স্মরণ-চিলেকোঠার সেপাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস by সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম
বাহুল্য কখনো কখনো গুণগতমানকে বদলে দেয় অথবা প্রসঙ্গ ছাপিয়ে অপ্রসঙ্গকে করে তোলে প্রধান বিষয়। খুব সচেতন ছিলেন বলেই বোধ হয় আর দশজন লেখকের মতো তাঁর বইয়ের তালিকায় শত শত নাম যোগ হয়নি।
সমাজের সব বিপত্তি নিয়ে সচেতন হলেও সব কিছু নিয়েই লেখেননি একতরফা নিজের বক্তব্য। কিন্তু যে দুটি বইয়ের নাম যোগ হয়েছে, তা-ই যথেষ্ট সব প্রজন্মের পাঠকের কাছে পেঁৗছে যাওয়ার জন্য। চিলেকোঠার সেপাই আর খোয়াবনামা। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সারির লেখকদের মধ্যে তাই সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর পাশাপাশি যে নামটি সমান যোজনা নিয়ে উঠে আসে, সেটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এক পুরুষের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর তা থেকে তৈরি নানা সামাজিক অমীমাংসিত সংকট নিয়ে তাঁর গল্পের শুরু। ব্যক্তিকেন্দ্রিক জটিলতার বর্ণনার মধ্য দিয়ে চিলেকোঠার সেপাইতে নিয়ে এসেছেন মুক্তিযুদ্ধপূর্ব সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। 'আইয়ুব শাহী জুলুম শাহী-ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক' স্লোগান মিছিলের নামে উচ্চারিত হয়েছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসেরই কণ্ঠ থেকে। উপন্যাসের মূল চরিত্র ওসমানের সঙ্গে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে দরিদ্র-নিঃস্ব কিন্তু তেজোদীপ্ত এক ব্যতিক্রমী চরিত্র হাড্ডি খিজিরকে পরিচয় করিয়েছেন পাঠকের সঙ্গে। ওসমানের বিচ্ছিন্নতা আর আত্মপ্রেমের চার দেয়ালের বর্ণনায় এঁকেছেন ব্যক্তিমানুষের একান্ত কিছু সংকটের দৃশ্য। অর্ধশত বছর পরও উপেক্ষিত, কিন্তু এই সংকটের অস্তিত্ব আজও প্রকট। স্বপ্ন দেখতেন একদিন এমন চিলেকোঠা ছেড়ে সত্যিই বেরিয়ে পড়বে মানুষ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্ম গাইবান্ধায় ১৯৪৩ সালে। পড়েছেন বগুড়া জেলা স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ভক্ত ছিলেন মিগুয়েল সার্ভান্তেসের লেখা 'দোন কিহোতে' উপন্যাসের। আর এর প্রভাবও পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। শেষের দিকে লেখা খোয়াবনামা এই উপমহাদেশের বিভক্তিপূর্ব সময়ে ঘটে যাওয়া তেভাগা আন্দোলনের ঘটনাকে উপজীব্য করে। শরণার্থীদের মানবেতর জীবনের কথা বলেছেন তিনি। প্রকাশিত ছোটগল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অন্যঘরে অন্যস্বর, খোয়ারী, দুধভাতে উৎপাত ও দোজখের ওম। সংস্কৃতি ভাঙা সেতু তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। অনেকের চেয়ে ভিন্ন তিনি নাম নির্বাচনে, যা লেখার প্রতি পাঠককে প্রথম আকর্ষণ করে। তাঁর লেখায় থাকা রঙ্গ, ব্যঙ্গ, ব্যক্তিভাবনা, রাজনীতি আর ইতিহাসের উপস্থিতি খুব কম সাহিত্যে রয়েছে। খোয়াবনামায় তিনি ম্যাজিক রিয়ালিজমের ধারা এনে বাংলা সাহিত্যে যোগ করেছেন নতুন পদ্ধতি। ব্যক্তিজীবনে সব সময় পাইপ মুখে দেওয়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি আশ্চর্য গুণ ছিল, মানুষের প্রতি মূল্যায়ন। যে সময় উঠতি লেখক আর বিজ্ঞজনদের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান, তখন তিনি তরুণদের নিয়ে দারুণ উৎসাহী। তাঁর লেখার আলোচনা ও সমালোচনা দুই-ই গ্রহণ করতেন গুরুত্ব দিয়ে। আগ্রহ ছিল অনেক অপ্রচলিত বিষয়ে। বাংলা একাডেমী, আলাওল, আনন্দ, একুশে পদকসহ বহু সম্মাননা পেয়েছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তাঁর বই অনূদিত হয়েছে কয়েকটি ভাষায়। ড্রইং রুম সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা সাহিত্য রচনার পাশাপাশি হারিয়ে যাওয়া অনেক মৌলিক সংস্কৃতি তুলে আনার জন্যই বেঁচে থাকবেন তিনি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মৃত্যু দিনে রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম
No comments