দিনলিপিঃ ১৯৯৭ by তানভীর মোকাম্মেল

জুলাই ১৭, ১৯৯৭
শ্রাবণ ০২, ১৪০৪
দিনটা বাসাতে। "চিত্রা নদীর পারে"-র জন্যে অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেবার লক্ষ্যে একটা চিঠি তৈরী করলাম।
ছবিটির বাকী কাজের জন্যে অর্থ কোথায় পাব সে ব্যাপারে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ রয়েছি। এরকম একটি 'স্পর্শকাতর'(!) বিষয়ের জন্যে কেউই খুব একটা অর্থ দিতে চাইবে না। কী করব বুঝতে পারছি না। অথচ এই শীতেই ছবিটার কাজ শেষ করতে চাই। একটা জিনিষ আমি বুঝতে পারি যে আমি যে ধরণের ছবি করতে চাই এস্টাবিস্নশমেন্ট থেকে সে ব্যাপারে আমি কোনোই সাহায্য পাব না। তার একটা উদাহরণ হাতের কাছে এবারে পেলাম। তা হচ্ছে সরকারের একটা নিয়ম রয়েছে যে বাংলাদেশের কোনো ছবি যদি আন্তর্জাতিকভাবে আমন্ত্রিত হয় সেক্ষেত্রে সরকার থেকে ইংরেজীতে সাব-টাইটেল করার অর্থটি প্রদান করা হয়ে থাকে। "নদীর নাম মধুমতী" ছবিটি ফ্রান্সের উৎসবটিতে আমন্ত্রিত হোল কিন্তু আমাকে ইংরেজী সাব-টাইটেলের টাকাটা দেওয়া হোল না।
জুলাই ১৮, ১৯৯৭
শ্রাবণ ০৩, ১৪০৪
মৌলবাদীরা "শিখা চিরন্তন"-য়ের উপর হামলা করবে এরকম ঘোষণা দিয়েছে। তা' প্রতিরোধ করার জন্যে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সংগঠনগুলি আহবান জানিয়েছে। একটা হাতাহাতি সংঘর্ষ বেঁধে যেতে পারে।
ভারতে শ্রীনারায়ণ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এই-ই প্রথম ভারতে নিম্নবর্ণের কোনো মানুষ রাষ্ট্রপতি হলেন। এটা ভারতের দলিত জাতিসত্ত্বাসমূহের জন্যে এক বড় বিজয়।
বাংলাদেশে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধানের জন্যে বেশ কিছু বড় বিদেশী কোম্পানী আসছে। এরা যে অর্থলগ্নী করবে তাতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৭%-৮% হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়।
সরদার ফজলুল করিম পত্রিকায় এক ধরণের দিনলিপি লেখেন যেখানে ওঁর ইদানীংকার দৈনন্দিন কার্যকলাপ সম্পর্কে লিখে থাকেন। এক ধরণের প্রায় অর্থহীন লেখা। ভাল হোত যদি উনি চলি্লশ-পঞ্চাশ দশকের সময়কালটা সম্পর্কে লিখতেন। এই সময়কালটায় ওঁর জীবনাভিজ্ঞতা ছিল প্রগাঢ় এবং ওই সময়ের মুসলমান সমাজের অবস্থা সম্পর্কে এ যুগের পাঠকদের ধারণাও কম।
জুলাই ১৯, ১৯৯৭
শ্রাবণ ০৪, ১৪০৪
সন্ধায় বিনায়ক এল বাসায়। ও আমাকে ক্ষেতমজুর আন্দোলন নিয়ে আমার অভিজ্ঞতাটা লিখতে বলল। তেভাগা আন্দোলন ও সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন এই বিষয়ের উপর একটা বইয়ের জন্যে। ইউনিভার্সিটি প্রেস বইটি বের করবে। রাশেদ নামে একটা ছেলে টেলিফোন করে জানাল যে "অচিন পাখী"-তে আমি যেসব লালন-গবেষকদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি ফরহাদ মযহার "শৈলী" পত্রিকায় তাঁদের সমালোচনা করে একটা লেখা লিখেছে। তাঁদের দোষ তাঁরা মধ্যবিত্ত। এখন এ এক বড় সমস্যা। বুদ্ধিজীবিরা সাধারণতঃ মধ্যবিত্তই হয়ে থাকে। ফরহাদ মজহারও তাই। কেউ মধ্যবিত্ত বলে লালনকে বুঝতে পারবে না বা ব্যাখ্যা করতে পারবে না এ কী রকম কথা! অবশ্য বিনায়ক বলল যে ফরহাদ মযহারের কাজই নাকি তাই। নানারকম বিতর্ক সৃষ্টি করে আলোচনার কেন্দ্রে থাকার চেষ্টা করা।
জুলাই ২০, ১৯৯৭
শ্রাবণ ০৫, ১৪০৪
রতনদার বইটার ব্যাপারে আজ অজয়দা, মঞ্জুরুল আহসান ও সেলিম ভাইকে লিখতে বললাম। এঁরা এখন মতাদর্শগত দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে রয়েছেন। তবে স্মারকগ্রন্থটিকে আমি এসবের উধর্ে্ব রাখতে চাই।
"শিখা চিরন্তন"-য়ের উপর হামলা করবে বলে মৌলবাদীরা একটি ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু গতকাল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি তা' প্রতিরোধের লক্ষ্যে বেশ ভাল জমায়েত করাতে মৌলবাদীরা আর এগোতে সাহস করেনি। অবশ্য মূল কারণ হয়তো ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার থাকা। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এতদিন বিভিন্ন সামরিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে পেয়েই মৌলবাদীদের সাহস এতটা বেড়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তা না পেলে মৌলবাদীরা এত বড় শক্তি নয় যে তাদেরকে এদেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তি মোকাবেলা করতে পারবে না।
জুলাই ২১, ১৯৯৭
শ্রাবণ ০৬, ১৪০৪
কবি মোহাম্মদ রফিক টেলিফোন করে জানালেন যে স্মারকগ্রন্থটিতে উনি রতনদা'র উপরে একটা লেখা লিখতে চান। উনি ষাট দশকে রতনদা'র সঙ্গে এক সাথে জেলে ছিলেন। বলেছি লিখলে খুব খুশী হব।
ম্যাট্স ওঁর জন্মদিনে নিমন্ত্রণ করেছিল। ম্যাট্স ও লেনা এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সবাই মিলে গেলাম এক কোরীয় রেস্টুরেন্টে খেতে। রেস্টুরেন্টটির নাম "ইয়ং কাওয়ান"। এই-ই প্রথম আমি কোরীয় খাবার খেলাম। খাবার বেশ সুস্বাদু। ঢাকায় এখন তিনটে কোরীয় রেস্তোরাঁ হয়েছে। অবশ্য ঢাকায় এখন সব ধরণের এথনিক্যাল রেস্তোরাঁর সংখ্যাই বাড়ছে।
সরকার রমনা অঞ্চলকে নিয়ে যে সংস্কৃতি বলয় করছে সেখানে ফিল্ম সেন্টার রাখেনি। এটার প্রতিবাদে একটা লেখা লিখেছি_ "জাতীয় সংস্কৃতি কমপ্লেক্সে চলচ্চিত্র নেই কেন !"
জুলাই ২২, ১৯৯৭
শ্রাবণ ০৭, ১৪০৪
কাজী আরিফের সঙ্গে আজ কথা হোল। ও "চিত্রা নদীর পারে"-র জন্যে কিছু অর্থ দিতে রাজী হয়েছে। আগামীকাল নিতুন কুন্ডুকেও বলব।
সন্ধায় টিটুল এসেছিল বাসায়। "নদীর নাম মধুমতী"-র পোস্টারের ডিজাইন নিয়ে কিছু আলাপ-আলোচনা হোল।
সরকার রমনা অঞ্চলকে ঘিরে যে সংস্কৃতি বলয় সৃষ্টির ঘোষণা দিয়েছে তার মধ্যে চলচ্চিত্র সেন্টারকে রাখেনি। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি ছিল যে দেশে একটি ফিল্ম সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হবে। কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েই এ ব্যাপারে একটা লেখা লিখেছি। আজ লেখাটি "ভোরের কাগজ"-য়ে পাঠালাম। আমি প্রস্তাব করেছি যে ফিল্ম সেন্টারটি রমনা রেস্তোরাঁ যেখানে সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হোক। এটা আমার দীর্ঘদিনের এক স্বপ্ন যে ঢাকায় কলকাতার "নন্দন"-য়ের মত একটা ফিল্ম সেন্টার গড়ে তোলা। এ স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়িত হবে কে জানে !
জুলাই ২৩, ১৯৯৭
শ্রাবণ ০৮, ১৪০৪
নিতুন কুন্ডুকে আজ বললাম যে "চিত্রা নদীর পারে"-র ব্যাপারে কোনো আর্থিক সহযোগিতা করতে পারেন কি-না। রাজী হলেন না। অবশ্য শুনেছি ওঁর ব্যবসা বেশ ভাল চলছে। "চিত্রা নদীর পারে"-র বাকী কাজের জন্যে অর্থ কোথায় পাব তা' নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় রয়েছি। খুশী কবিরের সঙ্গে এ ব্যাপারে আজ একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলাম। আগামীকাল দুপুরে ওঁর সঙ্গে দেখা করব।
রাতে মেঘনা গুহঠাকুরতার সঙ্গে কথা হোল। ও জানাল ২৭ তারিখে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ক্লাসটি নিতে হবে তা এখন পর্যন্ত ঠিক আছে। তবে আগামীকাল ছাত্ররা হরতাল ডেকেছে। কারণ হচ্ছে আর্ট কলেজের ছাত্রদের জন্যে যে শাহনেওয়াজ ছাত্রাবাস রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নাকি সেটা ভেঙ্গে ফেলে একটা সুপার মার্কেট তৈরীর সিদ্ধান্ত নিয়েছে! খুবই অনভিপ্রেত এ সিদ্ধান্ত। আর্ট কলেজের ছাত্ররা তাহলে থাকবে কোথায়?

No comments

Powered by Blogger.