মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুদের সম্মাননা-অনন্য অবদানের অটুট স্মারক

মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব বিদেশি বন্ধু নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন জুগিয়েছেন, তারা আমাদের জাতীয় গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের কাছে জাতি হিসেবে আমাদের ঋণ শোধ হওয়ার নয়। বিলম্বে হলেও তাদের সম্মাননা জানানো দেশের জন্যই গৌরবের বিষয়।


মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সহায়তাকারী ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সম্মাননা জানানোর মধ্য দিয়ে গত বছর জুলাই মাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বাছাই করা ৫৬০ ব্যক্তি ও সংস্থাকে সম্মাননা জানানোর প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটে। এরপর চলতি বছরের ২৭ মার্চ সম্মাননা দেওয়া হয় ৭৫ ব্যক্তি, ছয়টি সংস্থা, মিত্র বাহিনী ও ভারতের জনগণকে। গত শনিবার (২০ অক্টোবর) তৃতীয় দফায় বিদেশি ৬১ যুদ্ধবন্ধুকে সম্মাননা দেওয়া হলো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। বস্তুত, মুক্তিযুদ্ধে যারা অবদান রেখেছেন, সেসব বিদেশি বন্ধুর মধ্য থেকে নির্দিষ্টসংখ্যককে বাছাই করা কঠিন কাজ। তবে বিশ্বাসযোগ্য পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে সরকার এই দুরূহ কাজটি প্রায় বিতর্কহীনভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছে। তা ছাড়া বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত করানো, যারা মৃত্যুবরণ করেছেন এবং যারা অনুষ্ঠানে আসতে সক্ষম হননি, তাদের কাছে বা তাদের নিকটজনের কাছে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে সম্মাননা স্মারক হস্তান্তরের কাজটি এখন পর্যন্ত সুচারুরূপে সম্পন্ন হচ্ছে। এ জন্য আমরা সরকারকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
অস্বীকার করা যাবে না, যেসব বিদেশি বন্ধু একাত্তরের সেই কঠিন দুর্যোগের দিনগুলোতে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, এই সম্মাননা তাদের অবদানের তুল্য হতে পারে না। তবে এর মাধ্যমে জাতি হিসেবে আমরা যে কৃতজ্ঞ, সে সত্য জানিয়ে আমাদের কর্তব্য সম্পাদনের গর্ব অনুভব করতে পারি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা একাত্তরে এ দেশে যে বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়েছিল, এসব বিদেশি বন্ধুর নানামুখী প্রচেষ্টার কারণেই এর বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে ওঠে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে আমাদেরকে তারা যেমন সহায়তা দিয়েছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী অনেক দেশের মানুষ সেদিন তাদের সরকারের অবস্থানের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আমাদের ন্যায্য লড়াইয়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রক্রিয়াও চ্যালেঞ্জহীন নয়। বিদেশি বন্ধুরা নানাভাবে আজ সেই বিচারকেও সহজ করতে পারেন।
কেন আমরা এত বছর বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানাতে পারিনি, সে এক লম্বা ইতিহাস। গত দুই দশক দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থাকায় এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী প্রধান দলটি ক্ষমতাসীন হওয়ার সুবাদে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুদের সম্মানিত করার উদ্যোগ নিতে সমর্থ হয়েছি। বিদেশি বন্ধুরাও বাংলাদেশের এই বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী-সহমর্মী যেসব বিদেশি বন্ধু নানা কারণে আসতে পারেননি_ তাদের প্রতিনিধি এবং বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা ও নানা ব্যস্ততা সত্ত্বেও যারা অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন, তাদের সবাইকে জানাই আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন। আমরা বিশ্বাস করি, এই সম্মাননার মধ্য দিয়ে সেসব বন্ধু ও তাদের দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধন আরও উষ্ণ ও দৃঢ় হবে।
 

No comments

Powered by Blogger.