কেলেঙ্কারির ব্যাংক-দায়ভার কে নেবে?

দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক কেলেঙ্কারির খবর এখন গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম। এসব ব্যাংকের নানা দুর্নীতির খবর একের পর এক বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। সুবিধাভোগী গোষ্ঠীগুলোর অর্থ আত্মসাতের খবরও


পাওয়া যাচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও স্থানীয় কার্যালয়ে বসেই কর্মকর্তারা যেভাবে ব্যাংকটির আর্থিক ক্ষতি এবং দুর্নীতি-জালিয়াতির মাধ্যমে নিজেদের পকেট ভরেছেন- মহা হিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা (অডিট) প্রতিবেদনে সে তথ্যই উঠে এসেছে।
হলমার্ক নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ কেলেঙ্কারি ও সেই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের জিজ্ঞাসাবাদে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা অর্থ জালিয়াতির নানা কৌশলের চাঞ্চল্যকর তথ্যও দিয়েছেন। এসব জালিয়াতির নেপথ্যে অনেক রাঘব-বোয়ালের জড়িত থাকার বিষয় বেরিয়ে আসছে। এই একটি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতির ঘটনা দেশের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত জেনেই মানুষ ব্যাংকে টাকা আমানত রাখে। ব্যাংক সেই টাকা নানা খাতে বিনিয়োগ করে। বড় বড় ব্যবসায়ী বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের ওপরই নির্ভরশীল। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তারা ব্যবসা করে। ব্যাংক আমানতকারীদের টাকাই ঋণ দেয়। সেই টাকার নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব ব্যাংকের। কিন্তু ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ভুলে গিয়ে অসাধুতার আশ্রয় নিয়ে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন।
রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর রাজনৈতিক পরিচালনা পর্ষদ আর্থিক জালিয়াতির সুযোগ করে দিচ্ছে কি না- এমন প্রশ্ন এখন আর অবান্তর নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। স্বাভাবিকভাবেই পরিচালনা পর্ষদ রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। পরিচালনা পর্ষদের এ দুর্বলতার সুযোগ ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিতেই পারেন। সোনালী ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ীরাও যুক্ত হয়েছে হলমার্কের ক্ষেত্রে। শুধু সোনালী ব্যাংক নয়, আরো কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে আর্থিক জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। জালিয়াতি বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন?
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগ আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ধরা পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে, ওই ব্যাংকগুলোর নিজস্ব ও নিয়মিত নিরীক্ষায় নয়। এবার অর্থ লোপাটের যে অভিযোগ, তা এনেছে সরকারের মহা হিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়। এবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কখনো এককভাবে, কখনো গ্রাহকের সঙ্গে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ধারণা করা যেতে পারে, এসব জালিয়াতির সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ অনেক কর্মকর্তাই জড়িত। এই কর্মকর্তাদের খুশি রেখে বা বখরা দিয়ে ব্যাংকটিতে নিয়মিত আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে সিবিএ আগের মতো সক্রিয় না হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনপুষ্ট বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন একেবারেই নিষ্ক্রিয় নয়। এসব সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় প্রভাব বিস্তার করে জালিয়াতি করা সম্ভব।
যেকোনো ব্যাংকের প্রধান মূলধন হচ্ছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা। নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো একের পর এক বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকিং সেক্টরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ও গিয়ে পড়ছে সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর। কাজেই এ ব্যাংকগুলোতে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টরের এ বিশৃঙ্খলার দায়ভার কাউকে না কাউকে নিতেই হবে। যাঁরা এই বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে, তাঁদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। দুদকের তদন্ত ও আইনি কার্যক্রম যেন সে খাতে পরিচালিত হয়, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.