বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড ও আমাদের অগ্রগতি-অধোগতি by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

একবিংশ শতাব্দীতে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাংলাদেশ যৌক্তিকভাবেই ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সংকল্পবদ্ধ। বর্তমান সরকার জাতিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য, সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিগত দশকগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিজ্ঞানের ছাত্রসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। শুধু তাই-ই নয়, ছাত্রজীবন শেষে শ্রেয়তর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকারী কর্মজীবনের জন্য বিজ্ঞানের ছাত্ররা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিদ্যা ও গণিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে ভিন্ন বিষয়ে লেখাপড়া করে তাদের বিজ্ঞানের সুপ্ত প্রতিভাকে অকালে শেষ করে দিচ্ছে। এই মেধাকে যথাযথভাবে বিকশিত করে দেশ গড়ার কাজে ব্যবহার করার দায়িত্ব সরকারের। দেশের বাণিজ্যনীতি, বিনিয়োগনীতি দেশীয় শিল্প বিকাশের অনুকূল হওয়া উচিত। বিশ্বের এক-সহস্রাংশ ভূখণ্ডে পৃথিবীর ২৩ সহস্রাংশ মানুষের বাস—মালয়েশিয়ান পরোটা, বিস্কুট আর ভুটানের ফলের রস খেয়ে এত বড় দেশ উন্নতির পথে এগোতে পারে না, নিজেদের উৎপাদন করতে পারতে হবে, নিজেদের পণ্য ব্যবহার করে ধন্য বোধ করতে হবে।
দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার এমন নিরস অবস্থায় বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী বিজ্ঞান শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে, ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞানমনস্ক করতে দেশব্যাপী ২০১০ সাল থেকে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড আয়োজন করছে। এ বছর সারা দেশের ১২টি কেন্দ্রে এই বিভাগীয় অলিম্পিয়াড মার্চ মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয়। এই কেন্দ্রগুলো ছিল হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রযুক্তি ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রযুক্তি ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম কারিগরি ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইমপিরিয়াল কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল ও কলেজ, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল ও নটর ডেম কলেজের ১২টি কেন্দ্রের প্রায় ৩০০ বিজয়ী বিগত ২৫ মার্চ রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়। সকাল আটটায় দূরদূরান্ত থেকে লাল টি-শার্ট পরে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। জাতীয় অলিম্পিয়াডের উদ্বোধন ঘোষণা করেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমীর সম্মানিত সভাপতি বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী অধ্যাপক শমসের আলী এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শাহ এ আলম। এরপর ছাত্ররা নয়টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়, যেখানে তাদের দুই ঘণ্টা সময়ে প্রতি বিষয়ে ১৫টি করে জীববিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জিং প্রশ্নের উত্তর করতে হয়। এই অলিম্পিয়াড এসএসসি ও এইচএসসি এই দুই বিভাগে অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৮০টি স্কুল-কলেজ এই প্রতিযোগিতায় প্রতিনিধিত্ব করেছে। অলিম্পিয়াড পরীক্ষার পর ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে সমবেত হয়। উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্বে ছাত্ররা অনেক সৃজনশীল প্রশ্ন করে তাদের অনুসন্ধিৎসু মনের প্রকাশ ঘটায়। ছাত্রদের বিজ্ঞান নিয়ে নানা কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর দেন একাডেমীর সভাপতি অধ্যাপক শমসের আলী, একাডেমীর ফেলো অধ্যাপক কাজী আবদুল ফাত্তাহ, অধ্যাপক মেসবাহউদ্দিন আহমাদ, অধ্যাপক আলী আসগর, অধ্যাপক নাইয়ুম চৌধুরী।
দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্য নিশ্চয়ই আমাদের স্কুল-কলেজের ছাত্রদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াডে সূচিত রুবিক কিউর প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকেরা যে কষ্ট স্বীকার করে তাঁদের ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছেন, তা থেকে অত্যন্ত এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বিজ্ঞান শিক্ষায় গুরুত্ব অনুভব করে। এবার সরকারকে বিজ্ঞান শিক্ষায় অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা যদি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান পড়ে চাকরি না পায়, তাহলে তারা যে বিষয়ে পড়লে চাকরিপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে, তা-ই পড়াবে এবং আমাদের ছেলেমেয়েরা তা-ই করছে। এ কারণে বিজ্ঞান শিক্ষার হার হ্রাস পাচ্ছে।
আসছে অক্টোবরে সাংহাই শহরে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় কনফারেন্স শুরু হতে যাচ্ছে। এর আগের কনফারেন্সগুলোতে জ্ঞানতাপসেরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া উন্নয়নশীল দেশসমূহ একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে না। এ কারণে এই জনবহুল দেশটির অগ্রগতি নিশ্চিত করতে শুধু বিজ্ঞান শিক্ষা নয়, বিশ্বমানের বিজ্ঞান শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ঔপনিবেশিক বৈরী পরিবেশে জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা যে বৈজ্ঞানিক প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে তার ধারাবাহিকতা রাখতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি, বিশ্ব জ্ঞানভান্ডারে আমাদের সঞ্চয় সময়ের সঙ্গে হ্রাস পাচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি।
আমাদের নানা সরকার শিক্ষার সর্বোচ্চ বরাদ্দের ঢাক বাজালেও আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় শিক্ষায় আমাদের বরাদ্দ অপ্রতুল। এই দুর্বল অর্থনীতির দেশে বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নত মানের শিক্ষা নিশ্চিত করা মোটেই সহজ কাজ নয়। তবে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে শিক্ষা খাতে ডিজিটাল টেকনোলজির জুতসই ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার মান অবশ্যই বাড়ানো সম্ভব। অভিজ্ঞ ও উচ্চশিক্ষায় পৌঁছাতে শিক্ষকদের দিয়ে তৈরি পঠন বিষয় শিক্ষার জন্য নিয়োজিত টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে সময়সূচি অনুযায়ী পরিবেশন করা সারা দেশে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর জন্যই নয়, এমনকি শিক্ষকদেরও সহায়তা করা যেতে পারে। আবার এই পঠন বিষয়গুলো ডিভিডির মাধ্যমেও সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।
তবে শিক্ষায় উৎকর্ষ অর্জনের জন্য জনপ্রিয় ও সুস্থ প্রতিযোগিতার সূচনার বিকল্প নেই। এমনকি সর্বোচ্চ মাপের জ্ঞানতাপসেরাও নোবেল পুরস্কার জয়ের প্রতিযোগিতায় আন্তরিকভাবেই নিজেদের সঁপে দেন। সুতরাং সাধারণ মনুষ্য সন্তানদের প্রতিযোগিতার লোভনীয় পুরস্কার দেখিয়ে শিক্ষায় উৎকর্ষ অর্জন করাতে পারলে ক্ষতির কিছু নেই।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী কর্তৃক অতি সম্প্রতি সূচিত বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড এমনই একটি উদ্যোগ। বাংলাদেশের লব্ধপ্রতিষ্ঠ এবং অভিজ্ঞ বৈজ্ঞানিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণাকে উৎসাহিত করতে শুধু বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডই নয়, গবেষকদের নানা ক্ষেত্রে গবেষণায় উৎকর্ষ অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বর্ণপদক দিয়ে থাকে। এ ছাড়া তরুণ গবেষক ও নারী গবেষকদের জন্য কনফারেন্স, তরুণ ছাত্রদের উৎসাহিত ও উজ্জীবিত করতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের কনফারেন্সে অংশগ্রহণ, ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড এবং এসিএম প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছে। অতি সম্প্রতি কৃষি গবেষণাকে জোরদার করার জন্যও বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের সহায়তায় নানা প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যবস্থা করছে। তা ছাড়া জাতীয় নানা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানেও বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী যথেষ্ট তৎপর। সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী দেশের সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে অংশ নিয়ে থাকে।
আমাদের সমস্যাজর্জরিত দেশে সমস্যার অন্ত নেই। কেবল রাজধানীর যানজট সমস্যাই নাকি কম করে হলেও দৈনিক ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি নিশ্চিত করছে, সুপেয় পানির অভাব, পর্যাপ্ত বিদ্যুতের অভাব, পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবার অভাব, জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে নিজেদের গ্যাস, কয়লা উত্তোলনের অক্ষমতা—এসব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী শ্রেয়তর পরিবেশে সরকারের থিংক ট্যাংক হিসেবে কাজ করতে পারে, আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। রাশিয়া, হাঙ্গেরি কিংবা পোল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশের বিজ্ঞান একাডেমী দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কার্যকরভাবে এগিয়ে নিচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া যে দেশের উন্নয়ন কল্পনা করা যায় না, সেই দেশের বিজ্ঞান একাডেমী অধিকতর কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশের বিজ্ঞান শিক্ষাকে জোরদার করতে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী আরও জোরালো ভূমিকা পালন করুক, এটাই সবার প্রত্যাশা।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বুয়েট ও ফেলো, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী।

No comments

Powered by Blogger.