তৃণমূলে ছুটছে সবাই
রাজধানী থেকে তৃণমূলে ছুটছে রাজনৈতিক দলগুলো। নিজ নিজ পরিকল্পনা নিয়ে সবাই এখন তৃণমূলমুখী। নির্বাচনের পর স্থবির হয়ে থাকা নিজ নিজ দলকে চাঙ্গা ও শক্তিশালী করতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ বড় দলই যাচ্ছে তৃণমূলে।
দীর্ঘদিন পর নিজ দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের পদচারণায় এখন মুখরিত তৃণমূলের রাজনীতি। আড়ষ্টতা ভেঙ্গে আসত্মে আসত্মে চাঙ্গা হয়ে উঠছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। একটি বছর অনেকটাই দিবসভিত্তিক সাংগঠনিক তৎপরতার পর বড় দলগুলোর এই 'তৃণমূল মিশন'-এ সরগরম হয়ে উঠছে মাঠের রাজনীতি।প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তৃণমূলে ছুটছে বিপর্যসত্ম দলকে সংঘটিত করে সরকারবিরোধী আন্দোলন উপযোগী করে গড়ে তুলতে। পরিকল্পনার অংশ হিসাবে তৃণমূল নেতাদের মতামত নিতে সারাদেশে ১০টি সেমিনার করছে দলটি। অন্যদিকে সরকারী দল আওয়ামী লীগ তৃণমূল মিশন শুরম্ন করেছে তিন টার্গেট পূরণে। প্রথমত সরকার থেকে আলাদা করে উপর থেকে নিচ পর্যনত্ম দলকে শক্তিশালী করে ঢেলে সাজানো, প্রায় এক কোটি নতুন সদস্য সংগ্রহে ব্যাপক অভিযান এবং বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার পাশাপাশি সরকারের সাফল্যগুলো জনগণের সামতে তুলে ধরা।
শুধু আওয়ামী লীগ বা বিএনপিই নয়, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবিসহ অন্য ছোটখাটো রাজনৈতিক দলগুলোও তৃণমূল থেকে সংগঠনকে শক্তিশালী করার পরিকল্পনা নিয়েছে। দলগুলোর কেন্দ্রীয় ও শীর্ষ নেতাদের পদচারণায় সরগরম হয়ে উঠছে তৃণমূলের রাজনীতি। কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দিয়ে নয়, মাঠপর্যায়ের নেতাদের মতামতের ভিত্তিতেই কর্মসূচী বা উন্নয়ন পরিকল্পনা বাসত্মবায়ন করতে চায় সরকার ও বিরোধী দলগুলো। নির্বাচনের ১৪ মাস পর দলগুলোর কাছে বেড়ে গেছে তৃণমূল নেতাদের কদর। সংগঠনের প্রাণশক্তি তৃণমূল নেতাদের মূল্যায়নের আশ্বাস দেয়া হচ্ছে সব দলগুলো থেকেই।
তৃণমূল নেতাদের নিয়ে ইতোমধ্যে ঢাকায় বর্ধিত সভা করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সভাতেই ওই সভাতে তৃণমূল নেতারা ৰমতার আসার পর উপেৰা ও বঞ্চনার কথার পাশাপাশি সরকারের মধ্যে দল হারিয়ে যাওয়া, সাংগঠনিক স্থবিরতার কথা তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রীর সামনে। সবার কথা শুনে বর্ধিত সভা থেকেই তিনি দলকে শক্তিশালী করে ঢেলে সাজাতে কেন্দ্রীয় নেতাদের তৃণমূলমুখী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তৃণমুল নেতাদের মূল্যায়নের আশ্বাসের পাশাপাশি নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে দলকে ঢেলে সাজাতে বলেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সাত সাংগঠনিক সম্পাদককে।
সাংগঠনিক পুনর্গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, বিরোধী দলের সরকারবিরোধী প্রচার ও সম্ভাব্য আন্দোলন মোকাবেলায় সংগঠনকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে সুনির্দিষ্ট লৰ্য ও পরিকল্পনা নিয়ে তাঁদের তৃণমূল মিশন শুরম্ন হচ্ছে। মন্ত্রী ও দলীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের দূরত্ব কমানো, বিদ্যমান কোন্দল-দ্বন্দ্ব নিরসন, জেলা-উপজেলায় বর্ধিত সভা করে দলীয় সমস্যা চিহ্নিতকরণ, মাঠপর্যায়ে সরকারের সাফল্য ব্যাপকভাবে তুলে ধরা, বিরোধী দলের অপপ্রচারের জবাব দেয়া, ৰমতায় আসার পর চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ অনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করে নিয়ন্ত্রণ ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সর্বশেষ দেশের তরম্নণ ও নারী ভোটারদের আওয়ামী লীগের পতাকাতলে শামিল করতে সদস্য সংগ্রহ অভিযান জোরদার করাই প্রথম যাত্রায় তৃণমূল মিশনে নেয়া পরিকল্পনার প্রাধান্য পাবে।
আজ বরিশাল থেকে আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের সাংগঠনিক মিশন শুরম্ন হচ্ছে। প্রথম দিন বরিশাল মহানগর ও জেলায় বর্ধিত সভা হবে। এই বর্ধিত সভা থেকেই শুরম্ন হবে তৃণমূলে সদস্য নবায়ন ও নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযান। এছাড়া এ মাসেই অন্যান্য বিভাগেও দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা বর্ধিত সভা করে দলকে নতুন করে ঢেলে সাজানো ও সদস্য সংগ্রহ অভিযান জোরদার করার প্রথম ধাপ বাসত্মবায়ন করবেন। পাশপাশি প্রতিটি এলাকায় সংগঠনকে গতিশীল করার ৰেত্রে প্রধান সমস্যা এবং দ্বন্দ্ব-গ্রম্নপিং চিহ্নিত করবেন। প্রতিটি বর্ধিত সভায় স্ব স্ব এলাকার মন্ত্রী, এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকবেন। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় নেতারা সারাদেশে শুরম্ন করবেন ঝটিকা সাংগঠনিক সফর। সাংগঠনিক সম্পাদকদের তৃণমূল মিশন শেষে সারাদেশের একটি পূর্ণাঙ্গ সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করবেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় কমিটির সভা করে ইউনিয়ন থেকে শুরম্ন করে মহানগর পর্যনত্ম মেয়াদোত্তীর্ণ প্রতিটি কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমে ঢেলে সাজানোর দ্বিতীয় পরিকল্পনা বাসত্মবায়নে মাঠে নামবেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক কৃষিবিদ আফম বাহাউদ্দিন নাছিম জনকণ্ঠকে বলেন, আজ বরিশাল জেলা ও মহানগরের বর্ধিত সভা হবে। পর্যায়ক্রমে সব জেলা ও মহানগরে বর্ধিত সভা করা হবে। এসব সভার মাধ্যমে সাংগঠনিক দুর্বলতা নিরসন করে দলকে গতিশীল ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলা হবে। অন্য সাংগঠনিক সম্পাদকরাও জানান, আগামী সপ্তাহ থেকে তাঁরাও দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগে বর্ধিত সভার মাধ্যমে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরম্ন করবেন।
অন্যদিকে ইতোমধ্যে তৃণমূল থেকে দলগোছানোর কাজ শুরম্ন করেছে বিএনপি। দলটি মনে করে, এখনই সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার মতো শক্ত সাংগঠনিক শক্তি নেই তাদের। তৃণমূল থেকে দলকে গুছিয়ে আনার পরই সরকারবিরোধী বড় কোন আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। তাই তৃণমূলে গিয়ে নির্বাচনের পর বিপর্যসত্ম দলটির সাংগঠনিক শক্তিকে পূর্বের মতো সক্রিয় এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনের উপযোগী করে গড়ে তুলতে চায় দলটির নীতিনির্ধারকরা।
গত শনিবার সিলেট বিভাগে ইউনিয়ন প্রতিনিধি সভা করে দলটি তৃণমূল মিশন শুরম্ন করেছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয়ভাবে ওই সভাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের। তবে অভ্যনত্মরীণ কোন্দলে জর্জরিত দলটি তৃণমূলে সভা করতে গিয়ে প্রথমেই হোঁচট খেয়েছে। সভায় ইউনিয়ন প্রতিনিধি সভার সুপারিশ মূল্যায়নের কথা থাকলেও শেষ পর্যনত্ম অনুষ্ঠানটি শুধু তারেক-বন্দনায় পরিণত হয়। মূল্যায়নের জন্য করা সুপারিশগুলো উত্থাপনই করা হয়নি প্রতিনিধি সভায়। এমনকি সাংগঠনিক কোন দিক-নির্দেশনা বাদে সরকারের নানা কর্মকা-ের সমালোচনাতেই মুখর ছিলেন বক্তারা।
জানা গেছে, বিএনপি সিলেটের আরও ৯টি জেলায় ইউনিয়ন প্রতিনিধি সভা করবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ৭ বিভাগের ১০টি স্থানে সেমিনারের মাধ্যমে দলকে শক্তিশালী এবং সরকারবিরোধী করে সংগঠনকে চাঙ্গা করার প্রয়াস চালাবে। তবে প্রথম বৈঠক শেষে তৃণমূল নেতারা ৰোভ প্রকাশ করে বলেছেন, দলীয় কোন্দল মেটানো বা তৃণমূলের প্রতিনিধিত্ব কেন্দ্রে বাড়ানোর ব্যাপারে সভায় কিছু বলা হয়নি। হয়েছে শুধু তারেক রহমানসহ শীর্ষ নেতাদের বন্দনা। তবে দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের আশাবাদ, এই তৃণমূল মিশনে বিএনপি অবশ্যই ঘুড়ে দাঁড়াবে। তাঁরা জানান, ইউনিয়ন প্রতিনিধি সভা ছাড়াও সহসাই কেন্দ্রীয় নেতারা সারাদেশ সফরে বের হবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ-বিএনপি ছাড়াও অন্য দলগুলোও বসে নেই। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিও ৩শ' আসনেই দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। দলটির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ নিজেই জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, মহাজোটে দুর্বল নয়, শক্তিশালী পার্টনার হয়ে থাকতে চাই। তাই জাপাকে শক্তিশালী করতে দেশের প্রত্যেক জেলা-উপজেলায় কাউন্সিল হচ্ছে। প্রথমবারের মতো প্রতিটিস্থানে নির্বাচিত কমিটি গঠন করা হচ্ছে। প্রতি ইউনিয়নে ৯টি করে কমিটি গঠন করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমরা জাতীয় পার্টিকে ঘরে ঘরে নিয়ে যেতে চাই। এছাড়া জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, এলডিপি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জামায়াতে ইসলামীও সারাদেশে সংগঠনকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে নানা প্রয়াস চালাচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর এমন তৃণমূলমুখী হওয়ার প্রবণতাকে ইতিবাচক হিসাবেই দেখছে রাজনৈতিক বিশেস্নষকরা। তাঁদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের মতামতকে গুরম্নত্ব দেয়ার সিদ্ধানত্ম ভাল লৰণ। কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেয়ার কালচার বাদ দিয়ে যদি তারা তৃণমূলের মতামতের প্রাধান্য দেয় তবে জনগণ অবশ্যই উপকৃত হবে। তবে তার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও পরস্পরের মধ্যে সহনশীলতা। তৃনমূলের নেতারা যদি সহনশীলতার চর্চা করে তাহলে পজিটিভ রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আসবে। আর যদি তারা সাংঘর্ষিক রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে তাহলে দেশ ফিরে যাবে হানাহানি-মারামারি, হরতাল-অবরোধ-ঘেরাওয়ের মতো জনগণ থেকে প্রত্যাখাত অতীত রাজনীতির দিকেই।
No comments