বাজেট কি উচ্চাভিলাষী ও নির্বাচনমুখী by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

আগামী অর্থবছরের জন্য (২০১৩-১৪) যে বাজেট পেশ করা হয়েছে সেখানে রাজস্বপ্রাপ্তি, বৈদেশিক অনুদানসহ আয় দেখানো হয়েছে এক লাখ ৭৪ হাজার ১২৯ কোটি টাকা এবং ব্যয় দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা।
মোট ঘাটতির পরিমাণ ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪.৬ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী আয়-ব্যয় খাতে যে পরিমাণ টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন, শেষ বাজেটে তা প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়েছেন। তবে যেটি উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হলো বৃদ্ধির হার প্রায় একই রকম। যেমন বলা হচ্ছে, নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে এবার বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে, তথ্য পর্যালোচনা করলে সে কথা ধোপে টেকে না। কেননা ঘাটতির পরিমাণ পূর্ববর্তী বছরের মতো রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য ছয় হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। অনেকে একে নির্বাচনী স্টান্ট বলতে চেয়েছেন। এখানে মনে রাখা দরকার, পদ্মা সেতু মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল। কাজের অনেক অগ্রগতি হয়েছিল। অবশ্য বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগে কঠিন অবস্থান গ্রহণ করল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবশ্যই অবস্থান নিতে হবে। কিছু শর্ত পালন সাপেক্ষে কাজটা অব্যাহত রাখা যেত।
স্বাধীনতার পর রেলপথ অব্যাহতভাবে অবহেলিত হয়ে এসেছে। এর ফলে স্বাধীনতা-পূর্বকালের তুলনায় রেলপথ সংকুচিত হয়েছে, রেলস্টেশনের সংখ্যা কমেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রুটের কয়েকটি ট্রেন ছাড়া গোটা বাংলাদেশে রেলপথে সময়সূচি বলে কিছু নেই। এবার প্রস্তাবিত বাজেটে রেলপথের জন্য পৃথক বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। এখন তো রেলওয়ে একটি পৃথক মন্ত্রণালয়। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছেন। যেমন ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথ। এ ছাড়া যমুনার ওপর রেলপথের জন্য পৃথক সেতু; কিন্তু আমরা এত স্বপ্ন দেখতে চাই না। আমরা আমজনতা বারবার যে আবেদন করছি তা হলো, রেলপথকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক। তারপর অগ্রগতির কথা, স্বপ্নের কথা। আমি একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চাই। স্বাধীনতার পূর্বে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে কয় ঘণ্টায় যেত? আর বর্তমান অবস্থাটা কী তা রেল বিভাগ ভালোভাবে জানে। প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালের অক্টোবরে নীলফামারীতে এক জনসভায় স্থানীয় দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন, আন্তমহানগর ট্রেন চিলাহাটি পর্যন্ত যাবে। এখানে উল্লেখ্য, ব্রিটিশ আমলে এবং পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান আমলে কিছুদিন পশ্চিমবঙ্গের শিয়ালদহ থেকে চিলাহাটির ওপর দিয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত বেশ কয়েকটি মেইল ট্রেন চলাচল করেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এর প্রধান কারণ যে রেলওয়ে বিভাগে দক্ষ কর্মীর অভাব। চার দশকে অবজ্ঞা ও অবহেলার ফলে রেলওয়ে বিভাগের এই করুণ অবস্থা। রেলওয়ে বিভাগে দক্ষতা বাড়ানোয় দেশ ও দেশের বাইরে কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। বর্তমান রেলওয়ে বিভাগের সব কাজ অত্যন্ত মন্থরগতিতে চলে।
পুঁজিবাজার নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা ছিল। সব কিছুর অবসান ঘটিয়ে অত্যন্ত প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়া হয়েছে পুঁজিবাজারসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে। একটা গান খুব জোরেশোরে গাওয়া হয়েছিল। শেয়ারবাজারের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকায় থোক বরাদ্দ রাখার প্রয়োজন, যাতে বাজারে মন্দার সময় সে টাকা ব্যবহার করা হবে বাজারকে চাঙ্গা করতে। শেয়ারবাজার থেকে টাকা সংগ্রহের কথা জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য। আর সেখানে যদি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ বরাদ্দ করতে হয় তাহলে সে বাজারের প্রয়োজন আছে কি? যার সঞ্চয় থাকে, তিনি শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন। টাকা ধার করে শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন- এটা হয় না। অবশ্য যাঁরা শেয়ার ব্যবসায় নিয়োজিত, তাঁরা তাঁদের নিজস্ব কৌশল ঠিক করবেন। এখানে সরকার তথা রাষ্ট্রের কিছু করার নেই। বাজেটে এই থোক বরাদ্দ ও ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে নীরব, এটা খুব ভালো সিদ্ধান্ত। এটা শেয়ারবাজার সক্রিয় হতে সাহায্য করবে। শুধু স্টক এক্সচেঞ্জ কেন, প্রায় সব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বাজেট-পূর্ব আলোচনায় সরকারের কাছে যেসব প্রস্তাব নিয়ে আসে, তার বেশির ভাগ হলো কর কমানো, কর মওকুফ ইত্যাদি। রাষ্ট্রের কাছে চাইতে হলে রাষ্ট্রকে কিছু দিতে হবে, এটা বোধহয় আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন।
এবারও বাজেটে কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব রয়েছে। অতীতে বহুবার বিভিন্ন সরকার এ কাজ করেছে। বিনিময়ে অর্জনটা কি? শেয়ারবাজারের অবস্থা দেখে তো মনে হয় না যে অলিখিত অঙ্গীকার সত্ত্বেও তেমন উল্লেখযোগ্য কালো টাকার আগমন ঘটেছে শেয়ারবাজারে।
অর্থমন্ত্রী দুটি বিষয়ে অতৃপ্ত মন নিয়ে তাঁর কার্যকাল শেষ করবেন। তিনি একাধিকবার তাঁর বাজেট বক্তৃতায় কৃচ্ছ্রসাধন ও বেল্ট টাইটের কথা বলেছিলেন। কিন্তু কেউ এ কথায় কান দেননি। অনেক সময় বলা হয়ে থাকে, বাজেটে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কথাটা ঠিক নয়। হয়তো ইচ্ছা রয়েছে, তবে তা বাস্তবায়িত হয় না বা সম্ভবপর নয়। আগামী বাজেটে জনপ্রশাসন খাতে ব্যয়ভার ১৪.৪ শতাংশ, চলতি বাজেটে ছিল ১২.৬ শতাংশ। এর অর্থ হলো সরকারি ব্যয়ে কোনো লাগাম নেই। এই কৃচ্ছ্রসাধন ও বেল্ট টাইটের কথা আসা উচিত ছিল স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে।
জনপ্রশাসনে তো জনবল মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ হবে না। অথচ বাজেটের ১৪.৪ শতাংশ অর্থ ব্যয় হবে। অর্থমন্ত্রী জেলা বাজেট প্রণয়নের কথা প্রথম থেকে বলে আসছেন। এখন বিদায়ের পূর্বে এই বলে সান্ত্বনা পাচ্ছেন যে টাঙ্গাইল জেলার জন্য জেলা বাজেট করা হয়েছে। জেলা বাজেট প্রণয়ন করার উদ্দেশ্য হলো এতে স্থানীয় জনগণের চাহিদা পূরণ হবে। কোন প্রকল্পকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে, সেটা জনগণ ঠিক করবে। সে জন্য জনগণের নির্বাচিত জেলা পরিষদ থাকতে হবে। সামরিক শাসকদের কথা বাদ দিলাম, গণতান্ত্রিক সরকারও সৎসাহস দেখাতে পারেনি কোনো নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠন করতে। সে অবস্থায় জেলায় বাজেট প্রণয়নের কথা বলা অর্থহীন। বর্তমান অবস্থায় জেলা বাজেট প্রণয়ন মানে আমলার ক্ষমতা হস্তান্তর। জেলা বাজেট যদি প্রকৃতই অর্থবহ করতে হয়, তবে তার আগে জেলা পরিষদের নির্বাচন হতে হবে।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.