কৃষি খাতে সুশাসন by এ এম এম শওকত আলী
উন্নয়নমূলক অথবা নিয়ন্ত্রণমূলক সব খাতেই সুশাসনের প্রয়োজন রয়েছে। কৃষি খাতও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এ কথা বলা প্রয়োজন যে, কৃষি খাতসহ সব খাতেই উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণমূলক বিভাজন অনেকটা কৃত্রিম।
কারণ উন্নয়নমূলক খাতভুক্ত মন্ত্রণালয়ও কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক দায়িত্ব পালন করে থাকে। এ ধরনের ব্যবস্থা সরকারী কার্য সম্পাদন বিধিতেই সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ যে কোন খাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়ের জন্য ঐ খাতভুক্ত আইন ও আইনের আওতায় সৃষ্ট বিধিসমূহ প্রয়োগের কর্তব্য ও মতা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগকেই করতে হয়। আইন ও বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন হলেও এ মাধ্যমই যথেষ্ট নয়। এর জন্য একাধিক সরকারী পদপে গ্রহণেরও যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। প্রধান ও অন্যতম পদপেগুলো হলো (এক) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপযুক্ত প্রশিণ ও মানসিকতার বিকাশ, (দুই) আইন প্রয়োগের ও কার্যকরী করার জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ, (তিন) যে সমস্ত েেত্র কোন বিক্রয়যোগ্য পণ্য বা দ্রব্যাদির সার্বিকভাবে আইন প্রয়োগের ল্যে পরীার প্রয়োজন তার অবকাঠামোগত ও আবশ্যিক যন্ত্রপাতি এবং (চার) জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি।কিছুদিন পূর্বে একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কৃষি অর্থনীতির অবস্থা ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে একটি টকশো হয়েছিল। এতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, মিডিয়া ব্যক্তিত্বসহ পরিবেশবিদ ও একজন অর্থনীতিবিদ। এ আলোচনায় ভূমিনীতি এবং এ নীতির সঠিক প্রয়োগসহ খাদ্য নিরাপত্তার অংশ হিসাবে অকৃষি খাতভুক্ত উৎপাদিত পণ্য এবং একে সহজলভ্য করা, জলবায়ু পরিবর্তন, হাইব্রিড বীজের অধিকতর ব্যবহার, কৃষি ও অকৃষি খাতভুক্ত মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সঠিক সমন্বয় নিশ্চিত করাসহ আরও কয়েকটি বিষয়।
ভূমি নীতি সম্পর্কে বলা যায় যে, ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে পূর্ববর্তী ভূমি নীতির পরিবর্তে ভূমি ব্যবহার নীতি প্রণীত হয়েছিল। বিদ্যমান কৃষি অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার প্রেেিত ভূমি ব্যবহার নীতিই হলো সঠিক শিরোনাম ও কার্যকর পদপে। কারণ অকৃষি খাতের প্রয়োজনে এক, দুই ও তিন ফসলী জমির পরিমাণ ক্রমাগতই আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এ বিষয়ে একজন আলোচক মুন্সীগঞ্জের কোন এলাকায় রফতানি প্রক্রিয়া অঞ্চল সৃষ্টির ল্যে তিন ফসলী জমি অধিগ্রহণের যে উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করেছে তা সঠিকভাবে সমালোচনা করেন। তাঁর মতে, এর জন্য এক ফসলী জমি অধিগ্রহণ করলে ভাল হতো। এ বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। তবে যা সময়ের স্বল্পতার জন্য উল্লেখ করা হয়নি তা হলো নদী ভাঙ্গন, ক্রমবর্ধমান নগরায়ন প্রক্রিয়াসহ আরও কিছু কারণ এ বিষয়ে চিহ্নিত করা হয়নি। ভূমি ব্যবহার নীতিতে ভূমির সঠিক ও খাতভিত্তিক ব্যবহার সম্পর্কে অনুশাসন দেয়া রয়েছে। প্রয়োজন বাস্তবায়নের, যা ২০০১ সাল পরবর্তী সময়ে হয়নি। এর মূল কারণ বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি। মতাসীন রাজনৈতিক দলের পরিবর্তনের সাথে সাথে পূর্বের গৃহীত নীতি বাস্তবায়নে অনীহা সর্বেেত্র উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান।
একজন আলোচক হিসাবে উপস্থিত মন্ত্রী এ বিষয়ে সরকারেরও আশঙ্কার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন এবং যথাযোগ্য পদপে গ্রহণের কথাও বলেছেন। আলোচনার সময় তিনি কৃষি ও অকৃষি খাতের মন্ত্রণালয়সমূহের মধ্যে সঠিক ও সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনার বিষয়টি উল্লেখ করে অন্যান্য আলোচক ও দর্শকদের আশ্বস্ত করেছেন। বাস্তবচিত্র ভিন্নতর। ভূমি ব্যবহার নীতির প্রধান পদপেগুলো বাস্তবায়ন কবে হবে সে বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত। উপস্থিত পরিবেশবিদ এ প্রসঙ্গে ঢাকার নিকটবর্তী আবাদযোগ্য জমির পরিবেশ দূষণের বিয়টিও উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণের ফলে প্রায় পাঁচ কিলোমিটারব্যাপী আবাদযোগ্য জমি কালো হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, জমি জ্বলে গেছে। কাজেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ও অধিদফতরের মধ্যে অধিকতর সমন্বয়ের প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। আশার কথা এই যে, হাইকোর্ট এ বিষয়ে সময় নির্ধারণ করে সরকারকে দূষণকার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্থানান্তরের নির্দেশ প্রদান করেছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে জটিল এবং সময় সাপে। তবে বলা প্রয়োজন যে, এ বিষয়টি ১৯৯৫ সাল থেকেই সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আলোচনা করা হচ্ছে। এখনও কোন সুরাহা হয়নি। বর্তমান শিল্পমন্ত্রী হাইকোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়নে আরও সময়ের প্রয়োজন হবে মর্মে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। আর কত সময়? প্রায় পনেরো বছর সময় পেরিয়ে গেছে।
খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি উপস্থিত কৃষি বিষয়ক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জোরালোভাবে মাছ-মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধির প েযুক্তি প্রদর্শন করেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিদ্যমান খাদ্যসহ কৃষি নীতিতে খাদ্যশস্যের অর্থাৎ চালের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অজর্নের ওপরই অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ জন্য পুষ্টিহীনতার যে সমস্ত তথ্য বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রকাশিত হয় তা নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক। এ নিয়ে যদি কেউ খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কথা বলেন, তাহলে বিভিন্নভাবে ঐ ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে ব্যাঙ্গ করা হয় এবং মুখরোচক নামও তাকে প্রদান করা হয়। পাকিস্তান আমল থেকেই এ বিষয়টি দৃশ্যমান। ঐ সময় একজন লাট বাহাদুরকে নাম দেয়া হয়েছিল 'ভুট্টা খান'। কারণ তিনি জনগণকে ভুট্টা খাওয়ার অভ্যাস করার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। সাম্প্রতিককালেও আলু নিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তবে বর্তমানে যে বিষয়টি সামান্য হলেও দৃশ্যমান তা হলো ভুট্টা কেবল মুরগির খাবার নয়, ভুট্টার আটা প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি হয়।
উপস্থিত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব রূপালী বিপ্লবের কথা উল্লেখ করেন এবং মাছ চাষে অনেক উদ্যোক্তা যে এগিয়ে এসেছে সে বিষয়টি উল্লেখ করেন। পরিবেশবিদের পাল্টা যুক্তি ছিল এর ফলে সাদা কলারের ব্যক্তিরা অনেক ধানী জমি লিজ গ্রহণের মাধ্যমে গরিব মালিকদের বঞ্চিত করাসহ অধিক খাদ্যশস্য উৎপাদনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে মাছ-মাংসের তুলনায় চালের দাম অনেক সস্তা। দাম কেজি প্রতি এক টাকা/দু'টাকা বৃদ্ধি হলেই মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়। রাজনৈতিক দর্শনও চালের দাম বৃদ্ধির বিপ।ে যুক্তি হলো এতে গরিব মানুষের কষ্ট হয় এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিস্বরূপ। এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য হলেও এর বিকল্পও রয়েছে। যেমন খাদ্যভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সম্প্রসারণসহ সুসংহত ও সুষমকরণ। এর সাথে যোগ করা যায় নগদ অর্থের বিনিময়ে গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি, যা বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা হয়েছিল। এর দ্বিতীয় পর্যায় এখনও শুরু হয়নি।
জনশ্রুতি রয়েছে যে, এ কর্মসূচীটি বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় অধিকতর কার্যকর করার ল্যেই একে আরও পরীা-নিরীা করা হয়েছে। অচিরেই দ্বিতীয় পর্যায় চালু করা হবে। এ বিষয়ে করণীয় হলো এর সঠিক সময় নির্ধারণ করা। যদি ফসল কাটার সময় এটা করা হয় তাহলে ধান-চালের দাম আরও হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কারণ ফসল কাটার অব্যবহিত পরেই এর দাম হ্রাস পায়। সুশাসনের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, খাদ্য ভিত্তিকসহ নগদ অর্থ সংক্রান্ত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীকে অধিকতর কার্যকর করার জন্য খাদ্য ও অর্থ বিতরণ নীতিমালা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতেই হবে। অন্যথায় অপচয়ের অবকাশ থেকেই যায়। এ বিষয়ে সরকার প্রত্যয়ী হয়ে কিছু কার্যকর পদপে গ্রহণ করলে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনাই অধিক।
অন্যদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্ণর বলেছেন যে, মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। একই ধরনের উক্তি করেছিলেন ২০০৪-২০০৬ সালে সাবেক অর্থমন্ত্রী। তাঁর এ উক্তির সমালোচনাও করা হয়েছিল। তবে উভয়েই সঠিক বক্তব্য হয়ত দিয়েছিলেন। কারণ ২০০৮ সালে এক টকশোতে উপস্থিত অর্থনীতিবিদ একই কথা অন্যভাবে বলেছিলেন। তাঁর উক্তি ছিল বাজারের মজুরির স্বয়ংক্রিয় সমন্বয়ের ফলে চালসহ অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ততটা ভয়ানক রূপ ধারণ করে না। তিনি ঐ সময় রাজশাহী অঞ্চলের মাঠ পর্যায়ের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতেই এ উক্তিটি করেছিলেন। এ জন্য দাম বৃদ্ধির বিষয়টি কিছুটা হলেও সহনীয় হয়। তবে গত অক্টোবর-নবেম্বর মাসে খাদ্য সংক্রান্ত মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে শতকরা সাত ভাগের অধিক_ যা পূর্বে মাত্র চার ভাগ ছিল। এ জন্য সরকার খোলা বাজারে ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রি করছে। সম্প্রতি ভারতেও একই ধরনের ধারা দৃশ্যমান। প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায় যে, ভারত খোলা বাজারে সরকার নির্ধারিত সহনশীল মূল্যে চাল বিক্রি করবে। মূলত এক সমীায় দেখা গেছে যে এশিয়ার প্রায় এগারোটি দেশে এ ধরনের নীতি অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। নব্বই দশক থেকেই বিদেশী দাতা গোষ্ঠী এর বিরুদ্ধাচারণ করে। ২০০৭-২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সঙ্কটের ফলে এ গোষ্ঠীর মত এখন ভিন্নতর। অর্থাৎ তারা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য ঘাটতির দেশ সমূহে দেশজ খাদ্য উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী। এ সংক্রান্ত সমীাও বাংলাদেশে হয়েছে এবং হচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে প্রয়োজন হবে সমীার ফলাফল দ্রুত পরীা-নিরীা করে সম্মত বিষয়াবলী দ্রুত বাস্তবায়ন করা। এদিকে দৃষ্টি দিলে খাদ্য নিরাপত্তার অব্যাহত বিতর্কের ধারা হ্রাস পাবে।
কৃষি খাতে ইতোপূর্বে সরকার ও দাতা সংস্থাগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কৃষি উপকরণসহ সরকারিভাবে সংগৃহীত খাদ্য শস্য বিতরণের সমস্যা। এ সমস্যা এখনও রয়েছে। তবে ভবিষ্যতের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষন করলে বলতে হয় যে, উৎপাদনের সমস্যা ক্রমেই ঘনীভূত হবে। মূল কারণগুলো হলো (এক) আবাদযোগ্য জমির ক্রমবর্ধমান হ্রাসের ধারা, (দুই) বিদ্যমান জমির উর্বরতা হ্রাস এবং (তিন) সার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের_ যথা প্রাকৃতিক গ্যাসসহ রক ফসফেটের য়িষ্ণু ধারা। উন্নত বিশ্বের কিছু দেশে গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এ ধরনের আশঙ্কার মধ্যে বলা হয়েছে যে, রক ফসফটের যা টিএসপির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল তার উত্তোলনতব্য মজুদ আগামী ১৩০ বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে। বিকল্প ব্যবস্থা গবেষণার মাধ্যমে না করতে পারলে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি ভবিষ্যতে যে ভয়ানক হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments