নতুন মধ্যপ্রাচ্য এবং তুরস্কের অবস্থান by কল্লোল কর্মকার

রব মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইপ এরদোগান তুরস্কের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগাচ্ছেন। আরব বসন্তকালীন অবস্থায় আরব দেশগুলোর কাছে এরদোগান হয়ে উঠেছেন এক বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরের নাম। এমনকি সমস্যা জর্জরিত পাশ্বর্বর্তী আফ্রিকার দেশগুলোতেও লেগেছে এর জোয়ার। তুরস্কের সেক্যুলার গণতান্ত্রিক মডেলকে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে ব্যবহারের চেষ্টাও চলছে কোথাও কোথাও।

ক্রমবর্ধনশীল অর্থনীতি, সেক্যুলার ডেমোক্র্যাসি, শক্তিশালী সরকার কাঠামো, সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী, আঞ্চলিক রাজনীতিতে এর প্রভাব সবকিছু মিলিয়ে আঙ্কারা একটি মডেল রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে আধুনিক সেক্যুলার এবং বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশ গড়তে চাওয়া দেশগুলোর কাছে।

অনেকের মতে, তুরস্ক তার পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই তারা তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন ‍আনে। আর এর চুড়ান্ত পরিবর্তন করে তুরস্কের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি)। একেপি তুরস্কের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার।

তুরস্কের এই পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তনের প্রায়োগিক সুবিধাভোগি হয় মূলত মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো, উত্তর আফ্রিকার ওপর। রাজনৈতিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিমা কৌশলকে বাতিল করে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় তারা। এর ফলে গত দশকে নাটকীয়ভাবে আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্কের উন্নয়ন হয়। এরমধ্যে ছিল অনেকগুলো কূটনৈতিক সফর, পারস্পরিক বাণিজ্য চুক্তি এবং চলমান গঠনমূলক আলোচনা। তবে এসময় তুরস্ক কৌশলগত দিক দিয়েই ইসরায়েলকে বাদ দিয়ে তার কূটনৈতিক সম্পর্ক চালিয়ে যায় অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে। বিশেষত আরব দেশগুলোর সঙ্গে।

মধ্যপ্রাচ্য গবেষকদের মতে, তুরস্ক আরব বিশ্বের দেশগুলোর কাছে একটি সফল উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক মডেল প্রস্তাব করে। এর ফলে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় রক্ষণশীল উপাদান এবং সেক্যুলারিস্টরা সহাবস্থান করেই রাষ্ট্র চালাতে পারবে। আহমেদ দাভুতোগলু ২০০৯ এ তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর ধীরে হলেও পাশ্বর্বর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও ভালো হয়।

এর প্রেক্ষিতে ‍আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মধ্যকার উত্তেজনা হ্রাস পায়। এছাড়াও ইরাক এবং তুরস্কের অভ্যন্তরীন উত্তেজনাও বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে নিরসন করে তুরস্ক। ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে পরম মিত্র হিসেবে জায়গা করে নেয় তুরস্ক।

কিন্তু এতোকিছুর পরও ইউরোপিয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করলে বৈরি আচরনের শিকার হয় তুরস্ক। মানবাধিকার, মৃত্যুদন্ড হ্রাস, সংখ্যালঘুদের ভাষা সংরক্ষণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তুরস্কের ভালো অবস্থান থাকলেও তারা সদস্যপদ পাচ্ছিল না। ইউ’র সদস্য হতে না পেরে তুরস্ক মধ্যম সাড়ির ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে।

তবে ইউরোভুক্ত না হয়েও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি এবং তাদের বাজারে পণ্যের অবাধ প্রবেশ ঘটিয়ে তুরস্ক রাজনৈতিকভাবে একটা নিরেট অবস্থান নেয়। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় একছত্র বাণিজ্যিক আধিপত্য বিস্তার করে ইউরো জোনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে তুরস্ক। একই সঙ্গে আঞ্চলিক নেতা হিসেবে নিজের অবস্থান সংহত করে তারা।

আধুনিক ইতিহাসে তুরস্কই প্রথম দেশ যারা সোমালিয়া, লিবিয়া এবং আফ্রিকার অন্যান্য দেশে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের আগে এবং তাদের চেয়েও বেশি প্রথম মানবতার খাতিরে ত্রান পাঠায়। এমনকি তারা বিভিন্ন প্রাযুক্তিক সহায়তাও দিয়েছে আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশকে।

সম্প্রতি তুরস্ক আরব প্রতিবেশিদের সঙ্গে মিত্রতা আরও বৃদ্ধি করছে। অর্থনৈতিক প্রনোদনাসহ কূটনৈতিক সাহায্য সহযোগিতাও বাড়িয়েছে তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। যেমন হয়েছে তুরস্ক এবং মিসরের ক্ষেত্রে।

তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভূমিকা পালন করার জন্য কৌশলগত কারণে ইসরায়েলকে এড়ানোর জন্য তুরস্ক ফিলিস্তিন ইস্যুতে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে।

No comments

Powered by Blogger.