ভ্রমণ- 'আমার দেখা নরওয়ে' by অধ্যাপিকা চেমন আরা

আমার মেয়ে-জামাই মধ্য সুইডেনের সটিনাস নামক স্থানে বসবাস করে। সটিনাস সুইডেনের এয়ার বেস এলাকা। জামাই আবহাওয়াবিদ এখানকার। নতুন নাতি হয়েছে আমার। তাকে দেখার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে উঠেছি। তাই ছুটে গেলাম সটিনাসে নাতিকে দেখতে। কয়দিন আনন্দ-উল্লাসের মধ্যে কেটে গেল আমার। কিন্তু জনমানবহীন নির্জনতা আস্তে আস্তে আমাকে বিষণœ করে তোলে। আমি হাঁপিয়ে উঠলাম। জামাই-মেয়ে টের পেল আমার বিষণœতার কারণ। তারাও উদ্বিগ্ন হয়ে আছে আমাকে নিয়ে। মাঝে মাঝে আমার মেয়ে বের হয় প্যারামবুলেটারে বেবিকে নিয়ে আমাকে সঙ্গ দিতে এয়ারবেসের ভেতরে হেঁটে বেড়াতে। একদিন গথেনবর্গ থেকে ওর এক সুইডিশ বান্ধবী এলো স্বামীসহ ওর বাচ্চাকে দেখতে। সঙ্গে অনেক উপহার। তারা দুইদিন থাকলো- বাড়ির লনে তাঁবু গেড়ে। আমি তাজ্জব বনে গেলাম। এটা নাকি নিয়ম। ওরা কারো ঘরের শৃঙ্খলা নষ্ট করে না। খাওয়া-দাওয়া অবশ্য ঘরেই খায়।
ওদের কাছে রুবা আমার মনের অস্থিরতার কথা বলে হাসতে হাসতে বললোÑ তুমি একবার আমার মাকে পার্শ্ববর্তী নরওয়ে দেশটা দেখিয়ে আন। নরওয়ে তো তোমার মায়ের দেশ। বলা মাত্র ওর বন্ধু রাজি হয়ে গেল। খাওয়ার সময় বলে গেল দুই-একদিনের মধ্যে সে ও তার মা নরওয়ে যাবে। আমি যেন তৈরি থাকি।
২১ জুলাই ১৯৮৭ সাল। খুব ভোরে হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। উলফ এসে ফোন ধরলো। ফোন করেছেন পিয়ার মা। পথেনবর্গ থাকতে পিয়ার মা আমাকে কথা দিয়েছিলেন- সময় ও সুযোগ মতো আমাকে নরওয়ে বেড়িয়ে আনবেন। তিনি তার সেই প্রতিশ্রুতি ভুলেননি। এখন তার সেই সময় ও সুযোগ এসেছে। তিন দিনের জন্য তার ব্যবসাসংক্রান্ত কাজকর্ম তদারকির দায়িত্ব নিয়েছেন তার বাবা। পিয়া ও পিয়ার মা আমাকে নরওরয়ে নিয়ে যাবেন। আগামীকাল সকালে ওরা আমাকে নিতে আসবেন। খবরটা পেয়ে আমার খুব সুবিধা হলো। নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারলাম। রুবাও খুশি। পরদিন ঠিক সময় ওরা গাড়ি নিয়ে হাজির।
ভিনদেশী অত্যাধুনিক দুই সুইডিশ মহিলার সঙ্গে আমি বেড়াতে যচ্ছি। তাও আবার যেখানে সেখানে নয়, বাংলাদেশের মানুষের কল্পনার দেশ, স্বপ্নের দেশ পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের শেষ প্রান্তের চির তুষারের দেশ নরওয়েতে। কিছুটা ভয়ও হচ্ছে আমার। ভয় হবারই কথা, কী জানি কোথায় যাচ্ছি। এমনিতেই অজানা জিনিসের শঙ্কায় আমি নার্ভাস হয়ে পড়ি। এবার নার্ভাসের মাত্রাটা একটু বেশি এই যা।
পিয়াকে রুবা বারবার সাবধান করে দিয়ে বলে- আমার মা বাংলাদেশের মেয়ে। তোমাদের সাথে একাকী বেড়াতে যাচ্ছেন। তার সুবিধা-অসুবিধার দিকে খেয়াল রেখ।
পিয়া হাসিমুখে রুবার কাছ থেকে সব দায়িত্ব বুঝে নেয়। রুবা দু’দিনের আন্দাজ খাবার-দাবার ছোট একটা থার্মোফাক্স জাতীয় বাক্সে ভরে দেয়। অল্প-স্বল্প কাপড়-চোপড় ছোট একটা ব্যাগে করে দিয়ে দেয় ওখানে ব্যবহারের জন্য। মা যেমন ছেলে-মেয়েকে পরম যতনে প্রবাসে পাঠান, তেমনি আমার মেয়ে আজ আমাকে নরওয়েতে বেড়াতে পাঠাচ্ছে।
আজ ২২ জুলাই সকাল ১০টা। চারদিকে রোদ হাসছে। পিয়া গাড়ি চালাচ্ছে। পিয়ার মা তার পাশে বসে আছেন। আমি পেছনের সিটে একা। সটিনাস থেকে পাঁচ মাইল দূরে গ্রাস নামে ছোট একটা শহরে এসে একটা পেট্রল পাম্পের কাছে গাড়ি থামালো। গাড়ি থেকে নামলো পেট্রল নেয়ার জন্য। পেট্রল পাম্পে কোন কর্মচারী চোখে পড়লো না। প্রয়োজনীয় তেল কেনার জন্য পয়সা ফেলার ব্যবস্থা আছে। পয়সা অনুযায়ী তেল ভরে নিতে হয়। কেউ চুরি করে তেল বেশি নেয় না। পয়সা ফাঁকি দেয়ার বদ মতলব এদের জানা নেই। সটিনাস থেকে নরওয়ের দূরত্ব প্রায় পাঁচ শ’ কিলোমিটার। ট্রেনে এই দূরত্ব পার হতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টা। আর গাড়িতে লাগে ৮ ঘণ্টা। পেট্রল ভরা শেষ। এবার গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল হাতে নিলেন পিয়ার মা। গাড়ি চলছে অপার্থিব এক জগতের দিকে। রাস্তার দু’ধারে গহিন ঘন ওক, পাইন, বিচ গাছের দিগন্ত জোড়া বর্ণ আমাকে বারবার বিমুগ্ধ করে ফেলছে। পিয়ার মা মাঝে মাঝে সুইডেনের ম্যাপ দেখে নিচ্ছেন। আমাকেও বুঝাতে চেষ্টা করছেন- আমরা কোন দিক দিয়ে নরওয়ে যাচ্ছি। আমি যে খুব বুঝতে পারছি তা নয়, তবুও কিছুটা আন্দাজ করতে হচ্ছে। মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান ঘরের মেয়ে আমি। অত্যন্ত সাদামাটা জীবন আমাদের। সুইডেন, নরওয়ে এসব দেশে আমার আসার বিষয়টি স্বপ্নে ছিলো এই সেদিনও। আল্লাহর অপার মহিমায় আমি এই দেশে এসেছি, আবার নরওয়েতেও যাচ্ছি। এটা অবিশ্বাস্য ঠেকছে আমার নিজের কাছেই। কিন্তু স্বপ্ন এখন বাস্তব হয়ে আমার জীবনে ধরা দিয়েছে। এই সত্যকে অস্বীকার করি কেমন করে? পরম করুণাময়ের কাছে লাখ শোকরিয়া এমন সুন্দর দেশটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে বলে।
ঘণ্টা দু’য়েক বিরতিহীন গাড়ি চালিয়ে পিয়ার মা ঝড়ঃধপধহধষ নামে একটি জায়গায় এসে গাড়ি থামিয়ে বললেন- এখানে একটু নামেন। সুইডেনের খুব সুন্দর জায়গা এটা। টুরিস্টরা সব সময় এখানে ভিড় করে থাকে। পিয়ার মায়ের কথায় আমি যেন সম্বিৎ ফিরে পেলাম। এতক্ষণ আমি আরেক জগতে বিচরণ করছিলাম। গাড়ি থেকে নেমে এসে আমরা একটা পুলের ওপর দাঁড়ালাম। এই পুলের একটু নিচ দিয়ে দেখলাম ট্রেন লাইন চলে গেছে। আরও নিচ দিয়ে খাল প্রবাহিত হচ্ছে। খালের মূল মুখে পানির স্বাভাবিক স্রোতের গতি রুদ্ধ করে অন্য দিক দিয়ে প্রবাহিত করানো হয়েছে। যেদিকে খালের পানি যাবার কথা, সেখানে সৃষ্টি করা হয়েছে মনোহর জনপদ। মানুষের চিন্তা, কর্ম, সততা ও পরিশ্রমের সঠিক প্রয়োগে দেশকে যে কী অসামান্য উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে পারেÑ এসব দেশে না এলে তা বোঝানো সম্ভব নয়। আমরা হালকা কিছু খাবার খেয়ে আবার গাড়িতে গিয়ে বসলাম।
গাড়ি চলছে নরওয়ে সীমানা লক্ষ্য করে। রাস্তার দু’ধারে কখনো বা চোখে পড়ছে শিলাময় নাতিউচ্চ পাহাড়শ্রেণী, কখনো বা নীল পানির লেক, মাঝে মাঝে ছবির মতো সাজানো জনপদ। সর্বোপরি বড় বড় গাছের সুবিশাল অরণ্য। সব দেখতে দেখতে এক সময় নরওয়ে সীমানায় এসে পৌঁছলাম। চালকের সিট থেকে পিয়া সরে বসলো। এবার পিয়ার মা গাড়ির হুইল ধরে বসলেন। চেক পোস্ট বরাবার এসে পিয়ার মা গাড়ির গতি একটু কমিয়ে দিলেন। কিন্তু না কেউ গাড়ি থামানোর নির্দেশ দিলো না। যদিও দু’জন পুলিশ নির্বিকারভাবে চেকপোস্টে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
গাড়ি এখন নরওয়ে সীমানায় ঢুকে পড়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে এখনো নরওয়েকে আমি সুইডেন থেকে আলাদা চোখে দেখতে পাচ্ছি না। কারণ আমি যাচ্ছি সুইডেনের এক গ্রামীণ এলাকা থেকে। শহর থেকে দূরে এসব গ্রাম ও এলাকার প্রকৃতি সর্বত্র আমার কাছে একরকম মনে হয়। গাড়ি নরওয়ের দিকে একটু এগিয়ে যেতে ভূগোলে পড়া তুন্দ্রা অঞ্চলের দেখা মিললো। নরওয়েকে সুইডেন থেকে আলাদা করার সুযোগ পেলাম। এখন আমার চোখ দূরে ছোট ছোট গাছের দিকে। রাস্তার দু’ধারে দেখা যাচ্ছে একই রকমের দৃশ্য। স্কুলে ভূগোলে ম্যাপ আঁকতে গিয়ে আমরা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের শেষ মাথায় তুন্দ্রা অঞ্চলকে সবুজ রঙে ছোট ছোট গাছ এঁকে দেখাতাম, দেখাতাম পানির নিশানা। এই সেই তুন্দ্রা অঞ্চল, যাকে আল্লাহ আমাকে চোখে দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার চোখ পানিতে ভরে আসে।
আমরা রওনা দিয়েছিলাম সেই সকাল ১০টায়। এখন বেলা তিনটা। আমরা প্রায় এসে পড়েছি নরওয়ের রাজধানী অসলোর কাছাকাছি। অসলোতে ঢুকতে ঢুকতে চারটা বেজে গেল। অসলোর সেন্ট্রাল রেল স্টেশনের সামনে গাড়ি থামালেন পিয়ার মা। এখানে টুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার রয়েছে। হোটেল, রেল, বাস এবং সকল দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। প্রথমে আমাদের একটি মাঝারি রেটের হোটেল প্রয়োজন, পরে অন্য কিছুর ব্যবস্থা। স্টেশনের কাছাকাছি একটা হোটেলে সিট পাওয়া গেল। কিন্তু গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা পাওয়া গেল না। ঠিক হলো স্টেশনে গাড়ি পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে আমরা হেঁটে হোটেলে আসা-যাওয়া করবো। মুশকিল হলো হোটেলে ঢুকে। আমরা সিট পেয়েছি আট তলায়। অথচ ওঠার এলিভেটর অচল। সঙ্গিনী পিয়ার মা কিছুতেই এই হোটেলে থাকতে রাজি হলেন না। প্রায় ঘণ্টাখানেক চেষ্টা তদবির করে আর একটা হোটেল পাওয়া গেলো। শহর থেকে বেশ দূরে। তবে দামে একটু সস্তা। হোটেলের নাম হলতি শিলেন সামার হোটেল (ঐড়ষঃবশরষবহ ংঁসসবৎ যড়ঃবষ). এই হোটেলটির একটি বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে সতের বছরের ঊর্ধ্ব বয়সী ছেলেদের বিভিন্ন বিষয়ে ৩৩ সপ্তাহের একটি প্রশিক্ষণ কোর্স চালু আছে। এই কোর্স প্রায় সারা বছর চালু থাকে। কেবল ১ জুন থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য হোটেল করে দেয়া হয়। নরওয়েতে এ ধরনের আশিটি হোটেল আছে। সব ক’টি ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিচালিত হয়।
আমরা দোতলায় ৩০৫ নং কক্ষে জায়গা পেলাম। তিন বেডের একটি রুম। আমাদের দেশের হোস্টেলের ঢঙে করা। দু’দিকে অনেক রুম, মাঝখানে বারান্দা।
হোটেলে ঢুকতে ঢুকতে প্রায় রাত আটটা বেজে গেল। আমরা তিন জনই শ্রান্ত-কান্ত। পৃথিবীর আরেক প্রান্তের দুই বিদেশিনীর সঙ্গে আমি একা এক বাংলাদেশী প্রৌঢ়া মহিলা। কেমন যেন সঙ্কোচ বোধ করছি। ওরা কিন্তু খুব সহজভাবে আমার সাথে আলাপ-সালাপ চালিয়ে যাচ্ছে। রুমে ঢুকেই পিয়ার মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- কোন সিট আপনার পছন্দ। আমি জানালার পাশের সিট দেখিয়ে দিলাম। ভদ্র মহিলা সঙ্গে সঙ্গে অষষ ৎরমযঃ বলে আমার মাল-সামানগুলো আমার বেডের সঙ্গে লাগোয়া কাবাডে ঢুকিয়ে রাখলেন। পিয়া মাঝখানের বেডে জুতাসহ ধুম করে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর উঠে মা-মেয়ে বের হয়ে গেলেন বাথরুমের দিকে।
কিছুক্ষণ পর তারা রুমে ফিরলেন। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে রহস্যময়ী অসলো নগরীর রাতের রূপ দেখছি। গোটা নগরীটাকে মনে হচ্ছে পাহাড়ের ওপর। পাহাড়গুলো সব বড় বড় পাথুরের চাঁইয়ে ঠাসা। এরপর তিনজনে সঙ্গে আনা খাবার খেলাম। পিয়ার মাও অনেক খাবার সঙ্গে এনেছেন। আমার বিছানার পাশে টেবিলে টিফিন ক্যারিয়ার  থেকে তিনি নামালেন- স্ট্রবেরি, আপেল, কেক, কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল। সবাই খেয়ে শুয়ে পড়লাম যে যার বিছানায়। পরদিন সকালে রুবার দেয়া নাস্তা করলাম রুমে বসে। পিয়া ও তার মা চলে গেলেন নিচের ক্যাফেটেরিয়াতে নাস্তা করতে। ওরা ফিরে এলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম অসলো নগরী দেখার জন্য।
অসলো নগরী আগাগোড়া পাহাড়ে ঠাসা। মাঝে মাঝে পাহাড় কেটে রাস্তা চলে গেছে এদিক-ওদিক। সুন্দর ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কোনটার কমতি নেই। রাস্তাঘাটে মেরামতকাজ চলছে। মানুষজনের চলাচল খুব কম। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে হিমালয়ের মতো পর্বতশ্রেণী। পিয়ার মা প্রথমে নিয়ে গেলেন অসলোর গেট হারবারে। অসংখ্য বোট গেট হারবারে পড়ে রয়েছে। তার পরে নিয়ে গেলেন ১৩০০ শতাব্দীতে তৈরি একটি দুর্গ দেখাতে। এই দুর্গ সতের শ’ শতাব্দীতে পুনর্নির্মাণ করা হয়। ইদানীং এই দুর্গ সরকারি প্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে। ওখান থেকে আমরা অসলো টাউন হলে গেলাম।
বিখ্যাত এই টাউন হলের সামনে রয়েছে অসলো হ্রদ। একদিকে হারবার অন্যদিকে ব্যস্ত নগরী। লাল ইটের দু’টি স্তম্ভ নগরীর শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক।
অসলো টাউন হলের স্থাপত্য শিল্পের অসাধারণ কারুকার্য মেয়র হিরোনিমাস হায়ার ডেল (ঐরবৎড় ঘরসড়ঁং ঐবুবৎ উধযষ)-এর অবিনশ্বর কীর্তি। ১৯১৭ সালে নগরের সিটি ফাদার টাউন হলের জন্য একটা নকশা অনুমোদন করেন। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ১৯২০ সালে শিল্পী আর্নস্টেইন (অৎহংঃবরহ অৎহবনবৎম) আর্নবার্গ ও গধমযঁং চড়ঁষংংড়হ টাউন হলের ভেতরের নকশা আঁকার অনুমতি লাভ করেন। নানা কারণে টাউন হলের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়। শেষ পর্যন্ত অসলোর প্রতিভাধর শিল্পীদের রাত দিন পরিশ্রমের ফলশ্রুতিস্বরূপ সম্পূর্ণ নরওয়েজিয়ান শৈল্পিক মাধ্যমে টাউন হলের গায়ে ১৯৪৫ সালের শেষ নাগাদ সম্পূর্ণ কাজ করা হয়। এখন এই টাউন হল সমস্তÍ নরওয়েনবাসীর জন্য একটা গর্বের বস্তু এবং নরওয়েজিয়ান সংস্কৃতিকে দেখার একটা জায়গা। এই হলে একটা মিউজিয়াম রয়েছে। বিদেশী রাজ অতিথিদের দেয়া সামগ্রী এখানে থরে থরে সাজানো। বাংলাদেশ ছাড়া প্রায় সব দেশেরই কিছু না কিছু দেশীয় উপহার সামগ্রী এখানে দেখতে পেলাম। শ্বেত পাথরের একটা ছোট তাজমহলও দেখলাম।
টাউন হলে গেলাম নরওয়েজিয়ানদের তৈরি প্রাচীনতম নৌকা দেখতে। এই নৌকা প্যাপিরাস পাতার তৈরি। নৌকাটি পাঁচ হাজার মাইল সাগর পাড়ি দিয়েছিলো বলে গাইড বুকে লেখা রয়েছে। অসলো নদীর বাঁকে একটি মিউজিয়াম বানিয়ে এই নৌকাটিকে জনসাধারণকে দেখানোর জন্য রাখা হয়েছে। প্রতিদিন চার-পাঁচশত দর্শক স্পিড বোটে চেপে এই ঐতিহাসিক নৌকাখানা দেখতে যান। মিউজিয়ামের নাম ঞযব কড়হ-ঞরশর গঁংবঁস. দ্বীপের মধ্যে এই মিউজিয়ামের অবস্থান। এখানে এলে বেড়ানো ও ঐতিহাসিক জিনিস দুটোরই স্বাদ পাওয়া যায়।
মিউজিয়াম দেখতে দেখতে প্রায় তিনটা বাজে। পিয়ার মা বললেন, মিসেস চেমন আরা, চলেন এবার ফেরা যাক। সন্ধ্যার পর আবার বেরুনো যাবে। তথাস্তু বলে আমিও সম্মতি জানালাম। সন্ধ্যার কিছু সময় আগে আমরা বের হলাম গাসটভ ভিজি ল্যান্ডের তৈরি ভাস্কর্যে সজ্জিত ভিজিল্যান্ড কালচার পার্ক দেখার জন্য। আশি একর জমির ওপর ভাস্কর্য শিল্পের চরম নিদর্শন নিয়ে এই পার্কটি অবস্থিত। এই ভাস্কর্যগুলোর মধ্য দিয়ে ভিজিল্যান্ড স্তরে স্তরে মানবজীবনের ক্রমপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিক চিত্র তুলে ধরেছে। পিতা-মাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক, বড়দের সাথে ছোটদের সম্পর্ক এবং বাস্তব পৃথিবীর সঙ্গে হৃদয়ের সংঘাতÑ এসবও তার ভাস্কর্যের মাঝে ঠাঁই নিয়েছে।
এই পার্কে পৌঁছে এই সব অবিশ্বাস্য পাথর-শিল্পের নৈপুণ্য দেখতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো। সন্ধ্যা হলেও রোদ এখনো চারিদিক ঝলমল করছে। পিয়ার মা বললেন- আর একটা জায়গা আপনাকে দেখানো যায়। আমি বললাম- চলেন। শুধু শুধু হোটেলে গিয়ে বসে থেকে তো লাভ নেই। এবার আমাকে নিয়ে গেলেন পৃথিবীর বিখ্যাত স্কি প্রতিযোগিতার জায়গায়। এই জায়গায় নাম- হলমেন কোলেন (ঐড়ষষসবহ কড়ষবহ), এখানে একটা মিউজিয়ামও রয়েছে। এই মিউজিয়ামে আড়াই হাজার বছরের পুরনো স্কি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য ক্রীড়ামোদীরা এখানে শীতকালে আসতেন। এখানকার গৌরবোজ্জ্বল কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে সঙ্গিনী পিয়ার মা আনন্দে গৌরবে উল্লসিত হয়ে ওঠেন। গাড়ি থেকে নেমে এই জায়গার খবর শুনতে শুনতে আমার স্কি প্রতিযোগিতা যেই পাহাড়ের ওপর থেকে শুরু হয় সেখানে এসে পড়লাম। এই পাহাড়টি আবার এখান থেকে আরও ১৬৫ ফিট ওপরে। মূল জায়গায় ওঠার জন্য কিছু সিঁড়ির ব্যবস্থা রয়েছে। পিয়ার মা বললেন, ওপরে উঠলে সমগ্র অসলো শহরের দৃশ্য দেখা যায়। আপনি কি উঠতে পারবেন? পিয়ার মার কথার মধ্যে আমার শক্তিমত্তার ওপর কেমন একটা সংশয় লক্ষ করলাম। ফলে আমার জেদ চেপে গেল। বললাম- অবশ্যই পারবো। পিয়া গিয়ে ওপরে ওঠার টিকিট কিনে নিয়ে এলো। আমরা লিফ্টের ঘরে গিয়ে লাইন করে দাঁড়ালাম। সত্তর বছরের বুড়োরাও দেখলাম ওপরে যাওয়ার জন্য লাইন ধরেছেন। সাহসে বুক বেঁধে আল্লাহর নাম নিয়ে সত্যি সত্যি আমি লিফ্ট পাড়ি দিয়ে আরো আড়াই শ’ সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেলাম স্কি প্রতিযোগিতার মূল জায়গায়। এখান থেকে প্রতিযোগীরা খেলা শুরু করে। নেমে যায় প্রায় আড়াই শ’ মিটার নিচে গভীর খাদে। নিচের দিকে তাকাতেই আমাদের মত মানুষ ভয় পায়। ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চারদিকে অসলো নগরীর শোভা দেখলাম। বিজ্ঞান প্রযুক্তি, বুদ্ধি, আধুনিকতা ও প্রকৃতিÑ হাত ধরাধরি করে এখানে অবস্থান করছে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নদী প্রতিযোগিতার স্থান দেখে সে দিনের মতো ফিরে এলাম হোটেলে একরাশ আনন্দ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে।
পরদিন সুইডেনে ফিরে আসার পালা। উত্তর গোলার্ধের শেষ দেশ নরওয়ে। আর নরওয়ের রাজধানী হচ্ছে অসলো। দ্বীপ, নদী, পাহাড়, সবুজ, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি মিশে সুন্দর মনোহর অসলো নগরী।
শহরের কোন কোন স্থান থেকে অসলো নগরীকে মনে হয় অনেক নিচে, কোন সময় মনে হয় যেন অনেক ওপরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। কৈশোরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে- ভূগোলে পড়া তুন্দ্রা অঞ্চলের ম্যাপ। সেই ম্যাপ আমার সামনে মেলে ধরেছে অসংখ্য রূপরেখা। মেহেরবান আল্লাহকে হাজার শোকরিয়া।
২৪ জুলাই সকাল ১০টার দিকে আমি রওনা দিলাম সটিনাসের পথে, রুবার বাড়ির দিকে। পথে নরওয়ে ছাড়ার আগে পিয়ার মা আমাকে নিয়ে গেলেন ভাইকিং জাহাজ দেখতে। হাজার বছর আগে নিমজ্জিত তিনটি কাঠের জাহাজকে ধরে রাখা হয়েছে ঠিক তার নিজস্ব অবয়বে।
এই তিন জাহাজকে রাখা হয়েছে ভাইকিং শিপ মিউজিয়ামে দর্শকদের দেখার জন্য। ভেতরে তাদের ব্যবহারের দ্রব্যসামগ্রীও দেখলাম। ওদের খাবার জিনিসের মধ্যে একটা মিষ্টি কুমড়া দেখলাম।
এবার অসলো থেকে আমাদের বিদায়ের পালা। অসলো শহরের মধ্যে যতক্ষণ গাড়ি ছিল ততক্ষণ ড্রাইভ করলেন পিয়ার মা। শহর ছাড়লে পিয়ার মা হুইল ছেড়ে দিলেন। পিয়া গিয়ে বসলো মার জায়গায়। দু’ধারে সীমাহীন দিগন্ত জুড়ে তুন্দ্রা অঞ্চল। সামনে বিসর্পিল- সুন্দর রাস্তা আমরা তার অভিযাত্রী। পাহাড়, হ্রদ, নদী, অরণ্য রাস্তার দু’ধারে ফেলে ফেলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সামনে আরও সামনে। মনে হচ্ছে অনন্তের পথে বুঝি আমাদের অভিযাত্রা। এই অভিযাত্রার শেষ নেই, বিরাম নেই।
এক সময় যাত্রার বিরতি ঘটলো। সটিনাসে ফিরে এলাম। পিয়া ও পিয়ার মা আমাকে উলফের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে পথেনবর্গের পথে রওনা দিলেন।
এখানে দু’দিন বিশ্রাম শেষে এবার আমার দেশে ফিরে যাবার পালা। পুরনো রাস্তা ধরে গহিন বনের মধ্য দিয়ে গাড়ি চালিয়ে উলফ আমাকে নিয়ে এলো। ট্রেনের স্টেশন ফলশপিং। রুবা, নাভিদও আমার সঙ্গে আছে। মনটা সবার ভারাক্রান্ত। মাস দেড়েক রুবার সঙ্গে ছিলাম। এখানে-ওখানে বেড়াতে গেলেও মনে হতো রুবা আমার সঙ্গে আছে। ওর কাছে আবার আমি ফিরে আসব। এবারের যাওয়া সে রকম নয়। দেশের উদ্দেশে রওনা দেবার জন্য স্টকহলম যাওয়া।
রুবা, উলফ, আমি সবাই চুপচাপ। কারো মুখে কথা নেই। সবাই যেন কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেছি। রুবাকে ও ওর ছোট ছেলে নাভিদকে ফেলে আসতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। অতি কষ্টে চোখের পানি গোপন করে ওদের বিদায় জানিয়ে ট্রেনে উঠে বসলাম। কিভাবে রাস্তা পাড়ি দিলাম জানি না। সারাক্ষণ মনের মধ্যে জড়িয়ে আছে রুবা, নাভিদ ও উলফকে ছেড়ে আসার বেদনাবোধ। স্টকহলম স্টেশনে ট্রেন এসে থামার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম- ছাত্রী মমতাজের স্বামী এসে দাঁড়িয়েছে ট্রেনের কামরার দোরগোড়ায়। ওকে দেখে আমি যেন সম্বিৎ ফিরে পেলাম।
ও হেসে বলল, আপা ভয় পেয়েছিলেন পথে? মুখটা এত শুকনো শুকনো কেন? আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে আমাকে নামতে বলে, আমার মাল-সামান সমেত নেমে এলো ট্রেন থেকে। এবার স্কেলেটারে চেপে ভূতলের ট্রেনে উঠতে যাবে। আমি কিছুতেই স্কেলেটারে যেতে রাজি হলাম না। ফলে বেচারার খুব কষ্ট হলো। লট-বহরসহ সিঁড়ি বেয় নিচে নামতে সময়ও গেল অনেক। বাঙালিদের লটবহর সে তো আর কাঁধের ছোট ব্যাগ নয়। বড় আকারের স্যুটকেস, মাঝারি গোছের দুটো ব্যাগ, ফাক্স, টিফিন ক্যারিয়ার। ভদ্রলোক একাই সব সামলালেন। আমাকে ধরতেও দিলেন না। একেবারে অদেখা অচেনা একটা লোক। ছাত্রীর স্বামী সম্পর্কের সূত্র ধরে আমার জন্য এত কিছু করবে, ভাবাও যায় না। আমি লজ্জিত। নিচে এসে মেট্রো ট্রেনে উঠলাম। এবার আমরা একেবারে চলে এলাম মমতাজের বাড়ির দোরগোড়ায়। ওখান থেকে লিফটে চড়ে চার তলায় মমতাজের ঘরের সামনে এসে কলিং বেল টিপতেই মমতাজ আমাকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালো। স্বামী-স্ত্রীর আন্তরিকতায়, অতিথিপরায়ণতায় আমি মুগ্ধ, কৃতজ্ঞ। আমি জানি না ছাত্রীরা আমাকে কেন এত ভালোবাসে। ছাত্রীদের জন্য আমি যা করেছি তা নিছক কর্তব্যবোধে করেছি। কিন্তু ছাত্রীদের কাছ থেকে আমি পেয়েছি অনেক বেশি। ওদের প্রেম-প্রীতি, অঢেল ভালোবাসার ফুলডোরে আমি বাঁধা পড়ে আছি।
সারাদিন হইচই, হট্টগোল, আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে ফিরে আসার সময় ছেলেদের বৌরা ধরে বসলো ওদের সমিতির পত্রিকার জন্য একটা কবিতা দিতে হবে। ওখানে বাঙালি মেয়েদের একটা সমিতি আছে। এই সমিতির মেয়েরা একটা পত্রিকাও বের করে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে। জানতে পেরে অনেক খুশি হলাম।
মুরাদের সাথে মমতাজের বাসায় ফিরে এসে সে রাতেই একটি কবিতা লিখলাম। কারণ পরদিন অর্থাৎ- আগস্টের ২ তারিখেই বাংলাদেশে ফিরে আসার ফাইট।
কবিতাটি উল্লেখ করেই আমার ভ্রমণ কাহিনীর ইতি টানবো :
সুইডেনের প্রতি ভালোবাসা
রক্ত গোলাপের মতো ফুটে আছে
বুকের অতলে আমার।
দামি আতরের সুবাস সুইডেনের স্মৃতিতে।
সুইডেন এক আনন্দ-সুন্দর ফুল বাগান।
কর্মনিষ্ঠ, সময়নিষ্ঠ সৎ মানুষের দেশ সুইডেন।
বিপন্ন মানবতার সেবায় নিবেদিত সুন্দর
একটি দেশের নাম সুইডেন।
বিজ্ঞান মানবতার সেবায় নিবেদিত সুন্দর
একটি দেশের নাম সুইডেন।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-শিক্ষা সভ্যতার শীর্ষে
এই দেশের অবস্থান।
পূর্ব দেশের ললনা আমি।
উত্তর প্রবাসে এসে নিয়ে গেলাম
দেশের মনোহর সুন্দরকে দু’চোখ ভরে
কর্মের প্রেরণা পেলাম হৃদয় জুড়ে।
আল্লাহর সৃষ্ট রাজ্যে অনুপম সুন্দর
একটি দেশের নামÑ
সুইডেন! সুইডেন!!
============================
কিশোরকন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ অধ্যাপিকা চেমন আরা

No comments

Powered by Blogger.