আমায় ক্ষমো হে-বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ by মামুন রশীদ

ভদ্রলোক একজন সিনিয়র ব্যাংকার। 'কৃতী ব্যাংকার'-এর স্বীকৃতি বা পুরস্কারও পেয়েছেন। ব্যাংক খাতে যখন এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছিল এমন একসময় দক্ষতার সঙ্গে দেশে প্রথম প্রজন্মের একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করায় অবদান রাখার জন্য তাঁকে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়।


এটি দেয় ব্যাংক খাতের তত্ত্বাবধান ও উন্নয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত জুরি প্যানেলে ছিলেন সম্মানিত ব্যাংকার ও খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা। প্যানেলের চেয়ারম্যান ওই ব্যাংকারের পেশাগত কৃতিত্ব ও অবদানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে গিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত মূল্যবোধ ও সামাজিক প্রতিশ্রুতির কথাও গুরুত্বসহকারে তুলে ধরেন। কিন্তু তিনি পুরস্কারটি পাওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা তাঁর বেশ কয়েকজন সহকর্মীকে 'ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির' ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে গ্রেপ্তার হতে দেখলাম!
স্থানীয় একটি শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ও একটি লজিস্টিক কম্পানি যৌথভাবে দেশের একটি বৃহৎ ব্যাংককে সম্মানজনক এক পুরস্কার দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই একটি খবর শুনে আমি রীতিমতো চমকে গেলাম। ব্যাংকটির একজন পরিচালক আমাকে জানালেন, তাঁদের একটি শাখায় 'ব্যক্তিগত ঋণ জালিয়াতির' ঘটনা ধরা পড়েছে। যা ব্যাংককে অন্তত ১০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে বাধ্য করেছে।
কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের একটি চেক জালিয়াতির ঘটনা গণমাধ্যমে ফলাও করে ছাপা হয়েছিল, যা 'নুরুন্নবী কেলেঙ্কারি' নামে পরিচিত। প্রতারণার ওই ঘটনায়ও কয়েকটি ব্যাংককে ৩০০ কোটি টাকার মতো আর্থিক ক্ষতি গুনতে হয়েছে। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকও 'ইন্টারনাল বিল পারচেজ' বা আইবিপিসংক্রান্ত প্রতারণার কারণে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে, যা নিয়ে এখন সব মহলে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য আশার কথা হলো, এই প্রতারণার মূল হোতা হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ এবং তাঁর সহযোগী ও গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) তুষার আহমেদকে গত ৭ অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন গ্রুপের চেয়ারম্যান তথা তানভীর মাহমুদের স্ত্রীও।
ব্যাংক খাতে সংঘটিত এসব প্রতারণা ও জালিয়াতির ঘটনায় কী প্রতীয়মান হয়? ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (সিইও) জ্যেষ্ঠ নির্বাহীরা বাইরের দিকে অত্যধিক নজর দেওয়ায় বা ব্যাপকহারে জনসংযোগে ব্যস্ত থাকায় নিজেদের মৌলিক দায়িত্ব পালনে জোর দিতে পারছেন না। যে কারণে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, পেশাগত সততা ও কার্যক্রমে সাধুতা নিশ্চিত হচ্ছে না। পরিণতিতে বাজার, শেয়ারহোল্ডার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বারবার জাল-জালিয়াতির বিস্ময়কর ঘটনা শুনতে হচ্ছে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস বা প্রকাশ হয়ে পড়লে ব্যাংকগুলো আইনগত বা কঠোর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে প্রথমেই তা নিয়ে লুকোচুরি শুরু করে কিংবা ধামাচাপা দিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। এর ওপর তো ব্যাংক খাতে প্রক্রিয়াগতভাবে সঠিক নির্দেশনায় ঘাটতি ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা রয়েছেই। এতে বিবেকবিবর্জিত, লোভী ও অসাধু ব্যাংকার আর গ্রাহক নামধারী প্রতারক ও জালিয়াতরা প্রায়ই পার পেয়ে যায়।
ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালে সহকর্মীদের নিয়ে ব্যাংক খাতে 'কোর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইনস' বা 'মৌলিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় নির্দেশনা' প্রবর্তন করে গেলেও এখনো বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কিভাবে লেনদেনের ক্ষেত্রে সেটি এড়িয়ে চলে? বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সুচতুর শাখা ব্যবস্থাপকরা কিংবা প্রধান কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ নির্বাহীরা কিভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শকদের ধোঁকা দিয়ে প্রতারণা ও জালিয়াতির ঘটনাগুলো আড়াল করে রাখেন এবং প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলে দেন, তা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনার অবকাশ আছে।
আপনি যদি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর 'টপ বস' বা 'শীর্ষ নির্বাহীদের' কাছে যান, তাহলে তাঁরা সবাই তাঁদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় 'নিরীক্ষা যাচাই' (অডিট ট্রায়াল), 'লেনদেন তদারকি' (ট্র্যানজেকশন মনিটরিং), 'মেকার-চেকার' প্রক্রিয়ার উপস্থিতি, 'নির্দেশনা অনুযায়ী লেনদেন বা বড় অঙ্কের দেনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা' ও পরে তা নজরে রাখা এবং কথোপকথন রেকর্ড করার কথা বলবেন। অথচ দুঃখজনক সত্য হলো, তাঁরা বড় অঙ্কের লেনদেন সংঘটনে নিয়মকানুন মেনে চলতে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। কিংবা এ ধরনের লেনদেন প্রক্রিয়ায় জড়িত কর্মকর্তাদের পেশাগত সততা নিশ্চিত করতে তাঁদের ব্যাংকে 'ট্র্যানজেকশন প্রসেস গাইড' অনুসরণ করা হচ্ছে না। আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোতে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, অডিট ট্রায়াল বা নিরীক্ষা যাচাই ও লেনদেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মতো উপযুক্ত লোকবলের ঘাটতি আছে। ব্যাংকগুলো অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ পরিবেশ জোরদার করার চেয়ে অনেক সময় এ ক্ষেত্রে অযোগ্য ও অদক্ষ লোকদেরই দায়িত্ব দিয়ে থাকে। সে জন্য দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) ও অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করে কিংবা চালু থাকলেও এর প্রাত্যহিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তবে আইটি বিষয়ে অদক্ষ, অনভিজ্ঞ ও অনাগ্রহী জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ওপর অহেতুক দায়িত্ব ন্যস্ত করার চেয়ে দক্ষ, যোগ্য ও উৎসাহী নবীন কর্মকর্তাদের ওপর ভরসা করলে তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো ফল পাওয়া যাবে। দেশের বেশির ভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংকই ইন্টারনাল অডিট বা অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও ইন্টারনাল কন্ট্রোল বা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ জোরদারকরণে যথাযথ গুরুত্ব দেয় না, যা খুবই দুঃখজনক।
শুধু স্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেই জাল-জালিয়াতি ঘটছে না, বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারাও বড় ধরনের অসাধুতা বা প্রতারণার প্রমাণ রেখেছেন। এসব ব্যাংকে একদিকে ক্লায়েন্ট বা গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট বা হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলিত হয়েছে, অন্যদিকে অন্য ব্যাংকে স্টাফদের হিসাবে অর্থ জমা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট বা হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলনের মিথ্যে তথ্য দেখানো হয়েছে কিংবা গ্রাহকের নির্দেশনা না মেনে বা দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই লেনদেন সংঘটিত হয়েছে। এসব ব্যাংকে কনিষ্ঠ ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা পরস্পরের যোগসাজশে বাণিজ্যিক প্রতারণা, চেক জালিয়াতি ও নথিপত্র জাল করার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছেন। এ ছাড়া শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরাসহ অধস্তন কর্মকর্তাদের অজ্ঞতা ও জ্ঞানের ঘাটতির কারণেও ব্যাংকিং কার্যক্রমে বিচ্যুতি ঘটে থাকে।
এগুলো শুধু ব্যাংকের ক্ষতি বা লোকসানের ঘটনাই নয়, বরং সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ারও কারণ বটে। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি বা নিয়ন্ত্রণে বিচ্যুতির কারণে এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হয়। এ কারণে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের শেয়ারের দামেও মারাত্মকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বে তো 'অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি' ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে বড় অঙ্কের অর্থদণ্ড বা জরিমানা দিতে বাধ্য করা হয়। অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা থাকলে তা গ্রাহকদের মনে অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। কারণ বিশ্বাসের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে যেকোনো বিশেষত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনা রোধ করতে হলে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের ওপর সর্বাত্মক জোর দিতে হবে। আর সেই কাজটি করার উপযুক্ত সময়টাই হলো এখন। সেই সঙ্গে নিবিড় প্রশিক্ষণ দিয়ে ম্যানেজার বা ব্যবস্থাপক ও সুপারভাইজারদেরও প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। ট্র্যানজেকশন প্রসেসরস বা লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পন্নকারী ও ট্র্যানজেকশন অ্যাপ্রুভারস বা লেনদেন অনুমোদনকারীদের মধ্যে একটি 'চাইনিজ ওয়াল' বা প্রতিবন্ধকতার উঁচু দেয়াল থাকা উচিত। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদেরই (সিইও) পাবলিক রিলেশন বা জনসংযোগ করা বা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলার চেয়ে প্রধান কর্তব্য হিসেবে পরিচালন ঝুঁকিসহ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেরও একটি সঠিক 'রিস্ক ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন' বা 'ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নির্দেশনা' নিশ্চিত করা উচিত। যেটির আওতায় 'ঋণ ঝুঁকি', 'বাজার ঝুঁকি' ও 'পরিচালন ঝুঁকি' ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো নিশ্চিত হবে। অডিট বা নিরীক্ষা কমিটিকে একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন বা নির্দেশনার আলোকে নিয়মিতভাবে বড় অঙ্কের লেনদেন এবং পরিপালনীয় শর্তগুলো মেনে চলা হচ্ছে কি না তা পর্যালোচনা করতে হবে। তা ছাড়া কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে তা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে জাল-জালিয়াত ও প্রতারণার বিস্ময়কর ঘটনা ও অপ্রত্যাশিত ক্ষতি বা লোকসান রোধে সহায়ক হবে। কথাগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, শেয়ারহোল্ডার ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী নির্বিশেষে সবাইকে অনুধাবন করতে হবে। যাতে দেশের ব্যাংক খাত অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য ও মর্যাদাশীল হয়ে ওঠে এবং এর ভাবমূর্তি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ছড়িয়ে পড়ে।

লেখক : ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ও
অর্থনীতি বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.