ক্রিকেটময় এক রেস্তোরাঁ

নামটাই যথেষ্ট রোমাঞ্চ-জাগানিয়া, ‘ক্রিকেট ক্লাব ক্যাফে।’ ক্রিকেট, ক্লাব, ক্যাফে—সব মিলিয়ে সময় কাটানোর জন্য নিশ্চয়ই ভালো একটা জায়গাই হবে!
মূল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বড়সড় একটা চমক। কম্পাসের মতো একটা নির্দেশিকা। বিশ্বের প্রধান ক্রিকেট স্টেডিয়ামগুলো ওই জায়গা থেকে যেদিকে, সেদিকে নির্দেশ করা। লেখা আছে দূরত্বও, প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম ৭ কিমি, কেপটাউনের নিউল্যান্ডস স্টেডিয়াম ৭৮৭৯ কিমি, ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভ ১০৯৭০ কিমি...আছে মেলবোর্ন, লর্ডস, হারারে স্পোর্টস ক্লাব...।
এ তো কেবল শুরু, রেস্টুরেন্টের ভেতরে চমকের পর চমক। ডন ব্র্যাডম্যান, রে লিন্ডওয়াল, স্ট্যান ম্যাককেব, গ্যারি সোবার্স, ইয়ান বোথাম, ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়—কে নেই ভেতরে! শ্রীলঙ্কার সাবেক-বর্তমান প্রায় সবাই আছেন। ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা সব তারকার দারুণ সব ছবি, মাঠে-মাঠের বাইরের স্মরণীয় সব মুহূর্তের ছবি দিয়ে সাজানো পুরো রেস্টুরেন্ট। শুধু কী ছবি, আছে তাঁদের ব্যবহূত জার্সি, পুলওভার, ব্যাট, গ্লাভস, স্টাম্প, বলসহ অনেক অনেক স্মারক। আছে টেস্ট খেলুড়ে প্রতিটি দেশের বিশাল পতাকা। রেস্টুরেন্ট তো নয়, যেন সমৃদ্ধ এক ক্রিকেট সংগ্রহশালা কিংবা জাদুঘর। ক্রিকেটের প্রতি সামান্য অনুরাগ আছে, এমন যে কেউ সম্মোহিত হয়ে যাবেন ভেতরে ঢুকলেই। ইচ্ছে হবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টুকরো টুকরো ইতিহাসগুলোর পাশে থাকতে, হাত দিয়ে ছুঁতে। থাকতে পারেন, ছুঁতেও পারেন। কেউ বাধা দেবে না। এই হলো ক্রিকেট ক্লাব ক্যাফে, সংক্ষেপে ‘সিসিসি’, কলম্বোর সবচেয়ে জনপ্রিয় থিম রেস্টুরেন্ট।
রেস্টুরেন্টের মালিক জেমস হোয়াইট ও গ্যাব্রিয়েল নামের অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি। নব্বই দশকের শুরুতে শ্রীলঙ্কায় এসেছিলেন সার্ফিং করতে, দেশটার এমন প্রেমে পড়ে যান যে পাকাপাকিভাবে থেকে যান এখানেই। শ্রীলঙ্কা ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জয়ের পর হঠাৎ করেই এমন একটি রেস্টুরেন্টের পরিকল্পনা মাথায় আসে তাঁদের। কাজও শুরু করে দেন। সাবেক ফাস্ট বোলার লিন্ডওয়ালের সঙ্গে পরিচয় ছিল, তাঁর পুলওভার দিয়েই শুরু হলো যাত্রা। আরও অনেক সাবেক ক্রিকেটারের কাছ থেকে স্মারক সংগ্রহ করা হলো, কিছু কেনা হলো নিলামেও। কলম্বোর কুইন্স রোডে দাঁড়িয়ে গেল ক্রিকেট ক্লাব ক্যাফে।
কিন্তু সবকিছুর আগে তো এটা রেস্টুরেন্ট! সবচেয়ে বড় চমক তাই খাবারের মেন্যুতেই। মেন্যুকার্ডের প্রচ্ছদ করা হয়েছে বর্তমান-সাবেক অনেক ক্রিকেটাদের অটোগ্রাফ দিয়ে। ক্রিকেট থিম রেস্টুরেন্ট, চাইলেই তাই আপনি ধরে ধরে খেতে পারবেন ক্রিকেটারদের! বিশ্বাস হচ্ছে না? অর্ডার দিয়েই দেখুন না ‘শচীনস সসেজ অ্যান্ড ম্যাশ’ কিংবা ‘পান্টারস পেপার চিকেন’, ইচ্ছেমতো খেতে পারবেন শচীন টেন্ডুলকার কিংবা রিকি পন্টিংকে। খাবারের নামটাই যে এমন! রেস্টুরেন্টের সব খাবার পানীয়র নাম ক্রিকেট আর ক্রিকেটারদের নামে! মুরালিস মাল্লাগাতানি, ইমরানস পাকিস্তানি পাম্পকিন, পন্সফোর্ডস প্রন, দ্য ডেভিড শেফার্ড, সোবার্স স্টার ফ্রাই, অফ স্পিনার পিনাচ, কভার প্রাইভ কর্ডন ব্লু, জয়াসুরিয়াস ট্রিপল সেঞ্চুরি, ‘হোয়াট এ ক্যাচ’ ক্র্যাব, গাঙ্গুলিস গ্রিল...আরও অসংখ্য। ব্যাট হাতে পেশিশক্তির প্রদর্শনীর প্রতীক ভিভ রিচার্ডসকে সবজি খাবারের তালিকায় রাখা হলো কেন কে জানে!
সবচেয়ে বেশি লোকের আনাগোনা রেস্টুরেন্টের পানশালায়। এই অংশটা পুরোপুরি উৎসর্গ করা হয়েছে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানকে, নাম ‘ব্র্যাডম্যান বার।’ স্যার ডনের ক্যারিয়ারের স্মরণীয় সব মুহূর্তের ছবি, স্মারক, তৈলচিত্র দিয়ে সাজানো পুরো পানশালা। আছে ১৯৪৮ সালের সেই ‘ইনভিন্সিবল’ দলের খেলার কিছু পেপার কাটিংও। রেস্টুরেন্টের সেরা সংগ্রহ নিঃসন্দেহে গ্যারি সোবার্সের ছয় ছক্কা মারার সেই ব্যাট।
শ্রীলঙ্কার সাবেক-বর্তমান ক্রিকেটাররা নিয়মিতই আসেন এখানে, সবচেয়ে বেশি আসেন অরবিন্দ ডি সিলভা। শ্রীলঙ্কায় আসা সব দলের ক্রিকেটাররাই কখনো না কখনো ঢুঁ মেরেছেন এখানে। রিকি পন্টিং এসে খেয়েছেন নিজেকেই, মানে পান্টার চিকেন পেপার! নিজের নামের খাবার খেয়েছেন আরও অনেকেই। সুপারভাইজার চান্না জানালেন, বাংলাদেশের দীর্ঘদেহী ওই ধারাভাষ্যকারও নাকি এখানে অনেকবার এসেছেন। আতহার আলী খান!
দিনে-রাতে ভিড় মোটামুটি লেগেই আছে। এটা যে শুধুই একটি রেস্টুরেন্ট নয়, ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে একরকম তীর্থস্থান!

No comments

Powered by Blogger.