, ব্রিটিশ সরকার সাধারণত কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করে না এবং সেই যুক্তি দেখিয়ে ঢাকায় সফরকালে ব্রিটিশ বৈদেশিক উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী অ্যালান ডানকান এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
এ ছাড়া ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা ঠিক করা নেই। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-বিষয়ক স্থায়ী কমিটির এপ্রিল ২০১২-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৬ সাল থেকে পড়ে থাকা এ ধরনের আবেদনের স্তূপ নিষ্পত্তি হতে বছর চারেক সময় লাগবে।
লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারাও তারেক রহমানের অভিবাসনের অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত নন বলে জানিয়েছেন। তবে ঢাকায় কূটনৈতিক সূত্র রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছে, ব্রিটিশ সরকার তারেককে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে।
প্রক্রিয়াটি জটিল: অপরাধী প্রত্যর্পণের বিষয়ে ব্রিটিশ আইনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে বাংলাদেশসহ প্রায় ১০০ দেশে অপরাধী প্রত্যর্পণের সুযোগ থাকলেও এর আইনগত পদ্ধতি বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। অ্যাক্সট্র্যাডিশন অ্যাক্ট, ২০০৩ অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে (তালিকায় বাংলাদেশও আছে) যে দেশ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ফেরত নিতে চায়, সে দেশের হাইকমিশন বা দূতাবাস অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে জারি হওয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিস্তারিত এবং সাক্ষ্য-প্রমাণসহ আনুষ্ঠানিক অনুরোধ ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করবে। ওই অনুরোধের বিষয়টি ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে প্রত্যর্পণ অনুরোধটি বৈধ বা যথার্থ কি না, তা নির্ধারণ করার পর যথার্থ হলে তা আদালতে পাঠাবেন। সেখানে এ বিষয়ে দুই পর্যায়ে শুনানি হয়। প্রত্যর্পণের অনুরোধটি আইন অনুযায়ী যাতে যথাযথ হয়, সে কারণে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে প্রথমে ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের (রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী সংস্থা—সিপিএস) কাছে প্রাথমিক খসড়া জমা দিয়ে তাদের পরামর্শ নিতে হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি আদালতে পাঠালে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করা হয়, যাতে তাঁর প্রত্যর্পণের বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠানের জন্য বিচারক তারিখ নির্ধারণ করে দেন। এসব শুনানির পর আদালত অভিযোগের গুরুত্ব, অভিযোগ-সম্পর্কিত তথ্য এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির সুবিচার পাওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনা করে তাঁর সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। জেলা বিচারকের ওই রায়ের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টিতে তাঁর সিদ্ধান্ত জানান। এরপর হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে আপিলের সুযোগ থাকে। আপিল নিষ্পত্তির পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওই প্রত্যর্পণের নির্দেশ দিয়ে থাকেন।
তবে প্রত্যর্পণের অনুরোধকারী দেশে বিচার্য বিষয়ে শাস্তির ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলে ব্রিটিশ আইনে ওই অনুরোধ প্রত্যাখ্যানের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া মানবাধিকার আইনের কিছু বিধানের বিষয়ও প্রত্যর্পণ শুনানিতে বিবেচনায় নেওয়া হয়ে থাকে।
তারেক রহমানকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণাকে অবশ্য রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে চাপা দেওয়ার কৌশল বলে অভিহিত করেছেন। তারেক রহমানকে প্রত্যর্পণের জন্য আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানানো হলেও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অভিযুক্ত চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে হস্তান্তরের কোনো অনুরোধ এখনো জানানো হয়নি। মুঈনুদ্দীনকে গ্রেপ্তারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত মাসে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

No comments

Powered by Blogger.