দুর্দিনের শিকার দেশের বেসরকারি খাত by ইফতেখার আহমেদ টিপু

জাতীয় অগ্রগতি ও বিনিয়োগ একটি অপরটির পরিপূরক। সস্তা শ্রমশক্তির কারণে বাংলাদেশ বিনিয়োগকারীদের স্বর্গ হিসেবে বিবেচিত হবে- এমন সম্ভাবনার কথা উচ্চারিত হচ্ছে বহুদিন ধরে। কিন্তু বিনিয়োগে উৎসাহী করার পূর্বশর্ত পূরণে সরকার তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি।


মূলত আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের প্রতিই সরকারের আনুকূল্য অনুভূত হয়েছে। আমদানি বিকল্প উৎপাদনমুখী শিল্পের প্রতি নতুন কোনো প্রণোদনা বা নীতি সহায়তাদানে সরকার কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। তার বদলে ঋণের উচ্চ সুদহার, শুল্ক বৈষম্য এবং সরকারের অবিবেচনাপ্রসূত রাজস্ব-নীতি আমদানি বিকল্প শিল্পগুলোকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধার চেষ্টা করেছে। বিনিয়োগ ক্ষেত্রে হতাশার চিত্র অব্যাহত থাকায় ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে উত্থানের যে স্বপ্নকল্প ঘোষণা করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন হিসেবেই থেকে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ স্বপ্নকল্প বাস্তবায়নে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত হলেও সরকার সঠিক পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়নি। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ২০১৩ সালে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে ১০ শতাংশে উন্নীত করে ২০২১ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখতে হলে অবকাঠামো খাতে অতিরিক্ত ২৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন। সরকারের একার পক্ষে এ অর্থ জোগাড় করা যেহেতু সম্ভব নয়, সেহেতু বেসরকারি খাতের অংশীদারির মাধ্যমে তা পূরণ করার কথা থাকলেও এ ব্যাপারে সফলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বিনিয়োগ বাধা দূর না হওয়ায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য যেমন ধূসর হয়ে উঠছে, তেমনি বিঘ্ন হচ্ছে জাতীয় অগ্রগতি। এ অবস্থার উত্তরণে বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে। দূর করতে হবে বিনিয়োগ ক্ষেত্রের অনভিপ্রেত বাধা।
দেশের বেসরকারি খাত এখন দুর্দিনের শিকার। ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদ আর তারল্য সংকট বেসরকারি খাতের অগ্রগতি ব্যাহত করছে। ব্যাংকগুলোর কাবুলিওয়ালা-মার্কা ভূমিকার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে এ খাত। ২২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করায় ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। নতুন বিনিয়োগ দূরের কথা রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতায় দেশের শিল্প খাতের টিকে থাকাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনই রুগ্ণ হয়ে পড়ছে একের পর এক শিল্প প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থা চলতে থাকলে সরকারের রাজস্ব আদায়ের ওপরও কুপ্রভাব পড়তে বাধ্য। অর্থনীতির জন্যও তা অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে। বাড়বে বেকারত্বের হার। অর্থনীতি হলো রাজনীতির প্রাণ। অর্থনীতিতে সুবাতাস বইলে রাজনীতিতেও তার শুভ প্রতিক্রিয়া পড়ে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসে ঘরে ঘরে কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। বাজার অর্থনীতির এই যুগে বেসরকারি খাতের মাধ্যমেই এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। নিজেদের নির্বাচনী ওয়াদা পূরণে সরকারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে- এ কথা বলা হবে অনুদারতার শামিল। কারণ দেশবাসীর কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখতেই যেকোনো সরকার চায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সমপ্রসারিত হোক। কিন্তু নানা ভুল পদক্ষেপ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। বিশেষত সরকার ব্যাংক থেকে বেপরোয়াভাবে ঋণ নিয়ে যে তারল্য সংকট সৃষ্টি করেছে তার শিকার হচ্ছেন ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা। তাঁরা ব্যবসা বা শিল্প পরিচালনায় কাঙ্ক্ষিত ব্যাংকিং সহযোগিতা পাচ্ছেন না। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ বাড়ছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো নজিরবিহীন ২২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আরোপ করছে। এ ছাড়া তারল্য সংকটের কারণে উচ্চ সুদ দিয়েও সময়মতো ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। ফলে নতুন বিনিয়োগ তো হচ্ছেই না; বরং শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ এবং অবকাঠামো সংকট, বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা, কাঁচামাল ও শ্রমমূল্য যেভাবে বেড়েছে, তাতে উচ্চ সুদে ব্যাংক ঋণ নিয়ে শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে বলে তাঁদের আশঙ্কা। আবাসন খাতের ২৬৯টি শিল্প এ আবাসন খাতের ওপর নির্ভরশীল। এগুলোর মধ্যে নির্মাণসামগ্রীই প্রধান। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকায় আবাসন খাতেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা নির্মাণকাজ কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। নানামুখী সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। আবার মোটা অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ থাকায় ব্যবসা গুটিয়েও নিতে পারছেন না। পাশাপাশি উচ্চ সুদ এবং তারল্য সংকটে পোশাক শিল্পও হুমকির মুখে।
বেসরকারি খাতকে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে রক্ষা করতে সরকারকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। তারল্য সংকটের অবসান এবং ব্যাংক ঋণের সুদের হার যুক্তিগ্রাহ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগ নিতে হবে। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই এ বিষয়ে সরকার যত্নবান হবে- এমনটিই কাম্য।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নবরাজ,
চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ
chairman@ifadgroup.

No comments

Powered by Blogger.