কেমন আছেন কিবরিয়া হত্যা মামলার আইনজীবী by শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল

মনটা তেমন ভালো না খবরটা শুনার পর থেকেই। অ্যাডভোকেট আলমগীর ভূঁইয়া বাবুল ক্যান্সারে আক্রান্ত। ভেতরে ভেতরে যেন একটা বেদনাময় আলোড়ন আমাকে আন্দোলিত করছিল।
একটা তরতাজা মানুষ কেমন করে এমনভাবে রোগাক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। বলছিলাম বাবুল ভাইয়ের কথাই। বাবুল ভাই বলতে আমাদের আলমগীর বাবুল ভাইয়ের কথাই বলছি। বাবুল ভাইকে যারা জানেন কিংবা ভালো করে চেনেন তারাই বলতে পারবেন লোকটা কতটা অমায়িক। তার ভেতরটা সরলতায় পরিপূর্ণ। তাকে আমি সেই ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি। আমার বড় ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাবুল ভাই, হাসিম ভাই, ইলিয়াছ ভাই, সিরাজ ভাই, টিপু ভাই ও শংকর সেন তখন ছাত্রলীগের নেতা। আমি সেই ৭০ দশকের কথা বলছি। তাদের আড্ডাই ছিল আমাদের বাসার কাচারী ঘরে আমাদের কাচারী ঘরে তাদের আড্ডায় আমাদের তখনই ডাকা হতো, যখন রাখাল দাসের স্টল থেকে সিঙ্গারা আসত। সেই বাবুল ভাই অর্থাৎ অ্যাডভোকেট আলমগীর বাবুল ভাই আজ অসুস্থ। '৭৫-এর পটপরিবর্তন হলো। পরিবারের লোকজনসহ বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের হাতে নিহত হলেন। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের তখন দুর্দিন। ছাত্রলীগের সেই দুর্দিনে অ্যাডভোকেট আলমগীর বাবুল ভাই, হাসিম ভাই, সিরাজ ভাই, টিপু ভাই, ইলিয়াছ ভাই, শংকর সেনের মতো ছাত্রনেতারা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ছাত্রলীগের পতাকা তুলে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। সবাই জানেন অ্যাডভোকেট আলমগীর বাবুল রাজনীতি করেছেন রাজনৈতিক মতাদর্শকে সামনে তুলে ধরার জন্য। সবাই স্বীকার করবেন তিনি কখনও হীনস্বার্থ উদ্ধারের জন্য রাজনীতিকে কিংবা দলীয় পতাকাকে কিংবা দলীয় পরিচয়কে কখনও ব্যবহার করেননি। আইন ব্যবসা করে যে টাকা আয় করেন তাও খরচ করেন দু'হাতে। কোন ধরনের কার্পণ্যতা তাকে স্পর্শ করেনি। আজকের দিনের মানুষ রাজনীতি করে অনেক টাকা পয়সার মালিক হয়। কিন্তু আলমগীর বাবুলদের মতো লোক রাজনীতি করে বৈষয়িকভাবে হয়তো তেমন সফল হতে পারেননি। কিন্তু মানুষের মনে ঠিকই স্থান করে নিয়েছেন। তাই দেখা যায় মানুষ যখন খবর পেল উনি মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন তখন তার চেনা জানা লোকজন কিংবা যার সঙ্গে তার ব্যক্তিগতভাবে পরিচয়ও নেই, তারাও চরমভাবে ভেঙে পড়েছেন। সবার এক কথা সরলতায় পরিপূর্ণ অ্যাডভোকেট আলমগীর বাবুলের মতো মানুষের শরীরে মরণব্যাধি ক্যান্সার বাসা বাঁধে কী করে। এই যে লেখাটা লেখছি তা লিখতে গিয়েও যেন বারবার কলমটা কাগজের বুকে আটকে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো একজন অমায়িক মানুষ যদি এমন বিপদে পড়েন, স্বাভাবিকভাবেই তার চেনা জানা মানুষজন হতাশায় ভেঙে পড়বেন। অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেবের সঙ্গে আলমগীর বাবুল ভাই নিজেও গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন। আবার কিবরিয়া হত্যা মামলাটিও তিনি চালাচ্ছেন আন্তরিকভাবে। তবে আলমগীর বাবুল এর মনের জোরেরও কমতি নেই। ভারত থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে এসে কোর্টে দেখা হওয়ার পর বাবুল ভাই আমাকে বললেন, এই টুটুল তুই আমার বাসায় যাবি। আমি যেখানে তার সামনে যেতেই ইতস্থত বোধ করছিলাম। সেখানে তিনি সেই আগের মতোই প্রাণের উল্লাসে স্নেহভরা কণ্ঠে আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, এই তুই আমার বাসায় যাস। তারপরও আমি যেন স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। বাবুল ভাইকে আপন বড় ভাইয়ের মতোই দেখে থাকি। উনার সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক খুব গভীর। আমি একটি উদাহরণ দিলেই পাঠক পাঠিকা তা বুঝতে পারবেন। আমরা যেমন আমাদের বড় ভাইকে মেজদা বলে ডাকি, উনিও আমাদের বড় ভাইকে মেজদা বলেই ডাকেন। এখন নিশ্চয়ই পাঠক পাঠিকারা বুঝতে পারছেন আলমগীর বাবুল অসুস্থ হলে আমি শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল কেন এতটাই কষ্ট পাই। পাঠকরা একথাও বুঝতে পারবেন উনার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা কেমন। উনি মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় আমি কেন, অনেকেই কষ্ট পাচ্ছেন। স্বাভাবিক আচরণ করতেও অনেকের কঠিন হচ্ছে। তারপরও কিন্তু অ্যাডভোকেট আলমগীর বাবুল ঠিক আগের মতোই সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। আমি উনাকে দেখার জন্য যেতে পারছিলাম না। মনের মধ্যে একটা দুঃখবোধ খেলা করছিল। বাবুল ভাই ফোন দিলেন, বললেন টুটুল তোকে বললাম বাসায় আসার জন্য তুই আসলি না কেন? তোর জন্য রসগোল্লা, লাল মোহন বরাদ্দ আছে, আরও কি জানি কি। আমি বললাম আপনার এখানে অনেক খেয়েছি। এখন খাবার সময় নয়, আমি আশ্চর্য হলাম উনার উত্তর শুনে। উনি ঠিক আগের মতোই স্বাভাবিকভাবে বললেন তুই এত হতাশ হচ্ছিস কেন? এখন তো আমার আনন্দ করার সময়। তুই রাজেশ খান্নার আনন্দ ছবিটি দেখিসনি? সব কিছুই মেনে নিতে হয়। আমাদের জীবন চলে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায়। আমি উনার কথায় ভেঙে পড়ি। উত্তরে বললাম রাজেশ খান্নার আনন্দ ছবিটি দেখে খুবই কেঁদেছিলাম। আপনি অবশ্যই রাজেশ খান্নার আনন্দ ছবির পরাজিত নায়কের মতো ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হবেন না। আপনি মানুষের ভালোবাসায় এই মরণব্যাধি ক্যান্সারকে অবশ্যই পরাজিত করে আমাদের নিয়ে চলাফেরা করবেন। আপনার মনের জোরই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে। আমরা যারা বাবুল ভাইকে দেখেছি তারা অবশ্যই চাইব উনি আমাদের মধ্যে থেকে আলোর দ্যুতি যেন ছড়িয়ে যান সবার মধ্যে। তার জন্য প্রয়োজন এই মানুষটিকে যেভাবেই পারা যায় ক্ষমতা অনুযায়ী সামনে চলার জন্য সহযোগিতা করে যাওয়া। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমাদের সবাইকে প্রার্থনা করতে হবে। বাবুল ভাই যেন মরণব্যাধি ক্যান্সারকে পরাজিত করে আমাদের মধ্যে সগৌরবে বিচরণ করতে পারেন। যারা তার কাছ থেকে উপকৃত হয়েছেন তাদের উচিত উনাকে নিয়ে একটু গঠনমূলক চিন্তা ভাবনা করা। আমরা তো দেখেছি প্রতিকূল অবস্থায়ও রাজনৈতিক মামলাগুলো প্রতিবার সাহসের সঙ্গে পরিচালনা করেছেন। আজ সেই মূল্য দেবার সময় এসেছে। কারণ বাবুল ভাই মানুষের জন্য অনেক কিছু করেছেন। সেই করাটা ছিল আন্তরিক। অনেকেই আজ অনেক বড় বড় জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তারা ইচ্ছে করলে এই মানুষটার জন্য একটু সহানুভূতি দেখাতে পারেন। আর ভুপেন হাজারিকার গানের ভাষায় যদি বলি 'মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য' আরও একটু যদি বলি, 'বল কি তোমার ক্ষতি জীবনের অথৈ নদী, পার হয় তোমাকে ধরে, দুর্বল মানুষ যদি'। তবে মানসিকভাবে বাবুল ভাই দুর্বল নন। তিনি আগের মতোই প্রাণ উল্লাসে পরিপূর্ণ আছেন। তাই বলছিলাম আমরা যারা বাবুল ভাইকে খুব ভালোবাসি তারা যেন তার জন্য এগিয়ে আসি ভালোবাসার দুহাত বাড়িয়ে। শুভ সংবাদ হলো রোটারি ক্লাব অফ হবিগঞ্জ বাবুল ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য ৪ লাখ দিয়েছেন। তারা অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
[লেখক : কবি, গল্পকার, আইনজীবী]

No comments

Powered by Blogger.