কল্পকথার গল্প-চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে সামলে চলি হ্যাপা by আলী হাবিব

হেমন্ত এসে গেছে। সকালে একটু একটু শিশিরের আমেজ। আকাশে চাঁদ। নদীর ধারে এখনো দুলছে কাশফুল। কোনো কোনো বাড়ির আঙিনায় ঝরা শিউলির জাফরানি সৌন্দর্য। অন্য রকম একটি সকাল শুরু হচ্ছে। রাতগুলো বদলে যাচ্ছে।


ফুলেল সকাল আর কোজনার চাদর জড়ানো রাত কি উসকে দিচ্ছে নস্টালজিয়া?
চাঁদ আর ফুল। এই দুটো বিষয়ের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র সেই আঁতুড়ঘর থেকেই। সদ্যোজাত শিশুটি চাঁদের মতো সুন্দর নাকি ফুলের মতো ফুটফুটে, সেই বিচার থেকেই চাঁদ ও ফুলের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্কটি তৈরি হয়েছে, এ জীবনে সেই সম্পর্ক আর ছিন্ন হলো না। চাঁদের কপালে টিপ দিতে দিতে চাঁদ মামা হয়ে গেল। চাঁদের বুড়ি চরকা কাটতে কাটতে আমাদের শৈশবকে আশ্চর্য এক ভালোলাগায় ভরিয়ে দিল। সেই বুড়ির খোঁজে নয়, মিথ কিংবা গল্পের সত্য নয়, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বতালাশে মানুষ পা রাখল চাঁদের মাটিতে। এভারেস্টের চূড়ায় ওঠা বাঙালিও নিশ্চয়ই একদিন চাঁদের মাটিতে পা রাখবে।
আমরা বড়ই চন্দ্রনির্ভর। যে চাঁদ শৈশবে আমাদের মামা, সেই চাঁদই আবার আমাদের প্রায় সব চাওয়া-পাওয়ার উৎস। কেমন করে? চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমাদের চোখে চড়া পড়ে গেল। কিন্তু তার পরও চাঁদ ছাড়া আমাদের চলছে না। ছোটবেলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সে চাঁদ আমাদের জীবনে ভিন্ন ভিন্ন অবদান রাখছে। বলা যেতে পারে, আমাদের জীবনে চাঁদের অবদানের অন্ত নেই। গল্পকথার চাঁদের প্রসঙ্গ না হয় বাদই দেওয়া গেল। বয়স একটু বাড়তে শুরু করল কী, চাঁদের পেয়ে গেল। কেমন করে? সে এক অন্য হিসাব। 'ও চাঁদ আগলে রাখো জোছনাকে ...।' কেন? প্রিয়া ঘরে আসবে। সেখানে চাঁদের আলো প্রিয়ার রূপের কাছে ম্লান হয়ে যেতে পারে। শুরুতে 'আয় আয় চাঁদ মামা' করতে করতে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অর্ধচন্দ্রও অনেকের প্রাপ্তিযোগ হয়। চন্দ্রগ্রহণ বলে একটা ব্যাপারের সঙ্গেও তো আমাদের চেনাজানা আছে। 'বলতে পারিস সূর্য-চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?' এসব প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে অনেক সময় জীবনের ষোল আনা না হোক, কয়েক আনা যে মিছে হয়, সে কথা মিছে নয়। কিন্তু একবার কারো জীবনে গ্রহণ লাগলে সে বড় যাতনার ব্যাপার হয়ে যায়। তখন 'ও চাঁদ', 'ও চাঁদ' বলে যতই আকুতি জানানো হোক না কেন, চাঁদের সাধ্যি কী ওই জীবনে আলো জ্বেলে দেয়।
আমাদের চন্দ্র-নির্ভর জীবনে চাঁদের গুরুত্ব কী কী হতে পারে, তার উদাহরণ টানতে গেলে বেশ লম্বা হয়ে যাবে। অন্তত দুটি উৎসব ফি-বছর আসে এই চাঁদের ওপর ভর করে। সেই উৎসব হচ্ছে ঈদ। উৎসব তো আনন্দের ব্যাপার। কিন্তু ঈদ কারো কারো জীবনে আসে বড় ধরনের এক হ্যাপা নিয়ে। এই হ্যাপা সামলানো অনেক সময় দায় হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ খুবই অদ্ভুত একটা দেশ। এই দেশে কিছু কিছু ঘটনা ঘটে চাঁদ দেখে। বিশ্বে এখন বাজার-অর্থনীতি বলে একটা ব্যাপার চালু হয়েছে। অনেক দেশই মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে ঝুঁকেছে। অর্থনীতিতে নানা ধরনের সূত্র আছে। কখন কোথায় কেমন করে কোন জিনিসের দাম বাড়বে, কোন জিনিসের দাম কমবে- এসব নিয়ে অর্থনীতির সূত্র আছে। বাংলাদেশে কোনো জিনিসের দাম ওঠানামা অর্থনীতির কোনো সূত্রের ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে চাঁদের ওপর। রমজানের চাঁদ উঠল তো, বাজারে জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়ল। আরেক দফা বলা হচ্ছে কেন? কারণ ঈদের আগে শবেবরাতের চাঁদে এক দফা দাম বেড়েই আছে। অনেককেই বলতে শোনা যায়, বাজারে আগুন লেগেছে। আগুন মানে দাম বেড়ে যাওয়া। ক্রেতাদের কিছু করার নেই। এ সময় ক্রেতারা যেন বিক্রেতাদের কাছে নিতান্তই দায় ঠেকা। কিনতে হলে বিক্রেতাদের হাঁকা দামেই কিনতে হবে।
ঈদের বাজার মানেই জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। আপনি যদি পরিবারের কর্তা হন, তাহলে ঈদের চাঁদ আপনার জন্য কতটা যে আনন্দ বয়ে আনে, তা আপনি ভালো করেই জানেন। কাঁচির মতো চাঁদটি দৃশ্যমান হওয়ার সময় যতই এগিয়ে আসে, ততই যেন আপনি ভীতসন্ত্রস্ত হতে থাকেন। কেন? একটা লম্বা লিস্ট আপনার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। না, লিস্ট একটা নয়, একাধিক। সেই লিস্টে স্ত্রীর শাড়ি, সন্তানের পোশাক থেকে শুরু করে কাকে কী দিতে হবে- সব কিছুই লেখা আছে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও হয়তো আপনার নামটি পেলেন না। তাতেও হয়তো আপনার আপত্তি নেই। কিন্তু অফিস থেকে পাওয়া বোনাসের টাকায় যে ওসব কিনে বাড়িতে আনার ব্যাপারে আপনি একেবারেই অপারগ, সে কথাটি কোনোভাবেই বাড়ির কাউকে বলে বোঝাতে পারবেন না। আচ্ছা, না হয় ধরেই নেওয়া গেল যে আপনার হাতে লিস্ট ধরিয়ে দেওয়া হয় না। আপনি নিজের মতো করে কেনাকাটা করেন। তার পরও কি রক্ষে আছে? স্ত্রী তাঁর শাড়ি দেখে মুখ ভার করলেন। জামাটা একবার হাতে ধরে ছেলে ঠেলে দিল। মেয়ে হয়তো সে রাতে ভাতই খেল না। এভাবেই হয়তো রোজার ঈদটা পার করেছেন আপনি। কিন্তু এবার এসেছে কোরবানির ঈদ। কোরবানি দিতে হবে। গরুর খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছেন এ হাট থেকে ও হাটে। মনের মতো গরু খুঁজে পাচ্ছেন না। সাতজনে মিলে একটা দল তৈরি হয়ে গেছে। দলের অন্য সদস্যরাও তো আপনারই মতো। টাকা-পয়সা এক জায়গায় করে হাটে হাটে ঘুরছেন, গরু পছন্দ করবেন কী, গরুই হয়তো আপনাকে পছন্দ করছে না। রাজধানীর হাটে হাটে গত বছর মানুষকে নাকাল হতে হয়েছে। এবার অনেক বাড়ির সামনে অনেক আগে থেকেই গরু বাঁধা দেখা যাচ্ছে। গরু কিনলেই যে ঝামেলা মিটে গেল তা নয়। গরু কেনা হলে সেটা বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসা আরেক ঝামেলার ব্যাপার। কেনার পর যেকোনো ক্রেতার প্রথম কাজটা হচ্ছে গরুর দামটা মুখস্থ করে ফেলা। কিংবা গরুর দাম বলার জন্য একজন লোক ঠিক করে রাখা। পশুর হাট থেকে বাড়ি পর্যন্ত সারাটা পথ গরুর দাম বলতে বলতে আসতে হবে। গরু কেনার পর সেটা জবাই করার জন্য লোক লাগবে। গরুর মাংস তৈরির জন্য লোক লাগবে। এরপর সে মাংস রান্না হবে। তারপর খাওয়া। কিন্তু রান্নার আয়োজন করতে যাওয়া, সে আরেক হ্যাপা সামলানো। খবরের কাগজে খবর বেরিয়েছে, ঈদ সামনে রেখে মসলার বাজার চড়েছে। বেড়েছে পেঁয়াজের ঝাঁজ। সব মিলিয়ে যাচ্ছেতাই একটা অবস্থা।
আমাদের আরেকটি ব্যাপার আছে। ঈদে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয় অনেকেরই। আহা, অনেক কষ্টের সেই যাওয়ার মধ্যেও কী আনন্দ! কিন্তু যাবেন যে কোথায় মিলবে টিকিট। ট্রেনেরও ছাদ পর্যন্ত ভরে যায়। বাসের লাপাত্তা। কিন্তু তার পরও বাড়িতে যাওয়া চাই। কারণ ঈদ মানে আনন্দ। সেই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে হবে। অনেক হ্যাপা সামলে তাই বাড়ি ফিরতেই হয়। বাড়িতে যাওয়ার পথে, নদীর ধারে বাতাসে দোল খায় কাশফুল। এবার ঈদ হচ্ছে কার্তিকে। আর তো কয়েক দিন পরই পূর্ণিমা। ভরা জ্যোৎস্নায় নদীর ধারে কাশফুল। পাগল করে দেওয়া রাত। পথের হ্যাপা ভুলিয়ে দেওয়ার মতো রাত। সেই রাতে প্রিয়জনের সান্নিধ্যে মাত্র কয়েকটা দিন। 'ঠিক যে পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা'। এবং 'জানি ঠিকই পেয়ে যাব বাকি দু-আনা'। পেতেই হবে। তবেই না পূর্ণ হবে জীবন।

লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.