সোহরাওয়ার্দীর বিশ্বকাপ-দর্শন

রংপুর ক্রিকেট গার্ডেনে নির্মাণ স্কুল ক্রিকেটের ম্যাচ খেলতে গেছে আল-হেরা স্কুল। খেলার আগে হঠাৎ জানা গেল একজন খেলোয়াড় আসেনি। মাঠে ছিল ওই স্কুলেরই ষষ্ঠ শ্রেণীর এক ছাত্র। বিকল্প খেলোয়াড় হিসেবে নামিয়ে দেওয়া হলো তাকেই। আকস্মিক দলে ঢুকে খুদে ক্রিকেটারটি কিন্তু খারাপ খেলল না—৫ ওভার বল করে ১০ রানে ৫ উইকেট!
মাঠে বসে খেলা দেখা অনেকের উৎসাহে ছেলেটির মা-বাবা তাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন বিকেএসপিতে। সেদিনের সেই খুদে ক্রিকেটারই আজকের মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী—সোহরাওয়ার্দী শুভ। চোখে যাঁর বিশ্বকাপ-স্বপ্ন পূরণের ঝিলিক।
বিশ্বকাপ নিয়ে স্বপ্নের আঁকিবুঁকি বাংলাদেশ দলের ১৫ ক্রিকেটারের চোখেই। তবে সোহরাওয়ার্দীর স্বপ্নটা একটু অন্য রকম। ২০০৯ সালে হজ পালন তাঁর জীবনদর্শন এতটাই বদলে দিয়েছে যে, বিশ্বকাপ-স্বপ্ন অন্যদের সঙ্গে মেলে না, ‘দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ হবে। আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া, তিনি যেন আমাদের মানসম্মান রাখেন। আমরা যেন ভালো খেলতে পারি। সারা দুনিয়ার মানুষ যেন জানে, এই মুসলিম দেশটা ভালো ক্রিকেট খেলে।’
যেদিন থেকে বল-ব্যাট নিয়ে নাড়াচাড়া, সেদিন থেকেই বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন। ২০০৭ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলকে ভালো খেলতে দেখে স্বপ্নপূরণের তাড়নাটা বেড়েছে। তবে হজ করে আসার পর স্বপ্ন কিংবা বাস্তবতা—সবকিছুই সমান তাঁর কাছে। স্বপ্নপূরণের দরজায় দাঁড়িয়ে বরং সোহরাওয়ার্দীর মনে হচ্ছে, বিশ্বকাপটাই সব না। জীবনের প্রতিটি অণু-পরমাণুর অর্থই দুই বছর আগের চেয়ে ভিন্ন, ‘আগে সব সময় একটা অভাববোধ থাকত। মনে হতো আরেকটু করলে, আরেকটু পেলে বোধ হয় ভালো হয়। কিন্তু এখন সবকিছু খুব শান্তিপূর্ণ, খুব পরিপূর্ণ মনে হয়। আগে মৃত্যু নিয়েও ভাবতাম না। হজের পর এ ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে পারি এখন।’ উপলব্ধির পরিবর্তন আছে ক্রিকেটীয় বিষয়েও, ‘আগে বলতাম, আল্লাহ আমাকে অনেক সম্মান দাও, টাকা-পয়সা দাও। হজের পর এসব বদলে গেছে। আল্লাহর কাছে এখন একটা জিনিসই চাই, তিনি আমাকে ভালো খেলতে সাহায্য করুন। অন্য তরুণ ক্রিকেটাররা যেন বুঝতে পারে নামাজ পড়েও ভালো খেলা যায়।’
নামাজের প্রতি আগ্রহ ছোটবেলা থেকে। কিন্তু হজ করে এসে ধর্মের সবকিছুকেই জীবনের অংশ করে নিয়েছেন, ‘হজে গিয়ে কিছু জিনিস দেখে আশ্চর্য হয়েছি। কী দেখেছি বলব না, এসব একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। আসলে হজ এমন একটা জিনিস, ওখানে গেলে মানুষের একটা না-একটা দিক খুব শক্তিশালী হয়।’ বদলে যাওয়া সোহরাওয়ার্দীর যেমন মনে হয়, আগের জীবনটা খুবই অনিশ্চিত ছিল। জাগতিক মোহে এতটাই ডুবে গিয়েছিলেন যে, এই জীবনটাকেই মনে হতো সবকিছু। নতুন উপলব্ধি, ‘পৃথিবীতে আসার সিরিয়াল আছে, যাওয়ার কোনো সিরিয়াল নেই...।’
সোহরাওয়ার্দী অদৃষ্টবাদী বিশ্বকাপ নিয়েও, ‘আল্লাহ চাইলে বিশ্বকাপ খেলব। তিনি না চাইলে আর সবাই চাইলেও খেলতে পারব না। হয়তো ইনজুরিতে পড়ে যাব, কিছু করার থাকবে না। সব ক্ষমতাই তাঁর হাতে।’ অনেকে বলেন, সাকিব-রাজ্জাক থাকতে সোহরাওয়ার্দীর মতো আরেকজন বাঁহাতি স্পিনার না হলেও তো চলত বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে! সোহরাওয়ার্দী প্রতিবাদ করেন, তবে পাল্টা আঘাত করে নয়, ‘আমার মনে হয়, আমার খেলার প্রয়োজন আছে বলেই খেলছি। প্রয়োজন না থাকলে আমাকে কেউ নিত না। নিশ্চয়ই দলে আমার প্রয়োজন আছে।’
ধর্মের মধ্যে থেকেই তিনি জেনেছেন, ধর্মের সঙ্গে বিরোধ নেই ক্রিকেটের। ইসলাম বরং পরিপূর্ণ ক্রিকেটার হয়ে উঠতেই সাহায্য করে। হয়তো এই বিশ্বাস থেকেই সোহরাওয়ার্দীর মতো ধর্মভীরু-শ্মশ্রুমণ্ডিত ক্রিকেটার আজকাল অনেকেই আছেন। পাকিস্তানের মোহাম্মদ ইউসুফ, দক্ষিণ আফ্রিকার হাশিম আমলা কিংবা ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের মঈন আলী। তাঁদেরও আগে আছেন সাঈদ আনোয়ার। পাকিস্তানের সাবেক এই ওপেনার বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে ঢাকায় এসে যাঁদের খোঁজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে সোহরাওয়ার্দীও ছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর মাধ্যমে আজ তাঁর সঙ্গে দেখা করার কথা সাকিব-তামিমসহ বাংলাদেশ দলের আরও কয়েকজন ক্রিকেটারের। কিন্তু দেখা হলে তাঁদের কী বলবেন সাঈদ আনোয়ার! বিশ্বকাপ সামনে বলে ক্রিকেটীয় পরামর্শই দেবেন, নাকি শোনাবেন ধর্মের কথা? হয়তো সোহরাওয়ার্দীকে যেটা বলেছেন, তাঁদেরও বলবেন সেটাই, ‘খেলার সঙ্গে ধর্মের বিরোধ নেই। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে খেলো।’
কথাটা অক্ষরে অক্ষরে মানেন। সোহরাওয়ার্দী বিশ্বকাপ-স্বপ্নের মধ্যে থেকেও তাই বিশ্বাস করেন, ‘আল্লাহ পাশে ছিলেন বলেই এত কিছু সম্ভব হয়েছে। নইলে আমি হয়তো আজ কোথাও থাকতাম না...।’

No comments

Powered by Blogger.