মরুঝড় by মোহিত কামাল
জি। তিনিই বললেন শৌর্যের জন্য রান্না করা তরকারি পাঠাতে। ছেলের সমবয়সী কলির জন্য আলাদা মায়া টের পেলেন। জানেন, ভাবীজান যক্ষের ধনের মতো ঘরের মধ্যে আটকে রাখতে চান বউমাকে, ঘর থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক গেলে উদ্বিগ্ন হয়ে খোঁজেন।
ভাবনার মধ্য থেকেই আবার বললেন, তোমার শাশুড়ির দেখছি ভালোই উন্নতি হয়েছে।হাসল কলি। জবাব দিল না।
শৌর্য রান্না ঘরে ঢুকে বলল, আমাদের সঙ্গে খাবে, ভাবী?
আবারও হেসে জবাব দিল, আমাদের দুপুরের খাবার হয়ে গেছে।
ওঃ! তাহলে বসো। এখনই যেয়ো না।
শৌর্যের মাও যোগ করল, হ্যাঁ। বসো বউমা। কখনো তো আসোনি এ ঘরে। একই বাড়ির দুই ঘর কি আর ভিন্ন ঘর? এ ঘরও তোমার ঘর। বসো।
‘একই বাড়ির দুই ঘর কি ভিন্ন ঘর? এ ঘরও তোমার ঘর। বসো’ শৌর্যের মায়ের বলা কথাটা চট করে ঢুকে গেল মগজে। হৃৎপি-ে নাড়া খেল প্রতিটি শব্দ। মনের মধ্যে তৈরি হলো ভাবনা-ঘূর্ণি ‘আমার তো কোনো ঘরই নেই। ঘরের চাল নেই। বেড়া নেই। নিজের যে সিন্ধুক রয়েছে, তার চাবিও নেই’।
ভাবনা-ঘূর্ণি থামছে না। জোরালো হচ্ছে। মাথা নিচু করে কলি বসল রান্না ঘরের চৌকিতে। মুখ ঢেকে গেল চুলে। ভেজা চুল এখনো শুকোয়নি। ভেজা চুলের কি ভেজা স্পর্শ পাচ্ছে মুখ? নাকি চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে কলি, টের পেল না। বসে থেকে দেখতে থাকল শৌর্যের খাওয়ার ভঙ্গি।
রিংটোন বাজার সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে চৌকির ওপর থেকে হাতে মুঠোফোন হাতে তুলে নিয়ে রুশনা বেগম বললেন, কেমন আছ, রুস্তম?
রুস্তম জবাব দিল, অস্থির লাগছে। কাজের ফাঁকে রেস্ট পেয়েছি, তাই তোমাদের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা হলো। তোমাদের কি দুপুরের খাওয়া শেষ? এখন তো দেশে প্রায় দুটো। এখানে দুপুর বারোটা।
রুশনা বেগম বললেন, হ্যাঁ, বাবা। খাওয়া শেষ।
তোমার বউমা কি সামনে আছে? ওর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
বউমা তো নেই। পাশের ঘরে গেছে। রাজপুঁটি আর ফুলকপি রান্না-তরকারি নিয়ে গেছে শৌর্যের জন্য। শৌর্য আজ মাছ ধরেছে পুকুরে। নিজেদের ক্ষেত থেকে আগাম চাষের ফুলকপিও তুলে দিয়েছে।
মায়ের কথা শুনে চিনচিন ব্যথা জেগে উঠল বুকে। ব্যথার শেকড় থেকে বেরিয়ে এল গোপন এক আগুনশিখা। আগুনশিখায় পুড়ে যাচ্ছে সব পোড়া পাঁজর থেকে নিঃশ্বাস বেরুতে পারছে না। আটকে গেছে প্রশ্বাস। নিজেকে মনে হচ্ছে রাত্রিজাগা আইসিইউ’র রোগী অচিনপুরের উদ্দেশে যাত্রার প্রহর গোনা ভোরের প্রতীক্ষারত শেষ যাত্রী। আগুন জ্বলছে, পোড়া মাটিও পুড়ছে। পুড়ে যাচ্ছে স্বপ্ন। বিয়ের কাবিননামাও পুড়ছে মনে হলো। ধোঁয়া উড়ছে। কালো ধোঁয়ায় কেবল কার্বন-ডাই-অক্সাইডই আছে, তা নয়; কার্বন মনো-অক্সাইডও বেরুচ্ছে হুঁশহুঁশ করে। নীল হয়ে উঠছে রক্ত। হিমোগ্লোবিন শূন্যতায় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ত্বক। মাথার ওপর রোদের দাপট বেড়ে গেছে কয়েক শ’ গুণ বেশি। পুড়ছে দেহ। পোড়া দেহে ব্যথা থাকে না। প্রাণহীন অস্তিত্বের শূন্যতার মধ্যেও ঘুরতে শুরু করেছে বালিঝড়। হাত কাঁপছে। কানের সঙ্গে ধরা মোবাইল ফোনও কাঁপছে থরথর করে। নৈঃশব্দের স্তব্ধতা ফুঁড়ে আবার মায়ের কথা শুনতে পেল রুস্তমÑকথা বলছ না কেন? লাইন কি কেটে গেছে, বাবা?
রুস্তম জবাব দিল, জি, লাইন কেটে গেছে, আম্মাজান।
আমি তো তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি! লাইন তো কাটেনি!
লাইন ছাড়াও কথা শোনা যায়। তরঙ্গ ছাড়াও বোধ হয় শব্দ ভেসে আসে। শব্দ আসছে। শব্দের প্রাণ নেই। প্রাণহীন শব্দ লাইন ছাড়াও তৈরি হতে পারে, আম্মাজান।
তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারছি না, শরীর ভালো আছে তো?
নিজের হাতের দিকে তাকাল রুস্তম। হাতের অস্তিত্ব অনুভব করে বলল, ভালো আছে শরীর।
নিজের যত্ন নিও। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করো।
রবোটের মতো রুস্তম জবাব দিল, যতœ নেব। খাওয়া-দাওয়া করব।
তাহলে এখন রাখি?
রাখুন।
লাইন কেটে গেছে। রুস্তম ডানে তাকাল দূরে। আমির বাড়ির সিঁড়িঘরের দিকে চোখ গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো নিজের দেহের ওপর আচমকা ঝাঁপ দিয়েছে দেশের কলি! নিজেকে রুস্তম ভাবতে পারল না! ভাবল রুস্তমের দেহকাঠামো দখল করেছে শৌর্য। শৌর্যের দেহের ওপরই ঝাঁপ দিয়েছে নতুন বউ, কলি।
প্রথমে চোখে পড়েনি। এখন ধরা পড়েছে লাল রুমাল। উড়ছে... লাল রুমাল উড়ছে...
দেশের কলিও কি এভাবে উড়ায় লাল রুমাল? শৌর্যও কি দূর থেকে দেখে দেশের কলির উড়াল রুমালের আহ্বান? নাকি কাছে গিয়ে ধরে রুমাল-হাত? ধরে? ঝাঁপ দেয় একে অপরের ওপর? প্রশ্ন জাগে মনে... প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভেতরের দহনটা চোখের সামনে দেখতে পেল রুস্তম। ভেতরটা পুড়ছে। কেবল ভেতর-আগুনই নয়, বাইরের দেহটাও দেখছেÑ চিতার আগুনে জ্বলে উঠছে দেহ। পোড়াদেহ ভাঙার শব্দ হচ্ছে মটমট করে। দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। আগুন-ঢেউয়ে ছাই-আগুন তেড়ে তেড়ে উঠছে আকাশপানে। নিজের পোড়া নিজেই দেখতে দেখতে ডানে তাকাল আবার দেখল লাল রুমাল উড়ছে। নিজের দেহপোড়া আগুনও যেন এখন পতাকা উড়াচ্ছে... লাল পতাকা,.. লাল রুমাল...
শৌর্যদের ঘর থেকে ফুরফুরে মেজাজে ফিরে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কলি শুনল, রুশনা বেগম বলছেন, তরকারি দিয়ে আসতে এত সময় লাগে, বউমা?
চাচীআম্মা বসতে বললেন, না বসে ওঠা যায়? বেয়াদব ভাববেন না আমাকে? এ জন্যই কিছুটা সময় গল্প করে এলাম।
যৌক্তিক উত্তর শুনে দমে গেলেও প্রশ্ন করা থামালেন না শাশুড়ি। রূঢ় স্বরে বললেন, চাচীমার সঙ্গে নাকি শৌর্যকে কাছে পেয়ে সঙ্গে গল্প করলে এতক্ষণ?
নেতিবাচক সরাসরি প্রশ্নে ভেতর থেকে রোষ জাগলেও ঠা-া গলায় কলি সত্য কথা বলল দু’জনই ঘরে ছিল। দু’জনের সঙ্গে কথা বলেছি।
যাও। আরও কথা বলো। এদিকে রুস্তম ফোন করেছিল। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইল। তুমি নেই। দীর্ঘক্ষণ লাইনে থেকেও তোমাকে না পেয়ে লাইন কেটে দিয়েছে সে।
রুস্তম কথা বলতে চেয়েছিল শুনে মুহূর্তের জন্য খুশি হলেও বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না খুশির ঢেউ। অতলে ভয় ঢুকে গেল শৌর্যকে ঘিরে নতুন কোনো কানকথা কুটনি মহিলা তুলে দেননি তো রুস্তমের কানে? আতঙ্কের তীর এসে বিঁধল বুকে। ছটফট করে শাশুড়ির উদ্দেশে প্রশ্ন করল, কী বলেছেন আপনি?
যা তুমি করেছ, তাই বলেছি।
কী বলেছেন সেটা শুনতে চাচ্ছি। ভারী গলায় বলল কলি।
কলির থমথমে গলা শুনে রুশনা বেগমও স্বর রূঢ় করে জবাব দিলেন, বলেছি বউমা শৌর্যের জন্য রান্না করা রাজপুঁটি মাছের তরকারি নিয়ে গেছে পাশের ঘরে।
আমি তো যাইনি। আপনিই পাঠিয়েছেন আমাকে। সে কথা বলেননি?
সে কথা বলার প্রয়োজন কি? তোমার গরজে গেছ তুমি। তোমার যাওয়ার দায়ভার আমার কাঁধে নেব কেন?
দায়ভার নেবেন কেন? সত্য কথাটা বলতেন। তাহলে খুশি হতো আপনার ছেলে। আমার গরজে গেছি শুনলে তো কষ্ট পাবেন তিনি। তাকে কষ্ট দিয়ে কি সুখ পাবেন আপনি? এই সহজ কথাটা বোঝেন না কেন? আমাকে ছোট করলে তো পুড়বে আপনার ছেলেই। আমাকে অবিশ্বাস করলে তো শেষ হয়ে যাবেন তিনি। বোঝেন না সহজ হিসেবটা? চিৎকার করে এবার প্রশ্ন করল কলি।
কলির উদ্যত কথায় টনক নড়ল রুশনা বেগমের। এমন করে ভেবে দেখেননি তিনি। ছেলের কষ্টের কথা শুনে শঙ্কিত হলেন। চুপচাপ বসে থাকলেন ঘরে।
কলি বলল, ফোনটা দিন। কল করি আমি।
কলির কথায় বাধা দিলেন না রুশনা বেগম। হ্যাঁ-বোধক সাড়াও দিলেন না। খাটের ওপর থেকে কলিই হাতে তুলে নিল মোবাইল সেট। কল ব্যাক করল রুস্তমের উদ্দেশে। ব্যালান্স নেই। ‘আউটগোয়িং সুবিধা বন্ধ আছে’ স্বয়ংক্রিয় মেসেজটি কানে ভেসে আসার সঙ্গে সঙ্গে হতাশার উত্তাল স্রোত যেন হ্যাঁচকা টান দিল ভাটির জলের মতো। হাহাকার করে উঠল বুকের ভেতরটা। ঝরনা হয়ে জেগে উঠতে চাইল। ঝরনার স্বচ্ছ ধারায় মুছে দিতে চাইল রুস্তমের কষ্ট। বসন্ত প্রহরের প্রকৃতির মতো বুলিয়ে দিতে চাইল আদর। সুযোগ না পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল কলি। কলির চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে কুঁকড়ে গেলেন রুশনা বেগম। বউমার চিৎকারের আড়ালে কষ্টটা বোঝার চেষ্টা করলেন তিনি। চিৎকারেও কষ্ট থাকে। সেই কষ্টে কোনো খাদ নেই। নিখাদ কষ্টের ছাপ মুহূর্তের মধ্যে বুকে ছাপ বসালেও, শৌর্যের প্রতি বউমার কৌতূহল মেনে নিতে পারলেন না। একবার বউমার অনুভব দিয়ে অনুভব করতে চাইলেন পুরো বিষয়টি। সামনে পা বাড়িয়ে আবার সরিয়ে নিচ্ছেন পা। যেন সামনে এগোলে পায়ে ছোবল বসাবে ঝোপের আড়ালে ওতপেতে থাকা বিষাক্ত কালো সাপ। উদ্ভাসিত হয়েও নিভে গেলেন তাই। বউমার উদ্দেশে বললেন, স্বামীর সন্দেহ বাড়ুক এমন কাজ না করলেও তো হয়।
এমন কি কাজ করেছি, আম্মাজান? প্রায় চিৎকার দিয়েই প্রশ্ন করল কলি।
কী করনি, বলো?
পাল্টা প্রশ্নে জোর দেখে হতবাক হয়ে গেল কলি। বুঝল, শাশুড়ির সঙ্গে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। নিজের মনে কাঁপন ধরা আগ্রাসী চিৎকারটি অবরুদ্ধ গোঙানিতে বদলে গেল মুহূর্তে। নিজের সামনে বহমান উন্মত্ত উত্তাল স্রোত কীভাবে পাড়ি দিতে হবে, জানা নেই কলির। রুস্তমের জন্য বুকের মন্দিরে গড়ে তোলা স্বর্গসৌধ ভয়াল স্বপ্নের মতো ভেঙে তছনছ হতে থাকল। বুকের আগুন-চিতায় পুড়তে থাকল এতদিন ধরে তীলে তীলে গড়ে তোলা স্বপ্নমন্দির; আলোর মসজিদ। কালো ধোঁয়া, আর উন্মত্ত গর্জনে দিশেহারা হয়ে কলি বলল, মোবাইলে রিচার্জ করিয়ে আনুন। আমি কথা বলব আপনার ছেলের সঙ্গে।
রুশনা বেগম বললেন, চাইবামাত্রই তো রিচার্জ করা যায় না, টাকা ভরা যায় না মোবাইলে রিচার্জ করতে যেতে হবে বাজারে। তাছাড়া আমাদের টাকা খরচ করতে হবে কেন, রুস্তমই প্রয়োজন থাকলে কল করবে।
এখন তিনি কল করবেন বলে মনে হচ্ছে না। নিশ্চয় কষ্টে আছেন। নিশ্চয় কল না করে অভিমানে ছটফট করছেন। দয়া করে মোবাইল ফোনে টাকা ভরে আনার ব্যবস্থা করুন। ওনার সঙ্গে আমার এখন কথা বলা জরুরি। আমার জন্য নয়। ওনার জন্যই জরুরি, বুঝেছেন?
প্রশ্নের জবাব পাওয়ার পূর্বেই হঠাৎ কমে গেল বুকের চাপ। কলি দেখল, বড় আকৃতির একটি রঙিন প্রজাপতি উড়ে এসে বসেছে ঘরের বেড়ার সঙ্গে ঝুলানো কাপড়ের ওপর। বাদামি রঙের পাখনার শেষ প্রান্তে রয়েছে সাদা রঙের দুই সারি গোলাকার কারুকাজ। এর পূর্বে এত বড় প্রজাপ্রতি দেখেনি কলি। প্রজাপতিটির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামান্য উড়ে সেটি বসল কলির ডান বাহুতে। বাহুতে বসা প্রজাপতি নিয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেল কলি। ভাবল, রুস্তমের পোড় খাওয়া মন প্রজাপতি হয়ে উড়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে নিজের বাহুতে। প্রজাপ্রতিটিকে আদর করার উদ্দেশ্যে যেই না ডান হাত দিয়ে ধরতে গেল, চট করে সেটি উড়াল দিয়ে বসল কলির মাথায়, আর নড়তে ইচ্ছা হলো না। প্রজাপতি মাথায় নিয়ে চুপচাপ বসে থাকল কলি।
ঝোপ-ঝাড় ছেড়ে, ফুল-পাতা ছেড়ে, প্রজাপতিটি হঠাৎ কেন ঢুকল ঘরে? কেন বসেছে কলির মাথায়? প্রশ্ন নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকল কলি। নড়তে চাইল না। মনে মনে বলল, প্রজাপতি! বসে থাক তুমি? এটা তোমার নিরাপদ আশ্রয়স্থল। প্রজাপতি! বলো তুমি, কেমন আছে আমার রুস্তম?
প্রজাপতির মুখে ভাষা নেই। নিজ মনেই কথা বলে যাচ্ছে কলিÑআমার হাতে জাদু নেই, জাদুদ নেই। মোহর নেই। কী দিয়ে খুশি করব তোমায়? কী দিয়ে বরণ করব? তুমি বসে থাক। যতক্ষণ খুশি বসে থাক। তোমার হয়ে বসে থাকব আমি। বসে থাকব জনম জনম... চলমান
৫.
বিত্তশালী আমির বাড়ির গেট পেরিয়ে ওয়েটিং রুমে বসে আছে রুস্তম। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়; দুবাই-কলির ইচ্ছায় ধাপে ধাপে এগোচ্ছে সব। চিফ অফিসার সিলেক্ট করেছেন ইলেকট্রিসিটি কাজে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রুস্তমকে। কোনো এক শেখ কন্যার বাথরুমের লাইট জ্বলছে না। সার্কিটে গ গোল হয়েছে। সমস্যা সারছে না। ঠিক করার জন্য দায়িত্ব পেয়ে খুশি হওয়ার কথা। খুশি নয়, উদ্বেগ বাড়ছে তার। উদ্বেগের কারণ দুবাই-কলি। কেন তাকে সিলেক্ট করা হয়েছে, জানে রুস্তম। সার্কিটের সমস্যাটা ভুয়া। তাও জানে। তবে সমস্যা কোথায়? কী সারাতে হবে? দুবাই-কলির লাজ-লজ্জাহীন বেপরোয়া কথা মনে পড়ছে ‘আমার দিকে তাকালে চিফ অফিসার আপনার বিরুদ্ধে নালিশ করবেন। আর না তাকালে আমি আপমানবোধ করব। কষ্ট পাব। আরেকটু বাড়িয়ে বাবাকে বলব, আপনি আমার সঙ্গে... করার চেষ্টা করেছেন। কিংবা বলেই বসতে পারি, জোর করে আমাকে... করেছেন। বুঝলেন?’ কথাটা মাথায় উদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কপালে ঘাম জমে গেছে। মাথায় চাপ বেড়ে গেছে। বুকেও চাপ অনুভব করছে রুস্তম। এমন লাগছে কেন? ওয়েটিং রুমে কি এয়ারকুলার চলছে না? এদিক-ওদিক তাকিয়ে বুঝল, হ্যাঁ। চলছে। তবুও ঘামছে কেন? উত্তর খুঁজে পেল না রুস্তম।
সøাইডিং ডোর ঠেলে এ সময় রুমে ঢুকল কালো আবায়ার আড়ালে ঢাকা দুই মেয়ে। গাউন প্যাটার্নের লম্বা ঢিলাঢালা আবায়ার সঙ্গে ম্যাচিং করে ওরা পরেছে হিজাব, স্কার্ফ। দুবাই নারীরা একঘেয়ে ফ্যাশনের এই ক্যাজুয়েল ড্রেজ পরে কমফোর্টেবল বোধ করে, স্বাচ্ছন্দ্যে কাজও করতে পারে ড্রেসটি পরে। সাধারণত শেখ পরিবারের কন্যারা এ ধরনের ড্রেস পরে না। জানে রুস্তম। ড্রেস দেখে বুঝল হাউস গবর্নেন্স কিংবা নারী কেয়ারটেকাররা এসেছে তাকে ভেতরে নিয়ে যেতে। ইতিপূর্বেও এমনটি ঘটেছে। অন্দর-মহলে পুরুষ কেউ থাকে না। নারীস্থানের মতো নারী দ্বারা পরিচালিত অন্দরমহলের প্রতিটি করিডরে সিসি ক্যামেরা থাকে জানে রুস্তম। তবে বেডরুমে কোনো ক্যামেরা থাকে না। ওয়েটিংরুমে ক্যামেরা থাকতে পারে ভেবে আগত মেয়ে দুজনের চোখের দিকে না তাকিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকল রুস্তম।
একজন বলল, চলুন ভেতরে। মাথা নিচু করে থাকতে হবে না। সিসি ক্যামেরা ফলো করছেন না আপনাকে। মাথা তুলুন। আসুন আমাদের সঙ্গে।
লম্বা মেয়েটির কথা শুনে উঠে দাঁড়াল রুস্তম। ওয়েটিংরুম থেকে বেরিয়ে পা বাড়াল সামনে। সুড়ঙ্গের মতো একটা পথের দিকে এগিয়ে গেল ওরা। আলো ঝলমলে সুড়ঙ্গপথের দেয়াল জুড়ে রয়েছে লুকিং গ্লাস। সেন্ট্রাল এয়ারকুলার চলছে। ঝকঝকে ফ্লোরের ওপর দিয়ে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের মেয়ে দুটো। আবয়ার আড়ালে ঢাকা ওদের দেহের গড়ন বোঝা যাচ্ছে না। তবে বোঝা যাচ্ছে একজন লম্বা, একজন বেঁটে। লম্বাজনই কথা বলছে। নিজেকে এখন আর দরিদ্র মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশের মিসকিন মনে হচ্ছে না। নিজেকে মহাবীর রুস্তমের মতোই রুস্তম মনে হচ্ছে। দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় দু’পাশে তাকিয়ে দেখল গ্লাসের ভেতর দিয়েও এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিফলিত দুই রুস্তম। ইতোমধ্যে সৌদি কাপড়ের জৌলুশে নিজের পোশাকের দৈন্যতা কমেছে। শার্ট-প্যান্ট পরনে থাকলেও নিজের স্বাতন্ত্র্য ক্ষমতা টের পাচ্ছে। লম্বা মেয়েটি হাঁটার গতি কমিয়ে রুস্তমের পাশাপাশি এসে বলল, এখানে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ মনিটরিং হচ্ছে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে। তবে কথা শোনা যাবে না বাইরে। অন্দরমহলের করিডরে থাকলেও ভেতর সিসি ক্যামেরা নেই। বুঝেছেন?
জি। বুঝেছি। এ বাড়িতে পূর্বেও এসেছি। তবে অন্দরমহলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। এবারই প্রথম যাচ্ছি।
মূল মহলে ঢুকতে হলে আপনাকে ড্রেস চেঞ্জ করতে হবে। বাইরের ড্রেস পরে ভেতরে যাওয়া নিষেধ।
কেন, নিষেধ কেন? প্রশ্ন করার সাহস পেয়ে জানতে চাইল রুস্তম ।
খোলা মাঠে-ময়দানে কাজ করেন, ঘুরে বেড়ান আপনারা। ড্রেসে ভর করে ধূলিকণা ঢুকে যেতে পারে, রোগ-জীবাণুও প্রবেশ করতে পারে অন্দরমহলে সাবধানতার জন্য এ ব্যবস্থা।
পুরুষ মানুষ কি অন্দরমহলে প্রবেশ করে না? সব পুরুষের জন্য কি একই ব্যবস্থা?
পুরুষ প্রবেশ না করলে নারীদের চলে? প্রশ্ন করেই খলবল করে হেসে উঠল মেয়েটি।
বেঁটে মেয়েটি লম্বাটির হাতে চিমটি দিয়ে বলল, হেসো না। পর-পুরুষের সঙ্গে তোমার হাসির ভঙ্গিমা মনিটরিং সেলের পর্দায় ফুটে উঠবে।
সাবধানবাণী শুনে ঘাবড়ে গেল রুস্তম। পাল্টা প্রশ্ন করার ইচ্ছা থেমে গেল। লম্বা মেয়েটিও গম্ভীর হয়ে বলল, ওঃ! ভুলে গিয়েছিলাম। অনেকদিন পর একজন পুরুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়ে অন্দরমহলে আইন নিষেধাজ্ঞার কথা চাপা পড়ে গিয়েছিল নিজের মগজেও। আইন-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আইনের সামান্য বিচ্যুতিতে এদেশে ঘটতে পারে ভয়াবহ দ কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে ঝলমল করে উঠতে থাকা রুস্তমের মুখের মলিন ছায়া ভেসে উঠল।
সুড়ঙ্গপথের দেয়ালে প্রতিফলিত রুস্তমের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে দৃশ্যটি টের পেল বেঁটে মেয়েটি। ইলেকট্রিসিটি সমস্যা সমাধানের জন্য টেকনিশিয়ান হিসেবে প্রবেশ করলেও আগত পুরুষ মানুষটি অন্দরমহলে একজন মেহমান। এ ধরনের মূল্যবোধই কাজ করে আভিজাত্যময় অন্দরমহলের নারী সার্ভেন্টস কিংবা কেয়ার টেকারদের উপলব্ধিতে। নিজেদের আবেগ-অনুভূতি বলে কিছু থাকতে নেই এই নিয়মের মধ্যে দিয়ে আইন-কানুন মেনে চলতে হয়। অন্দরমহলের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে হয়। মালিক পক্ষের স্ত্রী-কন্যাদের সুখ-সুবিধার দিকে নজর রাখতে হয়। রোবটের মতো জীবনযাপনে এখানে এর বাইরে কোনো চাহিদা নেই তাদের। তবুও রুস্তমের মলিন মুখ দেখে রোবট মনের ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে এল নরম মন। ‘পুরুষ মানুষ কি অন্দরমহলে প্রবেশ করে না? সব পুরুষের জন্য কি একই ব্যবস্থা?’ এই প্রশ্নের সঠিক জবাব না পেলে মেহমান অপমানবোধ করতে পারেন। যত ছোট কর্মচারী হোক না কেন, কাউকে অপমান করার অধিকার তাদের নেই ভেবে বেঁটে মেয়েটি বলল, আপনার প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, সম্পর্কে অনুমোদন আছে, এমন পুরুষরা অন্দরমহলে প্রবেশ করতে পারেন। তবে বাইরে থেকে এলে তাদেরকেও ড্রেস বদলাতে হয়। বাড়ির ক্যাম্পাসে থাকলে বদলানোর প্রয়োজন হয় না। ঘরোয়া পোশাক পরেই অন্দরমহলে যাওয়া-আসা করেন তারা।
ওঃ! তাহলে তো নিজেকে তুচ্ছ ভাবার কিছু নেই। পোশাক পরিবর্তনের জন্য অপমানবোধ করারও সুযোগ নেই।
ঠিকই ধরেছেন। নিজেকে তুচ্ছ ভাববেন কেন? কেন অপমানবোধ করবেন? আমরা অন্দরমহলের কর্মচারী। আপনিও কর্মচারী। বাইরের হলেও কর্মচারীদের শেখরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন না। নিজেদের পরিবারের সদস্য হিসেবে আলাদা মর্যাদা দেন। তবে ক্ষুদ্রতম ত্রুটি-বিচ্যুতি কিংবা নিজস্ব কাজের পরিধির সামান্য লঙ্ঘনও তারা বরদাশত করতে পারেন না। কথাটা মনে থাকা জরুরি।
সতর্ক করার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার উপদেশ মনে থাকবে আমার।
আমি কোনো উপদেশ দেইনি। কিছু তথ্য তুলে ধরলাম আপনার সামনে।
পূর্বে এ বাড়িতে এলেও, অন্দরমহলে ঢোকার স্কোপ এবারই প্রথম হলো। তথ্যগুলো জেনে থাকা জরুরীই মনে করল রুস্তম।
বেঁটে মেয়েটি আবার বলল, আপনি সৌভাগ্যবান!
কেন? সৌভাগ্যবান বলছেন কেন আমাকে?
যে-রুমে কাজ করার অনুমতি পেয়েছেন, কিংবা যার কাজ করার সম্মান অর্জন করেছেন, সেই ঘরে থাকেন এ বাড়ির সবচেয়ে ছোট কন্যা সবার আদরের, ফুলের চেয়ে সুন্দর ফুল, ফুলকুঁড়ি কিংবা কলি। আমাদের কলি। আমরা দু’জনে তার সেবায় নিয়োজিত থাকি। (চলবে..)
No comments