ভিন্নমত-শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ হলো ইংরেজি অঙ্ক ও বিজ্ঞান by আবু আহমেদ

আমাদের ছাত্ররা অনেক কিছুই পড়ছে। কিন্তু তাদের সব পড়া কাজে লাগে না। এর কারণ হলো অনেক শিক্ষা তারা বাধ্য হয়ে শিখছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিভাবকরা ভুল করে তাদের ভুল শিক্ষা গ্রহণ করতে উৎসাহ দিচ্ছেন।
শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রের যেটা পড়তে ও শিখতে ভালো লাগে, সেটাই পড়া উচিত। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকের মত থাকতে পারে, কিন্তু সেটা ছাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। অনেক অভিভাবক মনে করেন, তাঁর সন্তান মেডিক্যালে পড়ে ডাক্তার হবে। সে জন্য তাকে ডাক্তারিতে ভর্তি হওয়ার জন্য শুধু coaching করিয়ে চলেছে। মেধাবী হলে সে মেডিক্যালও পড়তে পারে বটে, তবে এখানে মুখ্য হলো তার aptitude। সে যদি মন-প্রাণ দিয়ে ডাক্তারি পড়তে না চায়, তাহলে পাস করে ডাক্তার হলেও ভালো ডাক্তার হবে না। কারণ যে ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করতে ইচ্ছা, ওটার পেছনে শ্রম ও মন উভয় দিতে হয়। কোনো শিক্ষাই কম মূল্যবান নয়, শিক্ষার্থী যদি সে শিক্ষাকে মন থেকে গ্রহণ করে। সহজ শিক্ষা ও কঠিন শিক্ষা বলতে কিছু নেই। কথিত কঠিন শিক্ষায় অনেকে আনন্দ পায় এবং শেষ পর্যন্ত ভালো করে। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দ অনুযায়ী বিষয় নির্বাচন না করতে পারার কারণে অনেক মেধাবী ছাত্র তাদের অপছন্দের বিষয়গুলো পড়ে বিএ, এমএ ইত্যাদি ডিগ্রি অর্জন করতে বাধ্য হচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিষয় চয়নের বেশি স্বাধীনতা আছে বটে, তবে সেটায় অপেক্ষাকৃত গরিব ছাত্রদের জন্য কোনো জায়গা নেই। অন্যদিকে অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা দেওয়ার নামে শিক্ষাকে নিয়ে ব্যবসা করতে গিয়ে অতিসস্তায় ডিগ্রির সনদ বিতরণ করছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে এখন শিক্ষার বহুমুখীকরণ হয়েছে বটে, তবে শিক্ষা মানের দিক দিয়ে অনেক নিচে পড়ে গেছে। যেকোনো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে শিক্ষার দোকান খুলে বসেছে। এতে জ্ঞান ও প্রায়োগিক বিষয়গুলো কতটা অর্জন করা হচ্ছে, তা নিয়ে আমরা সবাই শঙ্কিত। স্নাতক পর্যায়ে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে অনেক ধনী অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের বিদেশি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে ভালো শিক্ষাগত ডিগ্রি অর্জনের ব্যবস্থা করছেন। সব দেশেই কিছু নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কেবল BUET নামিদের তালিকায় আছে। অন্যদের অবস্থান অনেক নিচে নেমে গেছে। বিদেশে গ্র্যাজুয়েট স্তরে ভর্তি হতে GRE বা সমমানের অন্য পরীক্ষা দিতে হয়। বাংলাদেশের খুব কম ছাত্রই গ্র্যাজুয়েট অ্যাডমিশন টেস্টে ভালো করে। এর কারণ হলো, তারা যে পাঁচ-ছয় বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়েছে সে সময় যেসব বিষয়ে যে স্তরে শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল, সে স্তরে পড়েনি। তাদের পড়ার মধ্যে তিনটি বিষয় অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সে তিনটি হলো- ইংরেজি, অঙ্ক ও বিজ্ঞান। ইংরেজি না জানলে আজকের দিনে ভালো জ্ঞানও যেন অর্থহীন। শুধু ইংরেজিতে মোটামুটি চলনসই না হওয়ার ফলে অনেক মেধাবী ছাত্র চাকরি ও অন্য ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। একসময় ছোট শহর ও গ্রামের স্কুলগুলোতে ভালো ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া হতো। এখন ইংরেজি শিক্ষার মানে ভাটা পড়েছে। আমরা স্কুলে বাংলা মাধ্যমে পড়লেও কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে এসে ঠিকই ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে হয়েছে এবং তাতে আমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। বরং আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গিয়েছিল। শিক্ষকরা ছিলেন ভালো, মাধ্যম হলো ইংরেজি, বই ইংরেজিতে; আমাদের জন্য যেন উপযুক্ত মানের শিক্ষার ব্যাপারটা এতে উন্মুক্ত হয়ে গেল। সেটা ছিল ১৯৬৫-১৯৬৭ সালের কথা। আর গুরুত্বপূর্ণ এ জন্যই বলছি, এখন উচ্চ স্তরে প্রতিটি ক্ষেত্রে অঙ্ক লাগে। মানে হলো, অঙ্ক ব্যবহার করে বিষয়গুলোকে বোঝানো। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদিতেও অঙ্ক লাগে। অর্থনীতি ও ব্যবসাবিজ্ঞান তো সম্পূর্ণ অঙ্কনির্ভর। অঙ্কের ব্যবহার বাদ দিয়ে প্রশ্নের উত্তর লিখলে কোনো অধ্যাপকই ভালো গ্রেড দিতে চাইবেন না। অঙ্ক নিজে নিজে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কিন্তু অঙ্কটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ব্যবসাবিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যবহৃত হয়। আজকে অঙ্কের সঙ্গে যোগ হয়েছে IT বা Information Technology এবং অঙ্ক, IT, প্রকৌশল, মেডিক্যাল সায়েন্স- এসব একাকার হয়ে গেছে। এসবে কমন উপাদান হলো অঙ্ক, যে ছাত্র বা অধ্যাপক বেশি অঙ্ক জানেন তাঁর তত সুবিধা। পরিসংখ্যানবিজ্ঞান, অঙ্ক ও কম্পিউটার বিজ্ঞান এখন অন্য বিষয়গুলোকে ব্যবহার করতে অনেকে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই আমার মতে, অন্তত উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত অঙ্ককে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে পড়ানো হোক। যে ছাত্র অঙ্ক ও ইংরেজি জানে না, সেই ছাত্রকে অনেক ক্ষেত্রে বোকা সাজতে হয়। কলা ও ফাইন আর্টসেও অঙ্ক ও পরিসংখ্যান লাগে। আমার তো বিশ্বাস, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা পদ্ধতির আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ওপরে উল্লিখিত সংখ্যাবিজ্ঞান ও হিসাববিজ্ঞানের বহুল ব্যবহার আছে। আমাদের সময় স্কুলে ভালো অঙ্ক শেখানো হতো। পরে কলেজে এসে উচ্চ মাধ্যমিকে দেখলাম অঙ্কের আরো প্রসারতা। পরে স্বদেশে ও বিদেশে অর্থনীতি পড়তে গিয়ে দেখি, অঙ্ক অতি উচ্চ স্তরে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং মনে মনে ভাবতাম, আরো কেন বেশি অঙ্ক শিখলাম না। অনেক ছাত্রই বিদেশে গিয়ে আগে অঙ্ক শিখেছে, পরে তার বিষয়গুলো পড়েছে। অন্য একটা দুঃখের বিষয় হলো, আজকে বিজ্ঞান শিক্ষায় যেন ভাটা পড়েছে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে বিজ্ঞান শিক্ষার যে প্রসার ঘটেছিল, সেটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে যেন অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এই যে ছাত্র বিজ্ঞানবিমুখ হলো, এটা দেশের জন্য ভালো হয়নি। বিজ্ঞান হলো প্রযুক্তি ও অন্য শিক্ষার ভিত। কোনো সমাজই উন্নতি করেনি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ছাড়া। আজকে আমাদের দেশে ব্যবসা শিক্ষার জন্য আলাদা কলেজ স্থাপিত হয়, কিন্তু বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য আলাদা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয় না। দেশে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় আছে। নেই কেবল বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়। ভারত-পাকিস্তান বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। আমরা কেন পারি না বিজ্ঞানে এক হাজার ছাত্রকে বৃত্তি দিয়ে বিদেশ থেকে পড়িয়ে আনতে?
আমাদের পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, জীববিদ্যা- এসবে আমরা গুরুত্ব না দিয়ে ভুল করছি। সস্তার কলাশাস্ত্র পড়ালে তো বিজ্ঞানের অভাব থেকেই যাবে। বিজ্ঞান শিক্ষার অভাবটা এখনো ওভাবে অনুভূত হচ্ছে না। কিন্তু সেই অর্থে কি অন্য শিক্ষার অভাব অনুভূত হচ্ছে? বিজ্ঞান যে অতি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তো যুক্তরাষ্ট্রের ও পশ্চিমের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। কলা আর ব্যবসাবিজ্ঞান বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলে তারা তো বিজ্ঞান শিক্ষা ছেড়ে দিত। জ্ঞান ও নীতি-নৈতিকতার জন্য আমাদের শিক্ষায় কিছু থাকা দরকার। সে ক্ষেত্রে ধর্ম শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয়কেও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ছাত্রদের গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো উচিত। অঙ্ক জানল, বিজ্ঞান জানল, ডাক্তারি জানল, কিন্তু শিক্ষার্থী ভালো নৈতিকতার অধিকারী হলো না; তা হবে লোকসমাজের জন্য ক্ষতিকারক।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.