মুক্তিযুদ্ধ- বাংলাদেশের বন্ধুঃ জুলিয়ান ফ্রান্সিস by আবদুল খালেক ফারুক

৯৭১-র মুক্তিযুদ্ধে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত দুর্ভাগা বাঙালিদের শুধু খাদ্য আর চিকিৎসা সহায়তা নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জীবনী গানের আসর বসিয়ে চরম হতাশাগ্রস্ত মানুষকে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন পেছনের রক্তাক্ত পথের দুঃসহ স্মৃতি। কলেরায় মৃত বাঙালিদের নিজের হাতে দিয়েছেন কবর। দেশ স্বাধীনের অনেক বছর পরেও প্রিয় বাঙালিদের ছেড়ে যাননি বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধু।
দুর্যোগে-মঙ্গায় এখনো তিনি বাড়িয়ে দেন তাঁর বন্ধুসুলভ হাত। তিনি ব্রিটিশ নাগরিক জুলিয়ান ফ্রান্সিস। দাতা সংস্থা অঙ্ফামের হয়ে '৭১-এ যেমন যুক্ত হয়েছিলেন ত্রাণ কাজে; আজও বাংলাদেশের পুনর্বাসন ও দারিদ্র্য মোকাবিলায় এ দেশে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন নিরলস। বাংলাদেশের বন্ধু জুলিয়ান ফ্রান্সিস সম্প্রতি কালের কণ্ঠের প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর অনেক স্মৃতি আর অনুভূতির কথা। পাশাপাশি বলেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ এবং বাংলাদেশের
আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির চালচিত্র নিয়ে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথা।
জুলিয়ান ফ্রান্সিসের বয়স এখন ৬৫। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি টগবগে তরুণ। ১৯৬৫ সাল থেকে অঙ্ফামের হয়ে কাজ করছিলেন ভারতে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নেমে আসে ভয়াল কাল। লাখ লাখ মানুষ প্রিয় স্বদেশ ছেড়ে উদ্বাস্তু হন ভারতে। সে সময় সীমান্তবর্তী এলাকা ছাড়াও কলকাতায় ছিল ছোট-বড় অনেক শরণার্থী শিবির। মে মাসের দিকে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জুলিয়ান আসেন এসব শরণার্থী শিবিরে কাজ করতে। শুরু হয় খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কাজ। স্রোতের মতো আসা শরণার্থীদের চাপে দেখা দেয় ডায়রিয়া আর কলেরা। দেখা দেয় মহামারি। কিন্তু দমে যাননি জুলিয়ান ও তাঁর স্বেচ্ছাসেবী দল। এই দলে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা চিকিৎসক ও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা শামিল হন।
জুলিয়ান তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, 'বর্ষার সময় জলপাইগুঁড়ি জেলার ডাঙ্গি রিফিউজি ক্যাম্পে ব্যাপকহারে কলেরা দেখা দেয়। কিছুতেই তা রোধ করা যাচ্ছিল না। এক সময় বাড়তে থাকে মৃতের মিছিল। এক দিন একসঙ্গে ২০ জন মারা যায়। মৃতদেহগুলো পড়ে থাকলেও দাফন করার মতো কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। ভয়ে সবাই পালিয়ে গেছে। তখন নিজেই কবর খুঁড়ি। ভারতীয় সেনাসদস্যরা পরে এলে তাদের সহযোগিতায় আমি লাশগুলো দাফন করি।' শরণার্থী শিবিরে কাজ করার অনেক স্মৃতি তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এক সময় খাদ্য ও চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি তিনি শরণার্থী শিবিরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালু করেন। এ প্রসঙ্গে ফ্রান্সিস বলেন, 'যাঁরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শরণার্থী ক্যাম্পে আসছেন, তাঁদের চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে একটা জিনিস খেয়াল করি, পেছনে কোনো ভয়াবহ স্মৃতি ফেলে এসেছেন তাঁরা। এই ভয়াল স্মৃতি তাঁদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সারাক্ষণ। তাই শুধু খাদ্য ও চিকিৎসা দিয়ে এঁদের বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। এর জন্য চাই মানসিক প্রশান্তি আর উদ্দীপনা। এ জন্য শরণার্থী ক্যাম্পে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালু করার ব্যবস্থা করা হয়। কেনা হয় বেশ কিছু হারমোনিয়াম আর তবলা। মাস শেষে হেড অফিসে যে রিপোর্ট পাঠাই তাতে হারমোনিয়াম ও তবলা বাবদ ব্যয় দেখে আমাকে নানা প্রশ্ন করা হয়েছিল। আমি তাদের বোঝাতে তখন গলদঘর্ম হয়েছিলাম। আসলে আমাদের মেডিক্যাল টিম তখন খাদ্যের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালু করে দেওয়ার সুপারিশ করেছিল।' তিনি আরো বলেন, 'শরণার্থী শিবিরে অনেক মানুষ ছিল। কিন্তু তাদের কাছে কোনো তথ্য ছিল না। টেলিফোন, ই-মেইল, পত্র_কোনো কিছুই ছিল না। তখন মানুষের মুখের কথা ছাড়া আর কোনো মাধ্যম ছিল না। এ সময় বুদ্ধিজীবী আর শিল্পীরা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।'
যুদ্ধ এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে ভাবেননি জুলিয়ান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'অক্টোবর-নভেম্বরে মনে হয়েছিল যুদ্ধ আরো কয়েক মাস চলবে। এ জন্য ছয় মাসের আগাম পরিকল্পনাও করেছিলাম আমরা। কিন্তু যৌথ কমান্ড গঠিত হওয়ায় যুদ্ধ শেষ হয় তার আগেই।' যে বাংলাদেশের মানুষের জন্য জুলিয়ান ফ্রান্সিসের এত দরদ, এই বাংলার পবিত্র মাটিতে তিনি পা রাখেন ১৯৭২ সালে। এসেই দেখা করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ অঙ্ফাম সে সময় গোয়ালন্দ ঘাটে পারাপারের জন্য 'করবী', 'কামিনী' ও 'কস্তুরি' নামে তিনটি ফেরি উপহার দেয়।
জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, 'বাংলাদেশের অনেক প্রাপ্তির মধ্যে অনেক অপ্রাপ্তিও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মানবতাবিরোধী অপরাধী, দালাল ও রাজাকার ছিল, তারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে, এটা খুশির বিষয় নয়। যুদ্ধ শেষে কোলাবরেটর হিসেবে অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছে। বঙ্গবন্ধু অনেককে ক্ষমাও করেছেন, তবে যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে, তাদের ক্ষমা করেননি তিনি। অথচ তাঁকে হত্যা করার পর সবাইকে মুক্ত করে দেওয়া হয়।'
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে জানতে পেরে খুশি জুলিয়ান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'অনেকে মনে করেছিলেন, যুদ্ধের অনেক বছর পর এটা হয়ত ক্লোজ চ্যাপ্টার হয়ে গেছে। এত দিন পর কিভাবে বিচার সম্ভব? কিন্তু তাঁরা হয়তো জানেন না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওয়ার ক্রিমিনালদের এখনো খোঁজা হচ্ছে। কিছু দিন আগে এক জার্মান সেনা অফিসারকে ৯০ বছর বয়সে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ৩৯ বছরে বিচার করতে পারেনি, কারণ সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশের চাপ ছিল। এই চাপ তারা দিতে পারে না। বিশেষ করে পাকিস্তান চায় না এই বিচার হোক।' তিনি মনে করেন, আবেগের দিক থেকে এই বিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যাঁরা প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তাঁরা দেখছেন, খুনিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে; এটা খুব কষ্টকর ব্যাপার। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, একই ধরনের বিষয় না হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাঁর মায়ের দাদা নিখোঁজ হয়েছিলেন। তাঁর খোঁজ মেলেনি। বহু বছর ধরে তাঁর পরিবারের সদস্যরা এ কষ্ট নিয়ে বেঁচে ছিলেন। অনেক বছর পর ফ্রান্সে তাঁর কবর আবিষ্কৃত হয় এবং তাঁর পরিবারে আসে মানসিক প্রশান্তি।
জুলিয়ান ফ্রান্সিস ১৯৮৫-১৯৯২ সাল পর্যন্ত প্রথম দফায় এবং ১৯৯৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় দুর্যোগ প্রস্তুতি, ত্রাণ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশে। এ সময়ে তাঁর চোখে পড়েছে বাংলাদেশের বেশ কিছু অগ্রগতি। এর মধ্যে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার, তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নতি চোখে পড়ার মতো। তবে এখনো জনজীবনে শৃংখলা, বিদ্যুৎ, পানি, ট্রাফিক ব্যবস্থা, এগুলোতে আরো অনেক উন্নতি করতে হবে।
জুলিয়ান ফ্রান্সিস এখন বেশির ভাগ সময় সিএলপির (চর জীবিকায়ন কর্মসূচি) বগুড়া অফিসে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাননি। সে কারণে তাঁর কোনো দুঃখ নেই। তিনি জানান, সরকার সম্মাননা না দিলেও ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাব ও অঙ্ফাম তাঁকে সম্মাননা দিয়েছে। এসব সম্মাননার ক্রেস্ট দেখিয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি অফিসের কাজে যেখানেই যান, এসব ক্রেস্ট সঙ্গে নিয়ে যান। এই বাঙালিঅন্তপ্রাণ ভালোবাসেন রবীন্দ্রনাথের গান-নাটক এবং বাঙালির প্রিয় খাবার ইলিশ।
=======================
নিষ্ফল উদ্ধার অভিযানঃ দখলচক্রে ২৭ খাল  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  ভ টিজিং : জরুরি ভিত্তিতে যা করণীয়  প্রতিশ্রুতির দিন  শোকের মাস, বিজয়ের মাস  চীনা প্রধানমন্ত্রীর পাক-ভারত সফর  দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীন মন্তব্য  নতুন প্রজন্ম ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা  খিলক্ষেতে আগুনঃ কয়েলের গুদামে রাতে কাজ হতো ঝুঁকিপূর্ণভাবে  ভারতে বিহার রাজ্যের নির্বাচন  স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে  আমাদের আকাশ থেকে নক্ষত্র কেড়ে নিয়েছিল যারা...  মুক্তির মন্দির সোপান তলে  আবেগ ছেড়ে বুদ্ধির পথই ধরতে হবে  বছর শেষে অর্থনৈতিক সমীক্ষা পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ  দুই কোরিয়ার একত্রিকরণ কি সম্ভব  গ্যাসের ওপর বিপজ্জনক বসবাস  উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ  সময়ের দাবি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি  জনসংখ্যা বনাম জনশক্তি  ব্যাংকের টাকা নয়ছয় হওয়া উচিত নয়  একটি পুরনো সম্পর্কের স্মৃতিচিত্র  পাটশিল্প ঘুরিয়ে দিতে পারে অর্থনীতির চাকা  ড. ইউনূসকে বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে  সুশিক্ষার পথে এখনও বাধা অনেক  ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ ও মর্যাদাহানির পরিণাম কখনই শুভ হয় না ঘুষ ও লুটপাট উভয়ের বিরুদ্ধে একই সাথে লড়তে হবে  সুনীতি ও সুশাসন  আমি কেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পক্ষে  শ্রমিক অসন্তোষ বর্তমান প্রেক্ষিত  জীবন ব্যাকরণঃ দর্জির মুক্তিযুদ্ধ  তথ্যের অধিকার ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  শালীন ও সংযত কথাবার্তা কি শুধু একতরফা হতে হবে?  একটি অসমাপ্ত গল্প  মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের বর্তমান ও ভবিষ্যত  চীন দেশের কথা  হিকমতে হুজ্জতেদের কথা  মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বিশ্বসভায়  ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো  বধ্যভূমিতে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান  ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আবদুল খালেক ফারুক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.