একুশ শতক- ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন এবং তার ভিডিও রূপানত্মর_ তিন by মোসত্মাফা জব্বার
আমি স্বপ্ন দেখি, ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই ভূমির সকল তথ্য ঘরে বসে পাওয়া যাবে। ভূমির মালিক তার ভূমির নকশা, চিত্র, মালিকানা ও অন্যান্য দলিল নিজের ঘরে বসে দেখতে পাবেন।
জমি রেজিস্ট্রি করার সাথে সাথে দলিল পাওয়া যাবে। সেই অফিসের রেজিস্ট্রার বা অন্যরা ঘুষ কাকে বলে চিনবেন না। এমনকি কেউ সেই অফিসে না গিয়েই দলিল রেজিস্ট্রি করতে পারবেন। হতে পারে মোবাইল ফোনেই জমির হাত বদল হতে পারবে। এমনকি ভূমির কর তিনি দিতে পারবেন মোবাইলে। এমনও হতে পারে, মোবাইলে জমির মানচিত্র দেখা যাবে। ২০২১ সালে বাণিজ্যের নাম হবে ডিজিটাল কমার্স। শোরম্নম-শপিং মল বা ভিড়াক্রানত্ম জায়গায় কেনাকাটার জন্য কেউ যাবেন না। উইন্ডো শপিং বা সামাজিকতার জন্য এসব স্থান ব্যবহৃত হলেও বেশির ভাগ মানুষ ইন্টারনেটেই তাঁদের কেনাকাটা সেরে নেবেন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, দোকান বা সংস্থার নিজস্ব ওয়েবসাইট থাকবে এবং তারা ইন্টারনেটে লেনদেন করবে। ততদিনে দোকানপাট আর মার্কেটনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য উধাও হয়ে যাবে। মানুষ তার ঘরে বসে পছন্দমতো পণ্য কিনবে। কাগজের টাকা জাদুঘরে থাকবে। হাতের ছাপ দিয়ে করা যাবে লেনদেন। মাছ-মুরগির ব্যবসায়ী, চানাচুরওয়ালা ও অন্য ফেরিওয়ালারা ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ করবে।পুলিশ এসএমএস বা ই-মেইলে মামলা গ্রহণ করবে। আদালতে চার্জশীট দেবার জন্য তারা ই-মেইল বা ডিজিটাল উপায় ব্যবহার করবে। তারা ঘুষ কাকে বলে জানবে না। দেশের যে কেউ সাজাপ্রাপ্ত বা চিহ্নিত অপরাধীকে ইন্টারনেটে দেখতে পাবে। বিচারক প্রয়োজনে ভিডিও কনফারেন্সিং-এর সহায়তা নিয়ে বিচারকার্য সম্পাদন করতে পারবেন। আইন-বিচার কার্যক্রম, আইনের ব্যাখ্যা, আদালত, উকিল এবং বাদী-বিবাদী সকলের কাছেই ঘরে বসে পাবার মতো তথ্য সহজলভ্য থাকবে। দুয়েকটি শব্দ লিখে মামলার বিবরণের পাশাপাশি আইন ও সাজার বিবরণ জানা যাবে। দেশে স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকবে। সেটি কেবল কাগজে থাকবে না; বিরাজ করবে আইনের শাসন।
সরকার গ্যাস, পানি-বিদু্যত, পয়ঃনিষ্কাশনসহ সব সাধারণ সেবাই মানুষের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে প্রদান করবে। দেশের সর্বত্র পৌর সেবা ঘরে বসেই পাওয়া যাবে। মানুষ ঘরে বসেই তাদের সকল বিল পরিশোধ করবে।
প্রতিটি মানুষের জন্য মাধ্যমিক সত্মরের শিৰা বাধ্যতামূলক হবে এবং সরকার সেই শিৰা বিনামূল্যে প্রদান করবে। শিৰার নূ্যনতম এই সত্মরটিতে কোন বৈষম্য থাকবে না। স্কুল হোক, মাদ্রাসা হোক সবার জন্যই এক ধারার পাঠ্য বিষয় থাকবে। শহর-গ্রাম, ছোট-বড়, ধনী-গরিব সকলের জন্য নূ্যনতম শিৰার একটিই ধারা প্রবহমান থাকবে। দেশের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর নিজের কম্পিউটার বা অন্য কোন ডিজিটাল যন্ত্র থাকবে। কাসরম্নমগুলো কম্পিউটার বা ডিজিটাল যন্ত্র দিয়ে ভরা থাকবে। শিৰক-শিৰিকারা ডিজিটাল যন্ত্রে সজ্জিত থাকবেন। শিৰা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসের সকল স্থানে থাকবে ইন্টারনেট। শিৰা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা হবে ইন্টারনেটে। পাঠাগারগুলো হয়ে যাবে ডিজিটাল। সকল পাঠ্যপুসত্মক ইন্টারনেটে বা ডিজিটাল ফরম্যাটে পাওয়া যাবে। হতে পারে এরই মাঝে সকল বই, মূল্যায়ন পদ্ধতি, শিৰক-শিৰিকা নির্দেশিকা ইত্যাদি ইন্টারএ্যাকটিভ মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যারে পরিণত হবে। শিৰকরা নিজেরা তৈরি করবেন সফটওয়্যার। ছাত্র-ছাত্রীরাও তাদের পাঠ নিজেরা ডিজিটাল উপায়ে পেশ করবে। বাড়িতে বসে কাস করা যাবে। এমনকি বিদেশে বসেও কাস করা যাবে। দেশে বসে বিদেশের কাসেও যোগ দেয়া যাবে। পরীৰা দেয়া যাবে ঘরে বসে। ফল পাওয়া যাবে পরীৰা দেবার পরপরই। সার্টিফিকেট কোন জরম্নরী বিষয় হবে না। যে কেউ ইন্টারনেটে গিয়ে জেনে নিতে পারবে কার কী ফল।
নিরাপত্তার অভাব রবে না কারও। তার নিজের জীবন নিয়ে কোন ভয় থাকবে না। সে ভয়লেশহীনভাবে দেশের যে কোন প্রানত্মে যে কোন সময় চলতে পারবে। দেশের যে কোন স্থানের যে কোন পথে রাত বারোটায় ১৮ বছরের সুন্দরী মেয়েটি সম্পূর্ণ একা হাঁটবে বা সাইকেল চালাবে। তার নিরাপত্তার কোন অভাব হবে না। সকল মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো থাকবে নিশ্চিত। দেশে বিচারবহিভর্ূত হত্যাকা- হবে না। মানুষ ঘরে তালা লাগাবে না। বাড়ি বা ফ্যাটের মালিকরা দরোজায় দাঁড়ালে দরোজা তাদের চিনবে এবং খুলবে বা খুলবে না। টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি ইতিহাসের বিষয় হবে।
সংবিধানে প্রদত্ত নিয়ম কাঠামোর মাঝে সংবাদপত্র-মিডিয়ার স্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকার পরিপূর্ণভাবে বাসত্মবায়িত হবে। শহরের পাতাল-আকাশ রেল তাদের চলাচলের উপায় হবে। এক শহর থেকে অন্য শহরে যাবার জন্য নাগরিকরা ট্রেনে চড়ে বা রেলে উঠে দ্রম্নত চলাচল করবেন। নদী-খাল দিয়ে আরামদায়ক দ্রম্নতগতির নৌযান চলবে। সড়কপথগুলো প্রশসত্ম, নিরাপদ ও আরামদায়ক গণবাহনে ভরা থাকবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ ততদিনে সমাপ্ত হয়ে যাবে। দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর কাজও ততদিনে শেষ হয়ে যাবে। শীতলৰ্যা, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া, ধনু, সুরমা, কংস, যমুনায় আরও অনেক সেতু হবে। রেললাইন যাবে বরিশাল-টেকনাফ পর্যনত্ম। ঘরে বসে টিকেট কাটা, যানবাহন চলাচলের খবর জানা এসব অনেক পুরনো ব্যাপার হয়ে যাবে। আমাদের স্বপ্নের মাঝে থাকতে পারে, দেশের নদীগুলো মিষ্টি পানি আর সুস্বাদু মাছে পরিপূর্ণ থাকবে।
পত্রিকাগুলোর সকালের সংস্করণ প্রকাশিত হলেও সারাদিনই তারা অনলাইনে আপডেট থাকবে। মানুষ মোবাইল ফোনে স্যাটেলাইট টিভি দেখবে। ইন্টারনেটেও সকল চ্যানেল দেখা যাবে। মানুষের সাংস্কৃতিক জীবন এমন হবে যে, বিদ্যমান কম্পোনেন্ট দিয়ে সে তার নিজের নাটক, কবিতা, উপন্যাস, চলচ্চিত্র ইত্যাদি বানিয়ে তাতে মিউজিক দিতে পারবে।
চিকিৎসার জন্য মানুষকে বিদেশ তো দূরের কথা, শহরেও আসতে হবে না। রোগী দেখা-রোগ শনাক্ত করা, ব্যবস্থাপত্র প্রদান এমনকি অপারেশনসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা ডাক্তাররা যে কোন স্থান থেকে যে কোন স্থানে দিতে পারবেন।
ততদিনে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রসত্ম দেশের অপবাদ ঘুচে গেছে। দুর্নীতিগ্রসত্মদের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। বরং বিশ্বের কম দুর্নীতিগ্রসত্ম দেশের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রশাসনে স্পীড মানির প্রয়োজন নেই। কাজ হচ্ছে আপন গতিতে। টিআইবির অফিস তালাবন্ধ হয়ে যাবে। দেশজুড়ে বিরাজ করা তাদের শাখা অফিসগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।
পুরো দেশটির প্রতি ইঞ্চি মাটি তার বা বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থায় উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সংযুক্ত থাকবে। ব্রডব্যান্ড সংযোগের বলতে গেলে কোন দাম থাকবে না। এক গিগাবিট বা তারও বেশি ব্যান্ডউইদথ সাধারণ গৃহিণী বা ছাত্র-ছাত্রীরা অনায়াসে ব্যবহার করতে পারবে। তার জন্য হয়ত কয়েক শ' টাকা মাসিক ফিস দিতে হবে। মানুষের জীবনধারায় ইন্টারনেট হবে অপরিহার্য জিনিস। দেশের যে কোন স্থানে ডিজিটাল যন্ত্র দিয়ে ইন্টারনেট পাওয়া যাবে। জীবনের সকল কাজের কেন্দ্রে থাকবে ইন্টারনেট। এমনকি ব্যক্তি-পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, যোগাযোগ, বিয়ে-শাদি, প্রেম-ভালবাসার কেন্দ্র হবে ফেসবুক, মাইস্পেস, হাই-৫, টুইটার ইত্যাদি সোসাল নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেটের অন্য কোন ব্যবস্থা। হয়ত ততদিনে নতুন কোন ফেসবুকের জন্ম হবে_ ইন্টারনেট ২ হয়ত ৫.০ সংস্করণে যাবে। মোবাইল নেটওয়ার্ক যাবে ৭ জিতে। ভিডিও মোবাইল ফোন কোন আলাদা বিষয় হবে না। প্রতিটি মোবাইলেই এটি সাধারণ বিষয় হয়ে যাবে। ইন্টারএ্যাকটিভিটির সাথে মাল্টিমিডিয়া যুক্ত হয়ে ইন্টারনেট হবে এক নতুন অভিজ্ঞতা। মানুষের হাতের কাছে এমন যন্ত্র থাকবে না যা দিয়ে ইন্টারনেটে প্রবেশ করা যাবে না। এখন যেমনটি ঘড়ি আর রেডিওর ৰেত্রে ঘটেছে তেমনটি ইন্টারনেটের ৰেত্রে দেখব আমরা। মানুষের হাতের কাছের যন্ত্র মানেই হবে ইন্টারনেট সম্পৃক্ত। এমন হবে যে ফ্রিজ, ওভেন বা দরোজার সিকিউরিটি থেকে আমরা মেইল/এসএমএস পাঠাব বা মেইল/এসএমএস পেয়ে যাব। ইন্টারনেটে খুব দ্রম্নতগতির ব্যান্ডউইদথ থাকবে এবং এর বদৌলতে ভিডিও পারাপার অতি সহজ হয়ে যাবে। মানুষ মানুষের সাথে ভিডিওতে পরিচিত হবে এবং ফেসবুকসহ সকল সামাজিক নেটওয়ার্ক রিয়েলটাইম অনলাইন ভিডিওনির্ভর হবে। রেডিও-টিভি-সংবাদপত্র বলতে কেবল সম্প্রচারিত বা প্রকাশিত রেডিও-টিভি-সংবাদপত্রকে বোঝাবে না; ব্যক্তিগত ইন্টারনেট চ্যানেল অতি গুরম্নত্বপূর্ণভাবে মানুষের তথ্যপ্রাপ্তির বড় সুযোগ তৈরি করে দেবে। স্বীকৃত সাংবাদিকতার বাইরে নাগরিকেরা সাংবাদিকতায় অনেক সক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন।
বাংলাদেশের ইন্টারনেটের শুধু নাম নয়, সকল পর্যায়ের ভাষা হবে বাংলা। দেশের মানুষ তার নিজের ভাষায় তার প্রয়োজনীয় সকল তথ্য পাবে এবং নিজেরা মাতৃভাষাতেই যোগাযোগ করবে। বিশ্বজুড়ে ইংরেজীর আধিপত্য কমে যাবে। বিশ্ববাসী তাদের মাতৃভাষার মর্যাদাকে অনেক বেশি বড় করে দেখবে। আমাদেরকে ইংরেজী শিখতে পরামর্শদাতারা তখন আর বড় করে ইংরেজীর প-িত হতে বলবেন না। বিবিসি বা ব্রিটিশ কাউন্সিলের ইংরেজী শেখানোর দাপট কমে যাবে। ছেলেমেয়েরা আইইএলটিএস দেবার জন্য পাগল হয়ে যাবে না। ইন্টারনেটের জন্য তো বটেই সকল কাজেই ততদিন কীবোর্ড-নির্ভরতা, বিশেষত ইংরেজীর মতো কোয়ার্টি কীবোর্ড ব্যবহার করা কমে যাবে। মানুষ হয়ত মুখে বলবে এবং যন্ত্র তাকে মুখের বা লিখিত ভাষায় রূপানত্মর করবে।
আমি স্বপ্ন দেখতে চাই যে, দেশের দুই কোটি শিৰিত বেকার নিজেদেরকে একুশ শতকের উপযুক্ত করবে এবং তাদের বেকারত্ব ঘুচবে। নতুন যারা শিৰা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বের হবে তারা তৈরি হবে জ্ঞানকর্মী হিসেবে। চাকরি চাওয়া বা পাওয়া এবং চাকরি করার জন্য শারীরিক উপস্থিতি বাধ্যতামূলক হবে না। বিদ্যমান পেশাগুলোর অনেকটাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। নতুন নতুন পেশার উদ্ভব হবে। সাধারণভাবে কায়িক শ্রমের পেশার জন্য কম মজুরি পাওয়া যাবে এবং মেধাশ্রমের মূল্য অধিক হবে। আদম রফতানি নামক ব্যবসা এবং আদম বেপারী নামক পেশাটি দিনে দিনে বিলুপ্ত হবে। মানুষ নিজের বাড়িতে বসেই বিদেশের কাজ করবে এবং বৈদেশিক মুদ্রায় বেতন পাবে।
কখনও কখনও এমনটি মনে হতে পারে যে, এটি হয়ত উচ্চাভিলাষী, অলীক বা বাসত্মবায়নের অযোগ্য একটি কল্পনার ফানুস। ভাবলেই সব হবে, স্বপ্ন দেখলেই সেই স্বপ্ন বাসত্মবায়ন করা যাবে_ এমনটি নাও হতে পারে। কিন্তু চেষ্টা করলে সেটি হতেও পারে। আসুন না, সবাই মিলে স্বপ্নটা দেখি। শুনেছি সকলে মিলে কিছু চাইলে সেটি পাওয়া যায়।
০৫ ফেব্রম্নয়ারী ২০১০
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, ঔপন্যাসিক, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, সাংবাদিক, কম্পিউটার বিষয়ক বই-পত্র ও নিবন্ধের লেখক ও কলামিস্ট এবং বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক
ই-মেইল ঃ সঁংঃধভধলধননধৎ@মসধরষ.পড়স, ওয়েবপেজ: িি.িনরলড়ুবশঁংযব.হবঃ
No comments