চাকরি জাতীয়করণ দাবিতে আন্দোলন ॥ স্কুল-কলেজ অচল- মাঠে নেমেছে সরকার সমর্থক ও সরকারবিরোধী সংগঠন ॥ ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে ॥ সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা
চাকরি জাতীয়করণ, শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন ও এমপিওভুক্তির দাবিতে বেসরকারী শিক্ষকদের লাগাতার আন্দোলনে অচলাবস্থায় জড়িয়ে পড়েছে সারাদেশের বেসরকারী স্কুল-কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম।
টানা এক সপ্তাহ ধরে একের পর এক সংগঠনের ধর্মঘটে জিম্মি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী। স্কুলে এলেও পাঠদান থেকে বিরত থাকছেন শিক্ষকরা। শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠন সক্রিয় না থাকায় রাজধানীর কিছু নামী প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক থাকলেও অচল হয়ে পড়েছে ঢাকার বাইরের অধিকাংশ বেসরকারী স্কুল-কলেজ। অবস্থা এমন যে চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে মাঠে নেমে পড়েছে সরকার সমর্থক ও সরকারবিরোধী অসংখ্য সংগঠন। প্রতিদিন প্রতিষ্ঠান বর্জন করে জেলায়-উপজেলায় চলছে সমাবেশ। এদিকে পুরো শিক্ষা জাতীয়করণের জন্য আগামী ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে ১১টি সংগঠনের মোর্চা জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্ট। তবে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হলেও অর্থ সঙ্কটের মধ্যে মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষা জাতীয়করণ দাবি কতটুকু বাস্তবসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এর আগে গত ৯ জানুয়ারি জাতির জনকের ঘোষণার দীর্ঘ চার দশক পর ২৬ হাজারেরও বেশি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংবিধান, জাতীয় শিক্ষানীতি তথা দেশের শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে এ ধরনের ঘোষণা দেয়ায় রীতিমতো উৎসব এখন লক্ষাধিক শিক্ষক পরিবারে। ৪০ বছর পর এমন ঘোষণাকে দেশের শিক্ষার উন্নয়নে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করেছেন শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এ উদ্যোগ নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে বেসরকারী মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের শিক্ষক সংগঠনগুলোকে। জানা গেছে, শিক্ষানীতিতে শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, জাতীয় জীবনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অত্যধিক। দেশের সব মানুষের শিক্ষার আয়োজন এবং জনসংখ্যাকে দক্ষ করে তোলার ভিত্তিমূল প্রাথমিক শিক্ষা। তাই মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের জন্য জাতিসত্তা, আর্থ-সামাজিক, শারীরিক-মানসিক সীমাবদ্ধতা এবং ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে দেশের সকল শিশুর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। এ কাজ করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, সকলের জন্য মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ সংবিধানে বিধৃত আছে। তাই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং রাষ্ট্রকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব বেসরকারী বা এনজিও খাতে হস্তান্তর করা যাবে না। কোন ব্যক্তি বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বা কোন এনজিও প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা করতে চাইলে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান পালন করে করতে হবে। সরকারের জাতীয়করণের এ ঘোষণাকে সংবিধান ও শিক্ষানীতির সবচেয়ে বড় প্রতিফলন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এবার জাতীয়করণসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলতে বেসরকারী মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের সব সংগঠন এখন আন্দোলনের মাঠে। এমপিওভুক্ত ও এমপিওবিহীন, সরকার সমর্থক ও সরকারবিরোধী সব শিক্ষক সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন দাবি নিয়ে প্রতিদিন কর্মসূচী পালন করছে। শিক্ষক সংগঠনগুলোর দুটি বড় মোর্চার ডাকে ১০ জানুয়ারি সকাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট চলছে। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে এসব প্রতষ্ঠানে ক্লাস না হওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণের ঘোষণায় তারা আশান্বিত। তারা মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও জাতীয়করণ দেখতে চান।
অবশ্য এ নিয়ে শিক্ষক সংগঠনগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ চাইছেন শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ। কেউ চাইছেন পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণ। ধর্মঘটী কয়েক শিক্ষক নেতা বলেন, বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারী অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথচ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার শতকরা ৯৭ ভাগই বেসরকারী। দীর্ঘদিন বিভিন্ন শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনের ব্যানারে চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সে দাবি মানা হয়নি। যার কারণে তারা বাধ্য হয়ে ধর্মঘট পালন করছেন।
জানা গেছে, রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় কিছু সরকারী ও বেসরকারী স্কুল-কলেজে দায়সারাভাবে পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত আছে, যেগুলোতে শিক্ষক নেতাদের দাপট কিছুটা কম। গ্রাম, মফস্বল কিংবা জেলা পর্যায়ের বেশিরভাগ বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ধর্মঘট চলছে। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে চলমান আন্দোলন বেগবান ও দীর্ঘ করারও হুমকি দিয়েছেন শিক্ষক নেতারা। কিন্তু এই সঙ্কট নিরসনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) কোন সক্রিয় তৎপরতা নেই। মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষকদের সব দাবি মেনে নেয়ার কোন রকম বাস্তবতা নেই। কারণ প্রতিটি দাবির পেছনেই আর্থিক সংশ্লেষণ আছে। সরকারের সীমাবদ্ধতাও আছে। চাইলেই এসব দাবি মানা সম্ভব নয়। তাছাড়া প্রত্যেক সরকারের শেষের বছরে নানা দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষকরা। এটা নতুন কিছু নয়। সরকারবিরোধী একাধিক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনে ইন্ধন যোগানো হচ্ছে। সরকার সমর্থক দেশের সবচেয়ে বৃহৎ শিক্ষক সংগঠন ‘শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের’ অন্যতম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন, ‘চাকরি জাতীয়করণ, শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়ন, সম্মানজনক হারে বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি, ইনক্রিমেন্টসহ ১৭ দফা দাবিতে সারাদেশের ৩০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গত ১২ জানুয়ারি থেকে ধর্মঘট চলছে। প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক বর্তমানে ধর্মঘটে আছেন। শিক্ষক-কর্মচারী সংগ্রামী ঐক্য পরিষদ গত ১০ জানুয়ারি থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবিরাম ধর্মঘট পালন করছে। এই সংগঠনের অন্যান্য দাবির মধ্যে আছে, চাকরি জাতীয়করণ, ১০০ টাকা বাড়ি ভাড়ার পরিবর্তে সরকারী শিক্ষকদের ন্যায় বাড়ি ভাড়া, ১৫০ টাকা চিকিৎসা ভাতার পরিবর্তে সরকারী নিয়মে চিকিৎসা ভাতা, ২৫ শতাংশের পরিবর্তে পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা প্রদান ও বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধি। বর্তমানে বেসরকারী এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ১২০/১২৫ টাকা হারে ইনক্রিমেন্ট পাচ্ছেন। এ বিষয়ে শিক্ষক-কর্মচারী সংগ্রামী ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও শিক্ষক সমিতি (নজরুল) নজরুল ইসলাম রনি বলেন, প্রায় ৩০ হাজার বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবিরাম ধর্মঘট চলছে। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে। শিক্ষকরা রাজপথ ছাড়বে না। তিনি বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক যে এক সপ্তাহ ধরে ধর্মঘট চলছে, অথচ সরকারের কোন টনক নড়ছে না। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (মাধ্যমিক) সভাপতি রঞ্জিত কুমার সেন জানান, চাকরি জাতীয়করণসহ ১৭ দফা দাবিতে গত ১০ জানুয়ারি থেকে সারাদেশের বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবিরাম ধর্মঘট চলছে। বিএনপিপন্থী শিক্ষক সংগঠন শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটও মাঠে সংগঠনের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া বলেছেন, দেশের শতকরা ৭৮ ভাগ ছাত্রছাত্রীর দায়-দায়িত্ব বেসরকারী শিক্ষকদের কাঁধে। তাই তাদের ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চলতে পারে না। শিক্ষকদের কাছে সব ছাত্রছাত্রী সমান। তাই একইভাবে সরকারকেও সব শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে বৈষম্য দূর করতে হবে। এদিকে বৃহস্পতিবারও দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় শিক্ষা জাতীয়করণের লক্ষ্যে সমাবেশ ও মিছিল করেছে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (কামরুজ্জামান), শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোট, শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যপরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন। অন্যদিকে শিক্ষা জাতীয়করণের জন্য আগামী ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে ১১টি সংগঠনের মোর্চা জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্ট। ইতোমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ শিক্ষা জাতীয়করণের লক্ষ্যে এমপিওভুক্ত বেসরকারী স্কুল-কলেজ, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক- কর্মচারীদের দাবি মেনে নিয়ে তাঁদের সরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের অনুরূপ বর্তমান জাতীয় স্কেলে চিকিৎসা ভাতা, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা ও স্কেলের শতকরা হারে বাসা ভাড়াসহ ৮ দফা দাবি ও শিক্ষার উন্নয়নে ৭ সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এর আগে গত ৯ জানুয়ারি জাতির জনকের ঘোষণার দীর্ঘ চার দশক পর ২৬ হাজারেরও বেশি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংবিধান, জাতীয় শিক্ষানীতি তথা দেশের শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে এ ধরনের ঘোষণা দেয়ায় রীতিমতো উৎসব এখন লক্ষাধিক শিক্ষক পরিবারে। ৪০ বছর পর এমন ঘোষণাকে দেশের শিক্ষার উন্নয়নে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করেছেন শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এ উদ্যোগ নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে বেসরকারী মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের শিক্ষক সংগঠনগুলোকে। জানা গেছে, শিক্ষানীতিতে শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, জাতীয় জীবনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অত্যধিক। দেশের সব মানুষের শিক্ষার আয়োজন এবং জনসংখ্যাকে দক্ষ করে তোলার ভিত্তিমূল প্রাথমিক শিক্ষা। তাই মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের জন্য জাতিসত্তা, আর্থ-সামাজিক, শারীরিক-মানসিক সীমাবদ্ধতা এবং ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে দেশের সকল শিশুর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। এ কাজ করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, সকলের জন্য মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ সংবিধানে বিধৃত আছে। তাই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং রাষ্ট্রকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব বেসরকারী বা এনজিও খাতে হস্তান্তর করা যাবে না। কোন ব্যক্তি বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বা কোন এনজিও প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা করতে চাইলে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান পালন করে করতে হবে। সরকারের জাতীয়করণের এ ঘোষণাকে সংবিধান ও শিক্ষানীতির সবচেয়ে বড় প্রতিফলন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এবার জাতীয়করণসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলতে বেসরকারী মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের সব সংগঠন এখন আন্দোলনের মাঠে। এমপিওভুক্ত ও এমপিওবিহীন, সরকার সমর্থক ও সরকারবিরোধী সব শিক্ষক সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন দাবি নিয়ে প্রতিদিন কর্মসূচী পালন করছে। শিক্ষক সংগঠনগুলোর দুটি বড় মোর্চার ডাকে ১০ জানুয়ারি সকাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট চলছে। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে এসব প্রতষ্ঠানে ক্লাস না হওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণের ঘোষণায় তারা আশান্বিত। তারা মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও জাতীয়করণ দেখতে চান।
অবশ্য এ নিয়ে শিক্ষক সংগঠনগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ চাইছেন শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ। কেউ চাইছেন পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণ। ধর্মঘটী কয়েক শিক্ষক নেতা বলেন, বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারী অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথচ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার শতকরা ৯৭ ভাগই বেসরকারী। দীর্ঘদিন বিভিন্ন শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনের ব্যানারে চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সে দাবি মানা হয়নি। যার কারণে তারা বাধ্য হয়ে ধর্মঘট পালন করছেন।
জানা গেছে, রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় কিছু সরকারী ও বেসরকারী স্কুল-কলেজে দায়সারাভাবে পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত আছে, যেগুলোতে শিক্ষক নেতাদের দাপট কিছুটা কম। গ্রাম, মফস্বল কিংবা জেলা পর্যায়ের বেশিরভাগ বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ধর্মঘট চলছে। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে চলমান আন্দোলন বেগবান ও দীর্ঘ করারও হুমকি দিয়েছেন শিক্ষক নেতারা। কিন্তু এই সঙ্কট নিরসনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) কোন সক্রিয় তৎপরতা নেই। মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষকদের সব দাবি মেনে নেয়ার কোন রকম বাস্তবতা নেই। কারণ প্রতিটি দাবির পেছনেই আর্থিক সংশ্লেষণ আছে। সরকারের সীমাবদ্ধতাও আছে। চাইলেই এসব দাবি মানা সম্ভব নয়। তাছাড়া প্রত্যেক সরকারের শেষের বছরে নানা দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষকরা। এটা নতুন কিছু নয়। সরকারবিরোধী একাধিক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনে ইন্ধন যোগানো হচ্ছে। সরকার সমর্থক দেশের সবচেয়ে বৃহৎ শিক্ষক সংগঠন ‘শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের’ অন্যতম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন, ‘চাকরি জাতীয়করণ, শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়ন, সম্মানজনক হারে বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি, ইনক্রিমেন্টসহ ১৭ দফা দাবিতে সারাদেশের ৩০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গত ১২ জানুয়ারি থেকে ধর্মঘট চলছে। প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক বর্তমানে ধর্মঘটে আছেন। শিক্ষক-কর্মচারী সংগ্রামী ঐক্য পরিষদ গত ১০ জানুয়ারি থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবিরাম ধর্মঘট পালন করছে। এই সংগঠনের অন্যান্য দাবির মধ্যে আছে, চাকরি জাতীয়করণ, ১০০ টাকা বাড়ি ভাড়ার পরিবর্তে সরকারী শিক্ষকদের ন্যায় বাড়ি ভাড়া, ১৫০ টাকা চিকিৎসা ভাতার পরিবর্তে সরকারী নিয়মে চিকিৎসা ভাতা, ২৫ শতাংশের পরিবর্তে পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা প্রদান ও বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধি। বর্তমানে বেসরকারী এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ১২০/১২৫ টাকা হারে ইনক্রিমেন্ট পাচ্ছেন। এ বিষয়ে শিক্ষক-কর্মচারী সংগ্রামী ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও শিক্ষক সমিতি (নজরুল) নজরুল ইসলাম রনি বলেন, প্রায় ৩০ হাজার বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবিরাম ধর্মঘট চলছে। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে। শিক্ষকরা রাজপথ ছাড়বে না। তিনি বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক যে এক সপ্তাহ ধরে ধর্মঘট চলছে, অথচ সরকারের কোন টনক নড়ছে না। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (মাধ্যমিক) সভাপতি রঞ্জিত কুমার সেন জানান, চাকরি জাতীয়করণসহ ১৭ দফা দাবিতে গত ১০ জানুয়ারি থেকে সারাদেশের বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবিরাম ধর্মঘট চলছে। বিএনপিপন্থী শিক্ষক সংগঠন শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটও মাঠে সংগঠনের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া বলেছেন, দেশের শতকরা ৭৮ ভাগ ছাত্রছাত্রীর দায়-দায়িত্ব বেসরকারী শিক্ষকদের কাঁধে। তাই তাদের ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চলতে পারে না। শিক্ষকদের কাছে সব ছাত্রছাত্রী সমান। তাই একইভাবে সরকারকেও সব শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে বৈষম্য দূর করতে হবে। এদিকে বৃহস্পতিবারও দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় শিক্ষা জাতীয়করণের লক্ষ্যে সমাবেশ ও মিছিল করেছে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (কামরুজ্জামান), শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোট, শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যপরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন। অন্যদিকে শিক্ষা জাতীয়করণের জন্য আগামী ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে ১১টি সংগঠনের মোর্চা জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্ট। ইতোমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ শিক্ষা জাতীয়করণের লক্ষ্যে এমপিওভুক্ত বেসরকারী স্কুল-কলেজ, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক- কর্মচারীদের দাবি মেনে নিয়ে তাঁদের সরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের অনুরূপ বর্তমান জাতীয় স্কেলে চিকিৎসা ভাতা, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা ও স্কেলের শতকরা হারে বাসা ভাড়াসহ ৮ দফা দাবি ও শিক্ষার উন্নয়নে ৭ সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
No comments