মালালারা পরাভব মানতে জানে না by গাজীউল হাসান খান

চতুর্দশী পাকিস্তানি স্কুলছাত্রী মালালা ইউসুফজাই এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। মাথায় গুলিবিদ্ধ শান্ত-স্নিগ্ধশ্রী মালালা এখন অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে আছে বার্মিংহামের একটি বিশেষ হাসপাতালে। পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকা থেকে একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে গত সপ্তাহে তাকে যুক্তরাজ্যে আনা হয়েছে বিশ্বমানের চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য।


পাকিস্তানি তালেবানদের গুলির আঘাতে নিশ্চল-নিস্তব্ধ হয়ে পড়া মালালার জীবনের সব আশঙ্কা এখনো কেটে না গেলেও তার অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতির দিকে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিশোরী মালালার অপরাধ, সে শিক্ষার আলো পেতে চেয়েছিল। পাকিস্তানি তালেবান অধ্যুষিত ওয়াজিরিস্তান অঞ্চলে মেয়েদের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিল। নারীশিক্ষা ও নারীদের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পাকিস্তানি তালেবানদের বিরুদ্ধে লিখিত একটি বিশেষ রচনার জন্য মালালাকে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানের জাতীয় শান্তি পুরস্কার এবং সেটিই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিষ্পাপ বিদ্যোৎসাহী মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রী মালালার জন্য। মালালার বিরুদ্ধে পশ্চিমা ধ্যান-ধারণার প্রচার ও প্রসারের অভিযোগ এনেছে পাকিস্তানি তালেবানরা। তারা তাকে পশ্চিমা চর ও ইসলামের শত্রু হিসেবেও চিহ্নিত করেছে। সোয়াত জেলার মিনগোরা শহরের একটি মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রী ছিল সে। স্কুল শেষে সম্প্রতি তাদেরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছোট্ট একটি বাসে করে বাড়ি ফিরছিল মালালা। তালেবানরা সে অবস্থায়ই তার ওপর আক্রমণ চালায়। তাতে তার মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়। তা ছাড়া গুলিতে তার আরো দুজন সহপাঠী আহত হয়। তারা সোয়াতেই এখন চিকিৎসাধীন।
মালালাকে যতক্ষণ পর্যন্ত হত্যা করা না যাচ্ছে, ততক্ষণ তালেবানরা তার ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। মেয়েরা ঘরের বের হয়ে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা সাংসারিক কেনাকাটার জন্য হাটবাজারে যাক, সেটা চায় না তালেবানরা। নাইন-ইলেভেনের অনাকাঙ্ক্ষিত ধ্বংসযজ্ঞের পর গত ১১ বছরে বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলায় প্রায় ৩০ হাজার সাধারণ পাকিস্তানি নিহত ও হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ আহত হয়েছে। পাকিস্তানের পক্ষে এখনো দারিদ্র্য, চরম বিদ্যুৎ সংকট এবং গত বন্যার কারণে বিশাল পরিমাণ খাদ্য ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ মেয়ে এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। শিক্ষাসহ আর্থ-সামাজিক অনেক ক্ষেত্রেই ২০১৫ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভব হবে না। প্রকৃত শিক্ষাবঞ্চিত ও প্রগতিবিমুখ একটি ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠীর হাতে যেন পুরো পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ বাঁধা পড়ে গেছে, যারা প্রকৃত অর্থে না বোঝে ইসলাম, না বোঝে শিক্ষার মর্যাদা। একদিকে একটি ধর্মান্ধ সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং অপরদিকে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত একটি রাজনৈতিক মহলের খপ্পরে পড়ে একটি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান যেন ক্রমেই আরো বহুমুখী সমস্যার নিগড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে, যা মোটেই কাম্য নয়।
এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ইসলামের সর্বব্যাপী ও শক্তিশালী পরিকাঠামোর মধ্যে এই উপমহাদেশে, বিশেষ করে পাকিস্তানে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা এক ছদ্মবেশী গুপ্তঘাতকের মতো নিজস্ব স্থান করে নিয়েছে। অশিক্ষিত, পশ্চাৎপদ ও মেধা-মননহীন ধর্মান্ধ শক্তি কিংবা মৌলবাদীরা একটি অগ্রসরমান রাষ্ট্র কিংবা জাতির কী সর্বনাশ ঘটাতে পারে, ক্রমেই তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তান অঞ্চলে। সেখানে পাকিস্তানি তালেবান নামধারী যে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে, তারা অতীতে একসময় পুরো সোয়াত উপত্যকাটিই দখল করে নিয়েছিল। পার্বত্য আফগান ও তালেবানদের সহযোগিতায় এই ধর্মান্ধ শক্তি উল্লিখিত অঞ্চলে তাদের এক ধরনের স্বঘোষিত ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। পশতুভাষী পাখতুন বা পাশতুজ অঞ্চলের পাকিস্তান-আফগান জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি রয়েছে, যা কতটা উগ্র জাতীয়তাবাদী আর কতটা ধর্মান্ধ, তা স্পষ্ট করে বলা অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার। কারণ পাঠান জাতি হিসেবে পরিচিত এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর একটি নিজস্ব প্রাচীন ও সংরক্ষিত ঐতিহ্য রয়েছে। তারা বহিঃশক্তির বশ্যতা সহজে কখনো স্বীকার করেনি। সুউচ্চ কঠিন পর্বতঘেরা এ অঞ্চলের মানুষ একদিকে যেমন বেশ কিছুটা বিচ্ছিন্ন, তেমনি আধুনিক শিক্ষাদীক্ষায়ও তারা তুলনামূলকভাবে অনেকটা অনগ্রসর বলে ধারণা রয়েছে।
পাকিস্তানের পাশতুন জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে তাদের চরমপন্থী আফগান তালেবান ভাইদের যথেষ্ট প্রভাব পড়েছে, তার প্রমাণ ওয়াজিরিস্তান অঞ্চলে পাকিস্তানি তালেবান বাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আফগানিস্তানের তালেবানদের মতো তারাও ওয়াজিরিস্তানে এবং বিশেষ করে সোয়াত অঞ্চলে নারীশিক্ষা সম্পূর্ণ বন্ধ করে নারী সমাজকে গৃহবন্দি করে ফেলতে চাইছে। যদিও তালেবান শব্দের অর্থ হচ্ছে শিক্ষার্থী কিংবা জ্ঞান অনুসন্ধানী সমাজ, তবুও তারা নারীশিক্ষার্থীদের পর্দার দোহাই দিয়ে জ্ঞানচর্চা কিংবা শিক্ষা লাভ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করতে চায়। অথচ সৌদি আরবের কাবা শরীফের পাশেই নারীশিক্ষা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ পৃথক মক্কা নগরীতে স্থাপন করা হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য কলেজ। ইসলামে ধর্মীয়ভাবেই শিক্ষা বিস্তারের ওপর যথেষ্ট জোর দেওয়া হয়েছে। ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিক্ষা অর্জনের জন্য দুর্গম স্থানে যাওয়ার উপদেশও দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের কোথাও নারীশিক্ষার ব্যাপারে নূ্যনতম কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি। তা ছাড়া মহানবীর কোনো বাণীতেও এর কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। ইসলামে নারী সমাজ যদি শিক্ষিতই না হয়, তাহলে পবিত্র কোরআনের জ্ঞান ও হাদিসের শিক্ষা তারা পাবে কিভাবে? নারীকে তার আত্মসম্মান, মর্যাদা ও শ্লীলতা রক্ষার জন্য যে পর্দার বিধান দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে উল্লিখিত ধর্মান্ধগোষ্ঠী নারীশিক্ষাকে অত্যন্ত গর্হিত পন্থায় সাংঘর্ষিক করে তুলেছে। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী ইসলামী পণ্ডিত ও আলেম সমাজের এ মুহূর্তেই এগিয়ে আসা উচিত বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করে।
সোয়াত উপত্যকার মিনগোরা শহরের স্কুলছাত্রী মালালা ও তার সহপাঠীদের ওপর সশস্ত্র হামলার বিরুদ্ধে শুধু ওয়াজিরিস্তানের নারী সমাজ নয়, পাকিস্তানসহ বিশ্ব মানবতা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানি তালেবানদের চরম হুমকির মুখেও বন্ধ করে দেওয়া হয়নি মেয়েদের কোনো স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মালালার বাবা ইউসুফজাই মিনগোরার সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক, যেখান থেকে তালেবানদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদের ঝড় ছড়িয়ে পড়েছিল। তালেবানরা তাদের অঞ্চল ইসলামী শরিয়াহ আইনের প্রবর্তন চায়। কিন্তু তার সঙ্গে নারীশিক্ষা কিংবা শিক্ষাব্যবস্থার যেমন কোনো বিরোধ নেই, তেমনি নারী সমাজের অধিকার খর্ব করারও কোনো সুযোগ নেই। আজ পাঠান অধ্যুষিত পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশ কিংবা তালেবান প্রভাবাধীন বিভিন্ন অঞ্চলেও ইসলামী ধ্যান-ধারণার অপপ্রয়োগ, প্রাগৈতিহাসিক মানসিকতা কিংবা শরিয়াহ আইনের অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠতে শুরু করেছে। আফগানিস্তানের মতো পাকিস্তানকেও নব্য তালেবানরা এমন একটি অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়, যার সঙ্গে ইসলামের তেমন কোনো তাত্তি্বক সম্পর্ক নেই, যতটা আছে অনগ্রসর তালেবানদের মান্ধাতা আমলের মানসিকতা। কৃষি, শিল্প ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাকিস্তান যখন এগিয়ে যেতে শুরু করেছিল, ঠিক তখনই তাদের ওপর নেমে আসে তালেবানি সন্ত্রাস ও গণবিরোধী তৎপরতা। পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই হচ্ছে নারী। তাদের দুই-তৃতীয়াংশের কাছে এখনো কাঙ্ক্ষিতভাবে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। এত বড় একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে অন্ধকারে রেখে বিশ্বের কোনো দেশেই প্রকৃত উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাপী আজ এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে। তা ছাড়া ইসলামী পণ্ডিত ও আলেম সমাজও মনে করে, প্রকৃত শিক্ষা ছাড়া সমাজ থেকে পশ্চাৎপদতা, কূপমণ্ডূকতা, অনগ্রসরতা, প্রচলিত বদ্ধমূল বিভ্রান্তিসহ কোনো অপতৎপরতাই উচ্ছেদ করা যাবে না। সত্যিকার অর্থে গভীর উপলব্ধি নিয়ে ইসলামকে বুঝতে হলে এবং জানতে হলেও চাই আদর্শ শিক্ষা। স্কুলছাত্রী মালালাসহ তার সহপাঠীরা সে সত্যটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল। তাই শত বাধা অতিক্রম করে তারা শিক্ষার পথ বেছে নিয়েছিল মুক্তির পাথেয় হিসেবে। সে কারণেই শুধু স্বদেশে নয়, পশ্চিমা জগতেও এখন আলোকিত সব মানুষের কাছে মালালা একটি সংগ্রামী আদর্শের নাম হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। ১৬ অক্টোবর সংখ্যা লন্ডন 'ইংভিনিং স্ট্যান্ডার্ড'-এ যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ 'মালালা সিম্বলাইজেস্ দ্য স্ট্রাগল ফর দ্য ফিউচার অব পাকিস্তান' (মালালা পাকিস্তানের ভবিষ্যতের পথে সংগ্রামের স্মারক) শিরোনামে একটি দীর্ঘ কলাম লিখেছেন। তাতে তিনি লিখেছেন, আজকের পাকিস্তান ও তার গণতান্ত্রিক শাসক সমাজকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী একটি বিরাট ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তান আজ অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে একটি চরমপন্থী, সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী ধর্মান্ধগোষ্ঠীর আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়েছে। ফলে তার নিরাপত্তাব্যবস্থা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। আল-কায়েদাসহ যেকোনো উগ্রপন্থী সন্ত্রাসীদের দ্বারা যেকোনো মুসলিমপ্রধান দেশে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সর্বত্র চাই একটি প্রকৃত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। একমাত্র প্রকৃত শিক্ষাই সব ধরনের বিভ্রান্তি, কুসংস্কার ও সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে উন্নয়নকামী জনগোষ্ঠীকে পথ দেখাতে পারে। উইলিয়াম হেগ তাঁর লেখায় পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, আগামী চার বছরে যুক্তরাজ্য পাকিস্তানের ৪০ লাখ স্কুল ছাত্রছাত্রীকে সরাসরি সাহায্য দেবে। তা ছাড়া অনগ্রসর এলাকায় তাদের উপযুক্ত শিক্ষার জন্য ৪৫ হাজার নতুন শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেছেন, এ বছর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীরা (যুক্তরাজ্য ও পাকিস্তান) ২০১৫ সালের মধ্যে তাঁদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আড়াই বিলিয়ন পাউন্ড-স্টার্লিংয়ে উন্নীত করার একটি কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। বর্তমানে ১০০টির বেশি যুক্তরাজ্যভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা করছে। তা ছাড়া শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধনের জন্য পাকিস্তানের ১১৮টি বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাজ্যের ৯০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। উইলিয়াম হেগ মালালার প্রশংসা করে লিখেছেন, মালালা শিক্ষার আলো পেতে চেয়েছিল, ভবিষ্যতে একজন ডাক্তার হয়ে সমাজসেবা করতে চেয়েছিল, এতে তো তার কোনো অন্যায় ছিল না। তাহলে কেন তার নিষ্পাপ জীবনের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল? কেন সে অঞ্চলের ছাত্রীদের ওপর পাকিস্তানি তালেবানদের এত আক্রোশ? তারা শিক্ষিত হলে পুরো জাতি তাদের মাধ্যমে শিক্ষার আলো পাবে। আর তাতে সমাজ থেকে দূর হয়ে যাবে অনগ্রসরতা, পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কার ও সব মিথ্যা অবরোধ। মুখোশ খুলে যাবে অশিক্ষিত মোল্লাদের মধ্যযুগীয় মানসিকতার এবং অবসান ঘটবে তাদের সশস্ত্র আধিপত্যের।
মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ কিংবা জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক অতীতে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে- এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সে কারণেই আজ বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে সব পরিবারের মেয়েদের পক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। নতুবা মোল্লারা কবেই ইসলামের নামে এক মিথ্যা ফতোয়া দিয়ে বাংলাদেশে নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে দিত। এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় যে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে এখন ছাত্রের তুলনায় ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় সমান সমান। কোথাও কোথাও মেয়েদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশিও দেখা যায়। এ ধারা অব্যাহত রাখা গেলে আমাদের জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে শিক্ষিত নারী সমাজের অবদান হবে উল্লেখযোগ্য। জাতিসংঘ ঘোষিত 'সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা' অর্জনে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ভূমিকার যেমন কোনো বিকল্প নেই, তেমনি জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রকৌশল-প্রযুক্তি এবং এমনকি সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বৃহত্তর সাফল্য অর্জনেও তাদের অবদান হবে অসামান্য।
মালালাকে উল্লেখ করা হয়েছে পাকিস্তানের বেগম রোকেয়া হিসেবে। কিন্তু সে যুগেও কোনো রোকেয়াকে পাকিস্তানি তালেবানদের মতো বর্বর সশস্ত্র বাহিনীর মোকাবিলা করতে হয়নি। বুলেটবিদ্ধ হতে হয়নি শিক্ষালাভের জন্য। এ অবস্থাটি উপলব্ধি করার চেষ্টা করা হলে মনে হবে, পাকিস্তানের কোনো কোনো অঞ্চল এখনো সেই মধ্যযুগীয় মানসিকতা কিংবা বর্বরতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তার জন্য মূলত দায়ী প্রকৃত শিক্ষার অভাব। যথাযথ শিক্ষার আলো পেলে অনগ্রসর, ধর্মান্ধ ও বিভ্রান্ত সব জনগোষ্ঠীর জীবনের অন্ধকার কেটে যাবে। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাও হবে সবার কাছে আরো অনেক অর্থবহ ও কল্যাণমূলক। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার বাণীবাহক হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে উদ্দেশ করে প্রথম যে বাক্যটি উচ্চারণ করা হয়েছিল, তা ছিল- 'পড়ো তোমার প্রভুর নামে।' এ বাক্যটির মধ্য দিয়েই পড়াশোনা ও শিক্ষার গুরুত্ব সীমাহীনভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আলোকবর্তিকা হাতে মালালা সে পথেই হাঁটতে চেয়েছিল। আমরা তার দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। মালালারা পরাভব মানতে জানে না।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.