চার সিটি নির্বাচন ২০১৩: উত্তরণের উপায় খুঁজছে আওয়ামী লীগ ক্ষোভের প্রকাশ ব্যালটে

চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটাররা ব্যালটের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এ ফলাফলে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাস কয়েক আগে এ পরিস্থিতি ভাবিয়ে তুলেছে দলটিকে।
কীভাবে এ অবস্থার উত্তরণ ঘটানো যায়, তার উপায় খুঁজছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল রোববার সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দলীয় নেতা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। একইভাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও দলের কেন্দ্রীয় ১০-১২ জন নেতার সঙ্গে নিজ বাসভবনে সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন।
স্থানীয় নির্বাচন হলেও গত শনিবারের রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্যও বিশেষ সংকেত হিসেবে দেখছে রাজনীতিক ও পর্যবেক্ষক মহল।
চার সিটিতেই বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর জয় ও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয়কে ‘অশনিসংকেত’ বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গতকাল রোববার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে পরিবর্তন করার যে ট্র্যাডিশন, আগামীতেও তা থাকবে কি থাকবে না—এ ব্যাপারটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।’
আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, চার সিটি করপোরেশনে পরাজয়ের পর দলটির নেতারা নতুন রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ করছেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে আর কোনো নির্বাচন না দেওয়ার জন্য দলে একটা চাপও সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে আর কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী পরাজিত হলে দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়তে পারেন। এর প্রভাব জাতীয় নির্বাচনেও পড়বে। যদিও ঈদের পর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কথা রয়েছে।
চার সিটি নির্বাচনের ফলকে আওয়ামী লীগের জন্য ‘সতর্কবার্তা’ বলে মনে করছেন দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, এ নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে ভুল স্বীকার, ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং ভুল সংশোধনের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ভবিষ্যতের ভুলগুলো এড়াতে উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে।
আর এ ফলকে ‘জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ’ বলে মনে করছেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাঁর দাবি, বিএনপির নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির পক্ষে এবং সরকারের ব্যর্থতার প্রতিবাদে এ বিজয়।
বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এক বিবৃতিতে বলেছেন, চার সিটিতে বিরোধী দলের প্রার্থীদের বিজয় প্রমাণ করে, সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
চার সিটি নির্বাচন সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেছেন প্রথম আলোর ঢাকা ও সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিবেদক মিলিয়ে ১০ জন সাংবাদিক। তাঁদের পাঠানো বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্থানীয় এ নির্বাচনে অতীতের মতো প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা, ভাবমূর্তি ও কর্মকাণ্ডের চেয়ে তাঁর দলের জনপ্রিয়তা এবং জাতীয় রাজনীতির বিষয়গুলো বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। শুরু থেকেই এ নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের ছায়া হিসেবে দেখা হচ্ছিল। ফলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ, শেয়ারবাজার ও হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি, বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাদের লুটপাট-দুর্ব্যবহার, বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের মতো বিষয়গুলো এ নির্বাচনের সময় আলোচনায় এসেছে। এমনকি গত ৫ মে রাতে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামকে হটাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের বিষয়টিকেও বিএনপির পক্ষ থেকে প্রচারে আনা হয়েছিল। এসব কারণে ভোটারের মধ্যে সরকারবিরোধী অবস্থান আরও জোরদার হয় এবং তাঁরা স্থানীয় উন্নয়নের বিষয়টিকে তেমন আমলে নেননি।
গতকাল রাজশাহী রেলস্টেশনের উল্টো দিকের একটি চায়ের দোকানে প্রথম আলোর প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল রাইসুল, রিয়াজ, আলিনুর, রাকিব, আবদুল কাদিরসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা সবাই গত শনিবার ভোট দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, এ এইচ এম খায়রুজ্জামান যে রাজশাহীর উন্নয়ন করেছেন, তা তাঁর শত্রুও অস্বীকার করবেন না। কিন্তু তাঁর দল আওয়ামী লীগ তো ভালো নয়।
জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, খায়রুজ্জামান রাজশাহীর অনেক উন্নয়ন করেছেন এটি সত্যি। কিন্তু স্থানীয় উন্নয়নের চেয়ে পদ্মা সেতু, হল-মার্ক ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হেফাজতের বিরুদ্ধে অভিযান, ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি ইত্যাদি কারণে মানুষের মধ্যে সরকারবিরোধী অবস্থান তৈরি হয়েছে। এসবের তোড়ে উন্নয়ন হারিয়ে গেছে।
খুলনাতেও এসব জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক বিষয় বা ক্ষোভ-বিক্ষোভ জয়-পরাজয়ে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন সদ্য বিজয়ী মেয়র মনিরুজ্জামান ও তাঁর কাছে পরাজিত তালুকদার আবদুল খালেক।
সিলেটে সরকারের জনপ্রিয়তায় ‘ভাটার টান’কে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের পরাজয়ের বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। এখানকার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম মনে করেন, প্রথমত, সরকারের সঙ্গে জনগণের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এখানে। দ্বিতীয়ত, কামরান নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি।
অন্যান্য বিষয়ের মতো হেফাজতের বিরুদ্ধে অভিযানের বিষয়টি বরিশালেও বিএনপির পক্ষ থেকে প্রচারে আনা হয়েছিল। তবে হেফাজতকে খুব গুরুত্ব দিতে রাজি নন বরিশালের ২৭টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের জোট সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি সৈয়দ দুলাল। তিনি বলেন, এখানে হেফাজতের তেমন কোনো ভোট নেই। যে কেন্দ্রটিতে হেফাজতের কর্মী-সমর্থকেরা ভোট দিয়েছেন, সেই মাহমুদিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রেই আওয়ামী লীগের শওকত হোসেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর তুলনায় সাত ভোট বেশি পেয়েছেন।
বরিশালে নবনির্বাচিত মেয়র বিএনপির আহসান হাবিবের সমর্থক বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্যসচিব মিজানুর রহমানের মতে, এ নির্বাচনকে ভোটাররা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় কয়েকটি বিষয়ে সরকারের ব্যর্থতা আছে। সেটা ভোটের সময় মানুষ বিবেচনায় নিয়েছে। তিনি মনে করেন, ‘ক্ষমতাসীনেরা যদি জনগণের মনোভাব উপলব্ধি করতে পারেন, সেটাই হবে সবচেয়ে ভালো। এ নির্বাচনকে সংকেত হিসেবে নিতে হবে। তা না হলে আগামীতে খারাপ সময় অপেক্ষা করছে।’

No comments

Powered by Blogger.